পূর্ব প্রকাশিতের পর
পাগলের বেশধারণ: আল্লাহর মহব্বতের শেষ মারহালায় পৌঁছে মানুষ হয়ত সত্যিকার আল্লাহর পাগল হয়ে যায়। অথবা পাগলের অনুকরণ করে, বেশ-ভুষা ধারণ করে। রাজা-প্রজা সবার গায়ে একই পোষাক। মাথা খোলা রেখে একটা চাদর শরীরে আরেকটা চাদর পরনে এ অবস্থায় কখনো আরাফার মাঠে, কখনো মুযদালিফার বালুর মধ্যে পাগলের মত পড়ে থাকতে হয়। সত্যিকার আল্লাহর পাগল এর মধ্যেই জান্নাতী স্বাদ অনুভব কারে। হজের সবকিছু আশেক-মা’শুকের মধ্যকার ভেদ; যা গোপন রাখতে হয়। কিন্তু দেখা যায় অনেক সময় সম্পূর্ণ শরীয়ত গর্হিত কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে।
কাফন সদৃশ সাদা ইহরাম : আল্লাহর ঘরের মেহমানরা ইহরামের কাপড় পরিধান করার পরÑ মনের মাঝে ভিন্নরকম এক অনুভ’তি জাগ্রত হয়। ইহরামের এ কাপড় মউতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। যে যত বড় কোটিপতি, বাড়ি-গাড়ির মালিকই হোক না কেন; শেষ বিদায়ের সময় দু’টুকরো সাদা চাদরই হবে তার আখেরি লেবাস। দুনিয়ার অর্থ-সম্পদ কিছুই তার কবরে যাবে না। এ পর্যন্ত পৃথিবীতে কেউ নিয়ে যেতে পারে নি। বাদশা সেকান্দর মৃত্যুর পূর্বে আত্মীয়-স্বজনদের বলে গেছেনÑ ‘আমি মারা গেলে আমার হাত দুটো কাফনের বাহিরে বের করে রাখবে। যাতে মানুষ বুঝতে পারে একজন বাদশা হয়েও তিনি মৃত্যুর সময় কিছু নিয়ে যেতে পারে নাই। রিক্তহস্তে কবরে যেতে হয়েছে। আজ মারা গেলে উপার্জিত অর্থ-সম্পদ সবই পড়ে থাকবে। সঙ্গে যাবে শুধু দু’টুকরো সাদা কাপড়। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে এমন আছে, যে নিজের চেয়ে অন্যের মাল বেশি হেফাযত করে? সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.) জবাব দিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের কেউ এমন নয়। নবীজি বললেন, তোমরা সবাই এমন কর; কেননা সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করে যে মাল তোমরা উপার্জন করছ এসবের মালিক তো তোমাদের বিবি বাচ্চারা তোমরা শুধু এতটুকুর মালিক যতটুকু তোমরা দান-খায়রাত করে পরকালের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছ। (সহীহ মুসলিম, ২৯৫৪)।
হজের সারসংক্ষেপ: হজের ফরজ তিনটি। ১. ইহরাম বাঁধা। ২. আরাফার ময়দানে উকুফ অর্থাৎ অবস্থান করা। ৩. ১০ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে তাওয়াফে যিয়ারত করা। হজের ওয়াজিবসমূহ। ১. ৯ই যিলহজ সুবহে সাদিকের পর থেকে সূর্যোদয়ের পূর্ব পর্যন্ত আরাফার ময়দানে অবস্থান করা। ২. ৯ তারিখ জোহরের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফার ময়দানে অবস্থান করা। ৩. মিনায় নির্দিষ্ট দিনগুলোতে কঙ্কর নিক্ষেপ করা। ৪. কুরবানী করা। ৫. মাথা মুণ্ডানো। মহিলাদের জন্য চুলের অগ্রভাগ থেকে একইঞ্চি পরিমাণ কাটা। ৬. হজের সায়ী করা । ৭. মিকাতের বাহির থেকে আগমনকারীদের জন্য বিদায়ী তাওয়াফ করা। হজের ফরযসমূহের কোনো একটা ছুটে গেলে হজ বাতিল বলে গন্য হবে। ওয়াজিব ছুটে গেলে হজ বাতিল হবে না। তবে দম দিতে হবে।
হজের জন্য দোয়া অব্যাহত রাখা: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান আসার দুই মাস আগে থেকে রমজান পর্যন্ত হায়াত প্রাপ্তির লক্ষ্যে নিজে দোয়া করতেন এবং উম্মতকেও এ দোয়া শিখিয়ে গেছেন। আমরা যারা অন্তরে হজের ইচ্ছা লালন করি আমাদেরও উচিত আল্লাহর কাছে দোয়া অব্যাহত রাখা। আল্লাহ তা’আলা যেন আমাদেরকে সরেজমিনে বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করার, মিনা, মুযদালিফা এবং আরাফার ময়দানে আল্লাহর মেহমানদারী গ্রহণ করার তাওফিক দান করেন। সাধ্যমতো কিছু অর্থকড়ি হজের নিয়তে জমা করতে থাকা। এটা হবে একটা উসিলা মাত্র। কারো দিলের উপর যদি হজ কবুল হয়ে যায়; তাকে আল্লাহ যে কোনো মাধ্যমে তাঁর ঘরে নিবেন এটাই সত্য।
আপনার হজ কবুল হয়েছে কি না? : একজন হাজী সাহেব হজের সমস্ত বিধি-বিধান রক্ষা করে হজ আদায় করলেও তিনি আশা-আশঙ্কার দোলাচলে থাকেন। মনের মাঝে একটা ভয় কাজ করে যে ‘আমার হজ আল্লাহর দরবারে কবুল হয়েছে কি না?’ কারণ কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না যে তার হজ¦ অবশ্যই কবুল হয়েছে। তবে কিছু আলামত এমন রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে হজ কবুল হওয়ার ব্যাপারে প্রবল আশা করা যায়। সেটা হলো হজ থেকে এসে, হজে যাওয়ার পূর্বের জীবন এবং পরের জীবনের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারা। আমলের ক্ষেত্রে অগ্রগামী হওয়া। শরয়ী বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে আদায়ের চেষ্ট করা। আদব-আখলাক লেনদেন ইত্যাদিতে পরিবর্তন আসা- হজ কবুল হওয়ার আলামত হতে পারে। একবার হজ থেকে ফিরে এসে বারবার হজ করার আগ্রহ অন্তরে থাকা। এমন যেন না হয় এবারই শেষ! সাত্যিকারার্থে যিনি বাইতুল্লাহর মালিকের প্রেমিক হবেন তার মানসপটে সবসময় ভেসে উঠবে কালো গিলাফে মোড়ানো কা’বার ছবি। শয়নে-স্বপনে বিভোর থাকবে মসজিদে নববীর কথা ভেবে। রাসূলের রাওজার পাশে দঁড়িয়ে সালাম নিবেদনের মুহূর্তে অন্তরের কী অবস্থা হয়ে ছিল! হজের ঐতিহাসিক স্থানসমূহের স্মৃতিগুলোর জল্পনা-কল্পনা। সুদূর বাংলাদেশে থেকেও তার মন পড়ে থাকবে হারাম শরীফের প্রাঙ্গণে। আল্লাহ আমাদের সকলকে ‘হজ্জে মাবরুর’ নসিব করুন।
লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক। ভাইস প্রিন্সিপাল: মদিনা মাদরাসা রায়পুরা, নরসিংদী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন