তলোয়ার ও রাইফেল নিয়ে সকালে দেওয়া বক্তব্য বিকালে পাল্টালেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের শুরুর দিনে দুটি দলের সঙ্গে দুই ধরনের বক্তব্য দেন তিনি। আমরা সহিংসতা বন্ধ করতে পারব না। আপনাদেরকেও (রাজনৈতিক দলের) দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ খেলোয়াড় কিন্তু আপনারা। আপনারা মাঠে খেলবেন, আমরা রেফারি। আমাদের অনেক ক্ষমতা আছে। ক্ষমতা কিন্তু কম না, ক্ষমতা প্রয়োগ করব জানান সিইসি।
গতকাল রোববার সকালে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল-এনডিএমের সঙ্গে সংলাপের সময় তলোয়ারের বিপরীতে প্রতিপক্ষকে রাইফেল নিয়ে দাঁড়ানোর পরামর্শ দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। কিন্তু বিকাল আড়াইটায় তৃতীয় দফায় বাংলাদেশ কংগ্রেসের সঙ্গে সংলাপে তিনি তলোয়ার ও রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ না করার পরামর্শ দেন। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত সংলাপে প্রথম দিনে ৪টি দলকে আমন্ত্রণ জানালেও তিনটি দল এতে অংশ নিয়েছে। বিকালে বাংলাদেশ কংগ্রেসের সঙ্গে সংলাপে সিইসি বলেন, নির্বাচন এক ধরনের যুদ্ধ। অনেকেই বলছেন আসেন, যুদ্ধের মাঠে আসেন। সেখানে আসলে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করলে হবে না। আপনাদের আসলে জনসমর্থন নিয়ে যুদ্ধ করতে হবে। আপনারা তলোয়ার-রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ করবেন না। আপনাদের জনসমর্থন যেগুলো আছে, তারা আসবে। আপনারা ব্যালট নিয়ে যুদ্ধ করবেন। সেই যুদ্ধটা আপনাদের করতে হবে। এর আগে সকাল সাড়ে ১০টায় শুরু হওয়া প্রথম সংলাপে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোকে রাইফেল অথবা তলোয়ার নিয়ে দাঁড়ানোর পরামর্শ দিয়ে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ভোটের মাঠের সহিংসতা নির্বাচন কমিশন বন্ধ করতে পারবে না। আপনাদের (রাজনৈতিক দলকে) দায়িত্ব নিতে হবে। আপনারা মাঠে যাবেন। মাঠে খেলবেন, আমরা রেফারি। সব দল সহযোগিতা না করলে আমরা সেখানে ব্যর্থ হয়ে যাবো। আপনাদের সমন্বিত প্রয়াস থাকবে, কেউ যদি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়ায়, আপনাকে রাইফেল বা আরেকটি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়াতে হবে। আপনি যদি দৌড় দেন, তাহলে আমি কী করবো? কাজেই আমরা সাহায্য করবো। পুলিশের ওপর, সরকারের ওপর আমাদের কমান্ড থাকবে। অবশ্য সিইসির এমন বক্তব্যের পর এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বলেন, আইনে আমাদের শটগান নিয়ে দাঁড়ানো পারমিট করে না। তবে তৃতীয় দফার সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে দূরত্ব কমানোর পরামর্শ দিয়ে সিইসি বলেন, শক্তির ভাষায় কথা না বলে টেবিলে বসে যুক্তির ভাষায় কথা বলুন। গঠনমূলক আলোচনা করুন। সংকট থেকে যেতে পারে। অনাস্থা দূর হতে পারে, বা কমে আসতে পারে। অনুকূল পরিবেশ এবং সমতল ভিত্তির ওপর নির্বাচন পরিচালনার আশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, সবার দায়িত্বশীল আচরণ এবং একান্ত সহযোগিতা প্রয়োজন।
এরপরই নিবন্ধিত ৩৯ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে বসেছে ইসি। গতকাল থেকে শুরু হওয়া সংলাপ চলবে আগামী ৩১ জুলাই পর্যন্ত। সিইসি বলেন, নির্বাচন এক ধরনের যুদ্ধ। অনেকেই বলছেন, আসেন যুদ্ধের মাঠে আসেন। সেখানে আসলে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করলে হবে না। আপনাদের জনসমর্থন নিয়ে যুদ্ধ করতে হবে। আপনারা তলোয়ার রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ করবেন না। আপনাদের জনসমর্থন যেগুলো আছে তারা আসবে। আপনারা ব্যালট নিয়ে যুদ্ধ করবেন। সেই যুদ্ধটা আপনাদের করতে হবে।
সিইসি বলেন, আমি আপনাদেরকে স্পষ্ট করে জানাতে চাচ্ছি, ১৪ সালের নির্বাচনের দায় আমাদের ওপর চাপাবেন না, ১৮ সালের নির্বাচনের দায় আমাদের ওপর চাপাবেন না। আমরা শুধু আমাদের নির্বাচনের দায় বহন করব। নির্বাচনটাকে অংশগ্রহণমূলক এবং নিরপেক্ষ করতে আমরা সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করব। দলগুলো সহযোগিতা না করলে আমরা সেখানে ব্যর্থ হয়ে যাব। তিনি বলেন, ‘আপনাদের সমন্বিত প্রয়াস থাকবে, কেউ যদি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়ায়, আপনাকে রাইফেল বা আরেকটি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়াতে হবে। আপনি যদি দৌড় দেন, তাহলে আমি কী করব? কাজেই আমরা সাহায্য করবো। পুলিশের ওপর, সরকারের ওপর আমাদের কমান্ড থাকবে। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের সময় যেটি থাকবে, সেটি কিন্তু সরকার। আমি বারবার বলেছি, রাজনৈতিক দল আর সরকার এক নয়। প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগেরও সভানেত্রী। কিন্তু যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী, তখন তিনি সরকার প্রধান, আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নয়। এটি বুঝতে হবে। আমরা সরকারের সাহায্য চাইব। সরকার যদি সহায়তা না করে, তাহলে নির্বাচনের পরিণতি খুবই ভয়াবহ হতে পারে।
সিইসি বলেন, ‘ইতোপূর্বে আমরা বহুবার বলেছি যে, সব রাজনৈতিক দল, বিশেষত প্রধান প্রধান দলগুলোর নির্বাচনে অংশ নেওয়া খুবই প্রয়োজন। কোনো দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে আমরা বাধ্য করতে পারব না। তবে সব দলকে কার্যকরভাবে অংশ নিতে আমরা বারবার আহ্বান জানিয়ে যাব। সে প্রচেষ্টা আমদের অব্যাহত থাকবে। আজকেও আপনাদের মাধ্যমে সব দলকে আহ্বান জানাচ্ছি সক্রিয়ভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযোগিতা না থাকলে জনমতের সঠিক প্রতিফলন হয় না। পক্ষ-প্রতিপক্ষের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা মাঠ পর্যায়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সম্ভাব্য অনিয়ম, কারচুপি, দুর্নীতি, অর্থ শক্তির বৈভব, পেশি শক্তির প্রয়োগ ও প্রভাব বহুলাংশে নিয়ন্ত্রিত হতে পারে।
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন সবার অংশগ্রহণ, সহযোগিতা ও সমর্থন নিয়ে নির্বাচন করতে চায়। অন্যথায় অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে আমাদের প্রয়াস যতই আন্তরিক হোক, ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে। সেটা কাম্য নয়। বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। একটি মাত্র দলের ৩০০ আসনেই জয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে সাংবিধানিকভাবে কোনো বাধা নেই। তবে ইতিহাস বলে সেক্ষেত্রে অচিরেই গণতন্ত্রের অপমৃত্যু হবে। স্বৈরতন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। গণতন্ত্রের আরাধ্য পুনরুদ্ধার হয়ে পড়বে দুরহ।
তিনি বলেন, ‘আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে নানাবিধ আশা, হতাশা ও তর্ক-বিতর্ক চলছে। বিতর্কগুলো নিরসন হওয়া প্রয়োজন। ইতোপূর্বে কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা কয়েটি উন্মুক্ত সংলাপ করেছি। এতে অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের মতামত ব্যক্ত করা হয়েছে। কমিশনের সক্ষমতা ও সাধ্যের সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা নির্দ্বিধায় তা স্বীকার করে নিয়ে কারণগুলো বারবার ব্যাখ্যা করে বলেছি। ’ সিইসি বলেন, ‘ইভিএম নিয়ে পাঁচ-সাতটি কর্মশালা করার পর আমরা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এবং বিষেষজ্ঞদের উপস্থিতিতে উন্মুক্ত সভা করেছি। কেউ কোনো ত্রুটি দেখাতে পারেনি। ইভিএম এবং ব্যালটের মাধ্যমে নির্বাচনে তুলনামূলক সুবিধা-অসুবিধা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আরপিও ২৬ অনুযায়ী, কারচুপির বিধান উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলো প্রতিপালন করা হলে কারচুপি প্রতিরোধ করা সম্ভব।
৩৯ রাজনৈতিক দলকেই সংলাপের সময় দিয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছে ইসি। প্রথম দিনের প্রথম অংশে বসেছে জাতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) সঙ্গে। এতে দলের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল অংশ নেন। এছাড়া অন্য নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এতে উপস্থিত ছিলেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন