দৃষ্টিশক্তি আল্লাহ তায়ালার বিশেষ নেয়ামত। এই নেয়ামতের যেমন শুকরিয়া আদায় করা উচিত তেমনি এর যথাযথ মূল্যায়ন করে সঠিক স্থানে ব্যবহার করা উচিত। আল্লাহ তায়লা আমাদের যত নেয়ামত দিয়েছেন প্রত্যেক নেয়ামতের ব্যবহারবিধি বলে দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ তায়ালা আমাদের বাকশক্তি দিয়েছেন এবং রাসূল সা. এর মাধ্যমে তা ব্যবহারের নীতি নির্ধাারণ করে দিয়েছেন। সদা সত্য বলতে হবে। কোন ধরণের গালি-গালাজ করা যাবে না কোথাও মিথ্যার আশ্রয় নেয়া যাবে না ইত্যাদি।
দৃষ্টিশক্তি তথা এই দুচোখ ব্যবহারেও আল্লাহ আমদের নিয়ম বেধে দিয়েছেন। এই চোখ দ্বারা অশ্লিল কিছু দেখা যাবে না । টিভি, সিনেমা, নাচ-গান এজাতীয় অবৈধ কিছুর প্রতি দৃষ্টি দেয়া যাবে না। তেমনি কোন বেগানার প্রতি দৃষ্টি দেয়া যাবে না। সদা দৃষ্টি সংরক্ষণ করতে হবে। কারণ,এ দুচোখই হল সকল অশ্লিলতার প্রবেশদ্বার। অশ্লীল সব কাজের শুরুটা কিন্তু এ দুচোখ দিয়েই হয়। দুচোখ দিয়ে প্রথমে তা দেখে। অতঃপর ধীরে ধীরে সে কাজের প্রতি নিজেকে ধাবিত করে এবং নিজেকে নগ্নতা আর বেহায়াপনার অন্ধকারে ঠেলে দেয়। তাই ইসলাম এই দুই প্রবেশদ্বারে পাহারাদার নিযুক্ত করে দিয়েছে। প্রত্যেক মুমিনকে নিজের দৃষ্টি অবনত করে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং এতেই তাদের পবিত্রতা নিহিত রয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন-“হে নবী! আপনি মুমিনদের বলে দিন, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য রয়েছে পবিত্রতা। তারা যা করে মহান আল্লাহ তা সম্পর্কে সম্মক অবগত” (সূরা নূর-৩০) কুরআনের এই বাণিটি মুমিনদের জন্য পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা। এই আয়াতের মধ্যে প্রথমে অবৈধ জিনিস থেকে দৃষ্টিকে অবনত করে রাখার কথা এবং সর্বশেষ লজ্জাস্থানের হেফাজতের কথা বলে এই দিকেই ইঙ্গিত করেছে যে, দৃষ্টির হেফাজত মুমিনের প্রথম কাজ। লজ্জাস্থানের সংরক্ষণ সর্বশেষ কাজ। একটির জন্য অপরটি অপরিহার্য। অর্থাৎ-লজ্জাস্থান সংরক্ষণ করতে হলে প্রথমে তার প্রবেশদ্বার দৃষ্টির হেফাজত করতে হবে। দৃষ্টির লাগাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে লজ্জাস্থানও অনিবার্যভাবে অনিয়ন্ত্রতি ও অসংরক্ষিত হয়ে পড়বে। ফলে গুনাহের নগ্ন দ্বার আরো উন্মুক্ত হয়ে যাবে।
তাই অশ্লীলতা আর বেহায়াপনার অন্ধকার থেকে বাঁচার অনিবার্য দাবী হলো, তার প্রবেশদ্বার তথা দৃষ্টি সংযত রাখা এবং শক্ত হাতে তার লাগাম নিয়ন্ত্রণ করা । এর দ্বার কেবল গুনাহমুক্ত নয় বরং অন্তরের পবিত্রতাও অর্জন হয়। অন্তরে গুনাহের কুমন্ত্রণা জাগে না। ইবাদতে যেমন মনযোগ তৈরি হয় তেমনি প্রবৃত্তির পাশবিক তাড়না ও শয়তানী কুমন্ত্রণা থেকে অন্তপ্রাণকে বাঁচানো যায়। সর্বোপরি মানব সমাজের শৃঙ্খলা বজায় থাকে।
আর এই নির্দেশনা কেবল মুমিন পুরুষদের জন্য নয়। নারীদের প্রতিও আল্লাহ তায়ালা একই ঘোষণা দিয়েছেন। কারণ, আল্লাহ তায়ালা নারাী-পুরুষ উভয়কে অভিন্ন উপকরণ দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। যৌবিক চাহিদা কিংবা যৌনতার প্রতি আকর্ষণ যেমন পুরুষদের মধ্যে রয়েছে তেমনি নারী প্রকৃতিতেও তা বিদ্যমান। তাই আল্লাহ তায়ালা তাদের উদ্দেশ্যে বলেন-“হে নবী! ঈমানদার নারীদেও বলে দিন, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে” উভয় আয়াতের বাহ্যিক ও অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এ বাস্তবতাকেই বারবার স্পষ্ট করে তোলে যে, দৃষ্টির নিয়ন্ত্রণহীনতা আর লাগামহীনতাই বেহায়াপনার বিস্তৃতি ঘটায় এবং লজ্জাস্থানের শিহরণ তৈরি করে। এহেন পরিস্থিতিতে মানুষ অতি আবেগপ্রবন হয়ে বিবেক বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে এবং গুনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ে। আর ধীরে ধীরে নিজেকে অন্ধকারের অতলে হারিয়ে ফেলে। এক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয় অভিন্ন। তাই আল্লাহ তায়ালা উভয় শ্রেণিকেই দৃষ্টি সংযত রাাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
দৃষ্টি জৈবিক চাহিদার মূলদ্বার, পিয়ন ও রাহবার হয়ে থাকে। দৃষ্টির হেফাজতে মূলতঃ লজ্জাস্থান ও জৈবিক চাহিদা/যৌনচাহিদা পূরণের অবাধ সুযোগের সংরক্ষণ হয়ে থাকে। যে দৃষ্টিকে লাগামহীন ছেড়ে দিয়েছে সে নিজেকে ধ্বংসের মাঝে ফেলে দিয়েছে। মানুষ যেসব আপদে নিমজ্জিত হয় সেসবের মূল ভিত্তি হল দৃষ্টি। মানুষের লজ্জাস্থানের যেমন ব্যবিচার হয় তেমনি হাত, পা চোখ ইত্যাদিরও ব্যবিচরর হয়। চোখের ব্যবিচার হল দেখা, নারীর প্রতি পুরুষের কিংবা পুরুষের প্রতি নারীর কুদৃষ্টি দেয়া। রাসূল সা. বলেন দুুচোখের ব্যবিচার হল হারাম দৃষ্টি দেয়। দুই কানের ব্যবিচার হল পরনারীর কণ্ঠস্বর শুনা। যবানের ব্যবিচার হল অশোভন উক্তি। হাতের ব্যবিচার পরনারীরকে স্পর্শ করা। পায়ের ব্যবিচার হল গুনাহের কাজের দিকে পা বাড়ানো। অন্তরের ব্যবিচার হল কামনা-বাসনা। আর গুপ্তাঙ্গ তা সত্য বা মিথ্যায় পরিণত করে। (মুসলিম-২৬৫৭) অর্থাৎ কোন পুরুষ পরনারীর প্রতি অথবা কোন নারী তার পরপুরুষের প্রতি কামভাব নিয়ে তাকানো মাত্রই সে চোখের ব্যবিচারে লিপ্ত হয়ে যায়।
শয়তান পরনারীর চেহারাকে খুব নয়নলোভন পদ্ধতিতে উপস্থাপন করে। ফলে মানুষ তার প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং হৃদয়ে পাপের বাসনা তেরি হয়। সুযোগ ফেলেই তা বাস্তবে রূপ নেয়। কাবিল হাবিলের স্ত্রীর রূপ -যৌবনের প্রতি কুদৃষ্টি দিয়েছিল, পরিণামে তার কাঁধে এমনই ভুত চড়ে বসেছিল যে, আপন ভাইকে হত্যা করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। হত্যার মত গুনাহের ভিত্তি রচনা করার কারণে কেয়ামত পর্যন্ত ঘটিতব্য সকল হত্যার বোঝা তার ঘাড়েও চাপানো হবে। যেসব মেয়ে সাজগোজ করে পর্দার কোন তোয়াক্কা করে না, অবাধে ঘুরে বেড়ায় এবং যারা তাদের দিকে কামভাব নিয়ে তাকায় উভয় শ্রেণীই অভিশপ্ত। বর্তমান সমাজে নগ্নতা আর বেহায়াপনর চড়াছড়ি একুদৃষ্টির কারণেই। এক্ষেত্রে রানী-পুরুষ উভয়ই সমান অপরাধী। অবশ্য এক্ষেত্রে নারীর পর্দাহীনতাও বেশ উল্লেখযোগ্য। তাদের পর্দাহীনতার কারণেই তাদের প্রতি অসত লোকদের কুদৃষ্টি পড়ে। ফলে তারা ইভটিজিং এর শিকার হয়। তাই রাসূল সা. উভয়কেই অভিশপ্ত বলেছেন। রাসূল সা. বলেন “ মহান আল্লাহ অভিশম্পাত দেন কুদৃষ্টি দানকারী পুরূষ ও দৃষ্টিদানে সুযোগদানকারী নারীর ওপরও”। (মিশকাত ২৭০)
রাস্তা-ঘাটে হাট-বাজারে অনেক সময় অনাকাঙ্খিতভাবে পরনারী সামনে চলে আসে। ফলে হঠাৎ তার প্রতি অনাকাঙ্খিত দৃষ্টি পড়ে যায়। এমন দৃষ্টিকে রাসূল সা. ক্ষমাযোগ্য বলে ঘোষণা করেছেন। এ পরিস্থিতি সম্পর্কে হযরত আলী রা. রাসূল সা. কে জিজ্ঞেস করলে উত্তরে রাসূল সা. বলেন-“ হে আলী, অনাকাঙ্খিত দৃষ্টি পড়ে গেলে পুনরায় তুমি দৃষ্টি দিও না। কেননা প্রথম দৃষ্টি তোমর জন্য ক্ষমাযোগ্য কিন্ত পুনরায় দৃষ্টিপাত করা তোমার জন্য ক্ষমাযোগ্য নয়”। (তিরমিযি শরীফ-২৭৭৭)
ইমাম গাযালী রহ. বলেন কুদৃষ্টি অন্তরে খটকা তৈরি করে। পরে তা কল্পনায় রূপ নেয়। কল্পনা জৈবিক তাড়নাকে উসকে দেয়। আর জৈবিক তাড়না ইচ্ছার জন্ম দেয়। সুতরাং পরনারীর প্রতি দৃষ্টি দেয়ার পরই ব্যবিচারের ইচ্ছা জাগে। ব্যবিচারের প্রথম সিঁড়ির নাম হল কুদৃষ্টি। ব্যবিচার থেকে বাঁচতে হলে তার প্রথম ধাপ কুর্দষ্টি পরিহার করতে হবে।
লেখক: মুফতী ইমামুদ্দীন সুলতান
শিক্ষক, মাদরাসা বাহরুল উলূম ঢাকা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন