চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলকে পুরোপুরি সুরক্ষিত করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) পক্ষ থেকে পদ্মা সেতুর মতো টানেলের দুই প্রান্তে দুটি থানা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। নগরীর পতেঙ্গা প্রান্তে থানার নাম হবে- ‘বঙ্গবন্ধু টানেল পশ্চিম থানা’ এবং আনোয়ারা প্রান্তের থানার নাম হবে ‘বঙ্গবন্ধু টানেল পূর্ব থানা’। একই সাথে টানেল এলাকার পাশে একটি পুলিশ লাইন করারও প্রস্তাব করা হয়। টানেল চালুর আগেই ওই এলাকার সার্বিক শৃঙ্খলা তথা নিরাপত্তায় থানার কার্যক্রম শুরুর পক্ষে মত দিয়েছেন সিএমপির কর্মকর্তারা।
দেশের প্রথম এই টানেল নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ। গতকাল বুধবার ঢাকার বানানীতে সেতু ভবনে এক সভায় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, প্রকল্পের কাজ ৮৭ শতাংশ শেষ হয়েছে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ খুলতে পারে এই অঞ্চলের কোটি মানুষের স্বপ্নের টানেলের দুয়ার। দক্ষিণ এশিয়ার দীর্ঘতম এই রোড টানেল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সঙ্গে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সংযোগ সৃষ্টি করবে। টানেলের মাধ্যমে চট্টগ্রাম হবে ওয়ান সিটি টু টাউন। চট্টগ্রাম বন্দর, বে-টার্মিনাল ও মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরকে ঘিরে এই অঞ্চলে আগামি দিনে বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হবে। তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এই টানেল।
চীনের আর্থিক সহযোগিতায় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন টানেল প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। নির্মাণকাজ করছে চীনা কোম্পানি চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই টানেলে প্রতিটি টিউব বা সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। একটির সঙ্গে অপর টিউবের দূরত্ব ১২ মিটারের মতো। প্রতিটি টিউবে দুটি করে মোট চারটি লেন তৈরি করা হয়েছে। টানেলের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে থাকছে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক। এছাড়া ৭২৭ মিটার দৈর্ঘ্যরে একটি ছোট ফ্লাইওভার রয়েছে আনোয়ারা প্রান্তে।
চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গায় নেভাল অ্যাকাডেমির পাশ দিয়ে ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরতায় নেমে যাওয়া এই টানেল কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ-পূর্বে আনোয়ারায় সিইউএফএল ও কাফকোর মাঝামাঝি এলাকা দিয়ে স্থলপথে বের হবে। ৩৫ ফুট প্রশস্ত ও ১৬ ফুট উচ্চতার টানেলে দুটি টিউব দিয়ে যানবাহন চলাচল করবে। টানেলের উত্তরে নগরীর দিকে সিটি আউটার রিং রোড, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কাটগড় সড়ক, বিমানবন্দর সড়ক এবং পতেঙ্গা সৈকত সড়ক দিয়ে টানেলে প্রবেশ করা যাবে।
টানেলের এ প্রান্তে শাহ আমানত আন্তর্র্জাতিক বিমানবন্দর ওপারে কাফকো, সিইউএফল, কোরিয়ান ইপিজেড, প্রস্তাবিত চায়না ইপিজেডসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে। এই টানেল আনোয়ারা হয়ে বাঁশখালীর গন্ডামারায় গড়ে উঠা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের, কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়িতে নির্মাণাধীন এনার্জি হাবের সাথে সংযোগ ঘটাবে। আগামি দিনে চট্টগ্রামের মীরসরাই থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভওয়ে নির্মিত হবে এই টানেল হয়েই।
টানেল চালুর পর এই অঞ্চলে যে বিশাল আকারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হবে তা সামাল দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। বিশেষ করে ওই এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টানেলে যানবাহন চলাচল শুরু হলে ওই এলাকায় নিরাপত্তা সমস্যা দেখা দিতে পারে। আর তাই টানেল চালুর আগেই নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সরকারের তরফে টানেল এলাকায় ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে সুপারিশ প্রণয়নে আগেই একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটি ইতোমধ্যে তাদের সুপারিশ তুলে ধরেছে। সে আলোকে টানেল এলাকায় যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে টানেলের দুই প্রান্তে অতিরিক্ত লেইন ও সংযোগ সড়ক নির্মাণকাজ চলছে।
সিএমপির পক্ষ থেকে টানেলের দুই প্রান্তে দুটি নতুন থানা এবং নিরাপত্তার প্রয়োজনে আরো একটি পুলিশ লাইন করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কর্ণফুলী উপজেলায় চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার (সিইউএফ) কারখানা সংলগ্ন ২৫ একরের বেশি জায়গা নিয়ে নতুন পুলিশ লাইন প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব ইতোমধ্যে পুলিশ সদর দফতরে পাঠানো হয়েছে। নগর পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জেলা থেকে কিছু অংশ যুক্ত করে নতুন চারটি থানা নিয়ে মহানগর পুলিশের পরিসর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ চারটি থানার মধ্যে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেলের দুই পাশে দুটি নতুন থানা করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এর মধ্যে আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ, বারাশাত, রায়পুর ও বড় উঠান ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত হবে বঙ্গবন্ধু টানেল পূর্ব থানা। আর নগরীর অংশে সিটি কর্পোরেশনের ৪১ নম্বর দক্ষিণ পতেঙ্গা ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত হবে বঙ্গবন্ধু টানেল পশ্চিম থানা।
অন্যদিকে সিটি কর্পোরেশনের ১০ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে কাট্টলী থানা এবং ৫ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে মোহরা থানা করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। ১৯৭৮ সালে ছয়টি থানা ও ২ হাজার ৪৮৬ জন জনবল নিয়ে সিএমপির কার্যক্রম শুরু হয়। ৪৪ বছরে এ মহানগরে থানা বেড়ে হয়েছে ১৬টি। পাশাপাশি জনবল বেড়ে হয়েছে সাত হাজারের বেশি। কর্ণফুলী টানেলসহ বেশকিছু স্থাপনা নির্মিত হওয়ায় আওতা বাড়াতে কর্ণফুলী উপজেলার সিইউএফএল সংলগ্ন খাস জমিতে ২৫ একর জায়গা জুড়ে তৃতীয় পুলিশ লাইন স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছে সিএমপি।
জানা গেছে, নতুন পুলিশ লাইন স্থাপনের প্রস্তাবটি পুলিশ সদর দফতরে আছে। সেখান থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ে যাবে। এটি অল্প সময়ের মধ্যেই বাস্তবায়ন শুরু হবে বলে আশা করছেন সিএমপির কর্মকর্তারা। প্রস্তাবনায় বলা হয়, চট্টগ্রামের পতেঙ্গা, পারকী সমুদ্র সৈকত, বিমানবন্দর, টানেল, কোরিয়ান ইপিজেড, চায়না ইপিজেডসহ বিভিন্ন স্থানের নিরাপত্তায় অনেক পুলিশ সদস্যের প্রয়োজন পড়বে। সেই প্রয়োজন নগরীর দামপাড়া কিংবা মনসুরাবাদ পুলিশ লাইন থেকে মেটানো কঠিন হবে। কর্ণফুলীতে নতুন পুলিশ লাইন হলে সেখান থেকে ফোর্স পাঠানো অনেকটা সহজ হবে। আর পরিসর বাড়িয়ে যেহেতু নতুন চারটি থানা হচ্ছে, তাই সেগুলোর জন্য আবাসন ব্যবস্থা বর্তমানের দুটি পুলিশ লাইনের মাধ্যমে সম্ভব নয়। সেজন্যও জায়গা প্রয়োজন।
প্রস্তাবিত তৃতীয় পুলিশ লাইনে ব্যারাকের পাশাপাশি থাকবে পরিবহন ডাম্পিং স্টেশন, ওয়ার্কশপ, ইন সার্ভিস ট্রেইনিং সেন্টার, জোনাল এসি অফিস (সহকারী কমিশনার কার্যালয়), বন্দর পুলিশ ফাঁড়ি এবং বন্দর জোনের উপ-কমিশনার কার্যালয়। সিএমপির কর্মকর্তারা জানান, খুব শিগগির দুটি থানা এবং পুলিশ লাইন প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হবে। টানেল চালুর আগেই নিরাপত্তা নিশ্চিতে থানার কার্যক্রম শুরু করা জরুরি বলে জানান তারা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন