ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজ জাতীয়করণ আন্দোলনের ৪৩তম দিনের বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ বেপরোয়া লাঠিচার্জসহ রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। এতে কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ এবং ছফর আলী নামে একজন পথচারী নিহত হয়েছেন। শিক্ষকসহ অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, পুলিশ কলেজের ভেতর ঢুকে অফিসকক্ষে অবস্থানরত শিক্ষকদের ওপর লাঠিচার্জ করে। এ সময় আবুল কালাম আজাদ অজ্ঞান হয়ে পড়েন। হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ছফর আলী পুলিশের লাঠিপেটায় নিহত হন বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত ছবি থেকে দেখা যায়, রাস্তায় ছফর আলী পড়ে আছেন, সেখানেই দাঁড়ানো আছে পুলিশের একটি গাড়ি। আরেক ছবিতে দেখা যায়, পুলিশের লাঠিপেটা থেকে একজন শিক্ষক আত্মরক্ষার চেষ্টা করছেন। স্থানীয় পুলিশের তরফে দু’জনের নিহত হওয়ার কথা স্বীকার করা হলেও লাঠিপেটার কথা অস্বীকার করা হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ, পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট ও ছবি পুলিশের বক্তব্য সমর্থন করে না। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, ফুলবাড়িয়াতে বড় ধরনের বাড়াবাড়ি হয়েছে। একশ্রেণীর পুলিশ যে কাউকেই মানুষ মনে করে না, এ ঘটনায় তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে। অতীতে আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ এমন ছিল, যখন সবাই ছাত্রদের স্নেহের চোখে দেখত। এমনকি পুলিশও ছাত্রদের প্রতি ছিল নমনীয়। তাদের ছোটখাটো অন্যায় পুলিশ আমলে নিত না। আর শিক্ষকরা তো সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের কাছেই ছিলেন শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র। আজ সেই মূল্যবোধ একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে। যেসব পুলিশ ওই দিন ছাত্রদের ওপর লাঠি চালিয়েছেন, তারা কোনোকালে ছাত্র ছিলেন, মনে হয় না। মনে হয় না তারা কোনো শিক্ষকের কাছে কখনো পাঠ নিয়েছেন। নিলে শিক্ষকদের ওপর অমন নির্মম লাঠিচার্জ তারা করতে পারতেন না। পুলিশের লাঠিতে শিক্ষকসহ দু’জনের নিহত হওয়ার ঘটনায় আমাদের নিন্দা জানানোর ভাষা নেই।
পুলিশের বেপরোয়া আচরণ, মারকুটে স্বভাব, নানাবিধ দৌরাত্ম্য, অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অপরাধপ্রবণতা রীতিমতো উদ্বেগজনক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। আইনশৃঙ্খলা সুরক্ষা ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা পুলিশের প্রধান কর্তব্য। এই কর্তব্যে বিচ্যুতি এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে যে, পুলিশকে এখন মানুষ বিশ্বাস করে না, আস্থায় নিতে চায় না। পুলিশ মানে আতঙ্ক, এরকম একটা বোধ সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশ জনগণের সেবক না হয়ে পরিণত হয়েছে দেশের রাজায়। ক্ষমতাগর্ব এবং যাচ্ছেতাই করার দায়মুক্তি একশ্রেণীর পুলিশকে চরম বেপরোয়া করে তুলছে। এর একটি নজির হিসেবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের এসপির সাম্প্রতিক একটি বক্তব্য উল্লেখ করা যায়। ওই এসপি এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘ডাকাত যদি হাতেনাতে পান, তো জলজ্যান্ত ওটাকে পিষে মেরে ফেলেন। একটা মার্ডার কেস নেব এটা সত্য কথা এবং এক মাসের মধ্যে ফাইনাল রিপোর্ট দিয়ে চলে আসব। গ্যারান্টি আমার। আমি যদি গ্যারান্টার হই তবে আপনাদের কোনো ভয় আছে?’ কোনো পুলিশ কর্মকর্তা এ ধরনের দর্পিত বক্তব্য দিতে পারেন, মানুষকে আইন হাতে তুলে নেয়ার প্ররোচনা দিতে পারেন, কল্পনাও করা যায় না। উল্লেখ করা যেতে পারে, তার ওই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে একটি রুলসহ আদেশ জারি করেছেন। ৪ ডিসেম্বর আদালতে হাজির হয়ে কিংবা আইনজীবীর মাধ্যমে তাকে তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। হাইকোর্টকে ধন্যবাদ এমন একটি গুরুতর বিষয় আমলে নেয়ার জন্য। যত বড় অবস্থানেই থাকুন এবং যত ক্ষমতাধরই হোন কেন, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন। এ কথাটা যদি ক্ষমতাবানরা স্মরণ রাখেন, তাহলে তাদেরও মঙ্গল, দেশেরও মঙ্গল।
পুলিশের কোনো সদস্যকেই ঘাতক, পীড়ক, নির্যাতক, ধর্ষক, চাঁদাবাজ, দখলবাজ, অপরাধী এবং অপরাধীর পৃষ্ঠপোষক হিসেবে দেখতে চায় না দেশের মানুষ। বিপদাপদে তাদের বন্ধু, সাহায্যকারী ও আশ্রয়দাতা হিসেবেই দেখতে চায়। এটাই স্বাভাবিক ও সঙ্গত প্রত্যাশা। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, পুলিশে সৎ, ন্যায়বাদী, দায়িত্বশীল, হিতৈষী ও সহৃদয় সদস্যের সংখ্যাই বেশি। সামান্য কিছুসংখ্যক সদস্য থাকতে পারে এর ব্যতিক্রম। তাদের অপকর্ম ও অপরাধের দায় পুলিশ বাহিনী নিতে পারে না। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে। জনবান্ধব ও সৃশৃঙ্খল বাহিনী হিসেবে পুলিশের ভাবমর্যাদা প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। আমরা জানি, পুলিশের কোনো কর্মকর্তা ও সদস্যের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্তের ব্যবস্থা আছে, অভিযোগ প্রমাণিত হলে দন্ডের ব্যবস্থাও আছে। তবে বলা হয়ে থাকে, গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রেও অনেক সময় লঘুদ- হয়ে থাকে। এ দিকটি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেই দেখতে হবে। অপরাধীকে প্রশ্রয় দেয়ার কিংবা রক্ষা করার দায়িত্ব পুলিশ নিতে পারে না। পরিশেষে আমাদের প্রত্যাশা, ফুলবাড়িয়ার ঘটনার অনুপুঙ্খ তদন্ত হবে, সেখানকার পুলিশ কর্তৃপক্ষ কতটা বাড়াবাড়ি করেছে, কতটা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে, সেটা খতিয়ে দেখতে হবে। দায়ীদের বিরুদ্ধে অবশ্যই যথাচিত আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। আর এ ধরনের দুঃখজনক ঘটনা যাতে দেশের আর কোথাও না ঘটে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন