শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

সীরাত সাহিত্য এবং নারী সমাজের মুক্তিতে এর প্রভাব

ড. মুর্শিদা খানম | প্রকাশের সময় : ৪ আগস্ট, ২০২২, ১২:২৭ এএম

সাহিত্য বলতে সাধারনত কোন লিখিত বিষয়বস্তুকে বুঝায় । সাহিত্য শিল্পের একটি অংশ বলে বিবেচিত হয়। অথবা এমন কোন লেখনী, যেখানে শিল্পের বা বুদ্ধিমত্তার আঁচ পাওয়া যায়, অথবা যা বিশেষ কোন প্রকারে অন্য সাধারন লেখনী থেকে আলাদা। প্রকৃতপক্ষে, ইন্দ্রিয় দ্বারা জাগতিক বা মহাজাগতিক চিন্তা,অনুভূতি, সৌন্দর্য ও শিল্প সম্পর্কে লেখকের বাস্তব জীবনের অনুভূতি হচ্ছে সাহিত্য। ধরন অনুযায়ী যেমন জাতি, ভাষা, অঞ্চলভেদে সাহিত্য ভিন্ন ভিন্ন রকম হয়। কিন্ত একটি অন্তমিল থাকে। সীরাত সাহিত্য বিশ্বের একমাত্র শ্রেষ্ঠ সাহিত্য। সিরাত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর জীবন ঘনিষ্ট সাহিত্য। আল সিরা-আন-নবুবিয়ইয়া শব্দটি মুহাম্মাদ (সাঃ) এর জীবনী চর্চাকেই বোঝায়। ‘সিরাত’ শব্দটি মুহাম্মাদ (সাঃ) এর জীবনী হিসেবে প্রথম ব্যবহার করেন ইবনে শিহাব আল-জহুরী, পরে ইবনে হিশাম এর কাজ দ্বারা এটি পরিচিতি লাভ করে। এটা ছিল ইসলামী সাহিত্যে জগতের ইতিহাসের প্রথম দুই শতাব্দীতে। আরবি প্রমিত সাহিত্যে বা আরবি ভাষায় ‘সীরাত’ শব্দটির বাংলা অর্থ ‘ভ্রমণ করা’ বা ‘ঘুরে আসা’। একজন ব্যক্তির সিরাত হল, সেই ব্যক্তির জীবন বা তার জীবনী। যেখানে তার জন্ম তার জীবনের বিভিন্ন ঘটনা আচার আচরণ বৈশিষ্ট্য এবং তার মৃত্যু। আধুনিককালে এই শব্দটি কোন ব্যক্তির জীবনবৃত্তান্তকেও বোঝায়। কখনও কখনও শব্দটি ‘সীরা’ ‘সীরাহ’ ‘সীরাত’ হিসেবে লেখা হয় যার অর্থ ‘জীবন’ বা ‘যাত্রা’। ইসলামী সাহিত্যের কোথাও কোথাও ‘সিয়ার’ বহুবচন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে যা ‘সিরাহ’ শব্দের বহুবচনরুপ। ‘সিয়ার’ বলতে অমুসলিমদের সাথে যুদ্ধ বিধিকে বোঝানো হয়। ইসলামে আস সিরা-আন-নবুবিয়া (নবীর জীবনী) কিংবা সিরাত আল রসূলুল্লাহ বা আল্লাহর রাসুলের সিরাত বা সিরাত বলতে মুহাম্মাদ (সাঃ) এর জীবনীকে বোঝায়। এই সীরাত সম্পর্কে পবিত্র কুরআন, সহীহ হাদিস মুহাম্মাদ (সাঃ) এর জীবনী এবং ইসলামের প্রাথমিক যুগের বিশ্বাসযোগ্য পন্ডিত ঐতিহাসিকদের দেয়া তথ্য থেকে পাওয়া যায়। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক ও ইবনে হিশাম। ‘সীরা’ বলতে ম্যাগাজি যার আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায় ‘সামরিক অভিযানের গল্প’। এখন যেটাকে ‘সিরাহ’ এর কেবলমাত্র একটি উপ-অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যার দ্বারা মুহাম্মদ (সাঃ) এর সামরিক অভিযানের কাহিনী বুঝায়। ‘সিরাত’ লেখার প্রাথমিক যুগে একটি সিরাত একাধিক ঐতিহাসিক রিপোর্ট বা “আখবার” নিয়ে গঠিত হতো। প্রতিটি রিপোর্ট বা প্রতিবেদনকে ‘খবর’ বলা হতো কখনও কখনও এসবের পরিবর্তে হাদিস শব্দটি ব্যবহারেরও প্রচলন ছিল। ‘সীরাত’ সাহিত্যে বিভিন্ন রকমের বিষয় রয়েছে যা মূলত মুহাম্মদ (সঃ) এর সাহাবীদের দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন সামরিক অভিযানের বিবরণ ছিল। যেখানে থাকতো বিভিন্ন রাজনৈতিক চুক্তি, সামরিক তালিকা, কর্মকর্তাদের নিয়োগ, বিদেশি শাসকদের চিঠিপত্র ইত্যাদি। সীরাত সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য বক্তৃতা, খুতবার মধ্যে ‘বিদায় হজ্বের’ ভাষণ অন্যতম। এছাড়াও বেশ কিছু যুদ্ধের ঘটনা ও যুদ্ধকালীন অনেক কবিতা রয়েছে। পরবর্তীকালে নির্দিষ্ট ধরনের ঘটনা নিয়ে তাদের নিজস্ব পৃথক জগত বিকশিত হয়েছিল। নতুন ঘটনার বৈশিষ্ট্য হলো রাসুলের অলৌকিক ঘটনা যাকে ‘আলাম আল নবুওয়া’ বলে। শাব্দিক অর্থে ‘নবুওয়াতের প্রমাণ’ আরেকটি পর্ব হল ফাদাইল ও ওয়ামাসালিব এমন ঘটনা যা তাঁর সাহাবি, শত্রু এবং তাঁর মানুষদের নিয়ে বলে। কিছু কিছু সীরাতে মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবন কাহিনী ছাড়াও তার মধ্যে পূর্ববর্তী নবী, পারস্য রাজা, প্রাক ইসলামিক আরব উপজাতি এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের ঘটনাও অন্তর্ভুক্ত থাকে। এছাড়াও কুরআনে বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনার আলোকে ‘সীরাত’ গঠিত হয়। এই অংশগুলোই তাফসীর এবং শানে নুযূলের লেখকগণ ব্যবহার করে থাকেন। এপর্যায়ে প্রাথমিক সাহিত্যযুগের পণ্ডিতদের নাম উল্লেখযোগ্য যারা সিরাত ও ম্যাগাজিন রিপোর্ট সংগ্রহ ও সংকলনে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। উরওয়া ইবনুয যুবাইর (মৃত্যু ৭১৩) তিনি উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ান এবং আল ওয়ালিদের নবীর সময়ে ঘটা ঘটনা নিয়ে জানতে চাওয়া চিঠির জবাব লিখতেন। ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বিহ (মৃত্যু ৭২৫ থেকে ৭৩৭) বেশ কয়েকটি বই তিনি লিখেছিলেন তার সেগুলির কোনটি এখন আর বিদ্যমান নেই। ইবনে হিশাম আল-জহুরি (মৃত্যু ৭৩৭) সাহিত্যের একটি কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি হাদিস, আখবর উভয়ই সংরক্ষণ করেছিলেন। তার আখবরেও বর্ণনার শিকল বা ইসনাদ রয়েছে। তাকে উমাইয়া আদালত পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে দুটি বই লিখতে বলেছিলেন। একটি বংশপরিচয় বিদ্যা নিয়ে অন্যটি ম্যাগাজি নিয়ে। উল্লেখ্য যে, ম্যাগাজি সম্পর্কিত বইটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। আল জুহরীর ছাত্র মুসা ইবনে উকবা কিতাব আল ম্যাগাজি লিখেছিলেন। এই বইটি তার ছাত্রদের পড়ানোর কাজে ব্যবহত হতো; তা বর্তমানে নেই হারিয়ে গেছে। কিছু অংশ পাওয়া গেছে বলে দাবি করা হলেও তা নিয়ে মতভেদ আছে। মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক (মৃত্যু ৭৬৭ বা ৭৬১); আল জুহরির আরেক শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। যিনি মৌখিক বর্ণনা সংগ্রহ করেছিলেন যা নবীজির জীবনের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি তৈরি করেছিলেন। তার বর্ণনা বিশেষত ইবনে হিশাম এবং ইবনে জাবির আল-তাবারি সংরক্ষণ করেছিলেন। ইবনে জুরাইজকে (মৃত্যু ১৫০) ইবনে ইসহাকের ‘সমসাময়িক’ এবং মক্কাভিত্তিক কর্তৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচনা করা হতো। যাই হোক, বিশ্বের বিস্ময় নবী ও রাসূলদের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূলগণের শিরোমনি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। যার গুনকীর্তনে বিভিন্ন ধর্মের মানুষেরা পঞ্চমুখ। যাকে কালো যুগে অর্থাৎ অন্ধকার যুগের কাফের-মুশরিকগণও ‘আলামিন’ বলে জানতেন। সর্বযুগে মানুষটাকে “মহাসত্যবাদী” ও ‘পরম বিশ্বাসী’ বলে আখ্যায়িত করতে কোনরূপ কুন্ঠাবোধ করেনি। যে বছর ‘আমুল ফিল’ অর্থাৎ হস্তী বাহিনী নিয়ে আবরাহা কাবা অভিযানের ঘটনা যে বছর ঘটে সেই বছরের রবিউল আউয়াল মাসের দ্বাদশ রজনী অতিক্রান্ত হবার শুভ মুহূর্তে সোমবারে নবী (সাঃ) জন্মগ্রহণ করেন। কায়েস ইবনে মাখরামা বর্ণিত তিনি বলেন, “আমি ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু সাল্লাম আবরাহার হামলার বছর জন্মগ্রহণ করি। তাই আমরা সমবয়সী”। হাসসান সাবিত বলেন, ‘‘আমি তখন সাত-আট বছরের বালক হলেও বেশ শক্তিশালী ও লম্বা হয়ে উঠেছি। যা শুনতাম তা বুঝতে পারার ক্ষমতা তখন হয়েছে। হঠাৎ শুনতে পেলাম জনৈক ইহুদি ইয়াসরিবের (মদিনার) একটা দুর্গের ওপর উঠে উচ্চ স্বরে বলল, ওহে ইহুদি সমাজ বলে চিৎকার করে উঠল। লোকেরা তার চারপাশে জমায়েত হয়ে বললো, “তোমার কি হয়েছে?” সে বলল, আজ রাতে আহমদ এর জন্মের সেই নক্ষত্র উদিত হয়েছে। অতঃপর মোহাম্মদ (সাঃ) ভূমিষ্ঠ হলে তার মা আমিনা দাদা আবদুল মুত্তালিব এর নিকট এই বলে খবর পাঠান যে আপনার এক পৌত্র জন্মেছে “আসুন, তাকে দেখুন”। আব্দুল মুত্তালিব এসে তাঁকে দেখলেন। এই সময়ে আমিনা তার গর্ভকালীন সময়ের দেখা স্বপ্নের কথা নবজাতক সম্পর্কে যা তাকে বলা হয়েছে এবং তার নাম যেটা রাখতে বলা হয়েছে তা সবকিছুই তাঁকে জানালেন। আব্দুল মুত্তালিব তাঁকে নিয়ে কাবা শরীফে প্রবেশ করলেন সেখানে তিনি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। অতঃপর তাঁকে নিয়ে কাবা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন এবং শিশুটিকে মায়ের কাছে নিয়ে গিয়ে ধাত্রীর সন্ধান করতে লাগলেন। অবশেষে, বনু সা’দ ইবনে বাকরের আবু সুয়াইবের কন্যা ‘হালিমা’ নামক এক মহিলাকে ধাত্রী হিসেবে পাওয়া যায়। বিশ্বমানবতা তথা বিশ্বসমাজের মুক্তির দূত বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে আল্লাহতাআলা পৃথিবীতে শান্তির বার্তা দিয়ে পাঠিয়েছেন তিনি পরিবার সমাজ ও গোটা পৃথিবীর সর্বস্তরে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন চেষ্টা করে গেছেন। এক্ষেত্রে তিনি শতভাগ সফলও হয়েছেন। ওহুদ যুদ্ধের পর ইসলামী আন্দোলনের জন্য বাইরের সংঘাত কি পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল? তা খন্দক যুদ্ধ এবং তার পরবর্তী ঘটনা বলি থেকে তা সহজেই আন্দাজ করা যায়। এটি ছিল অত্যন্ত সংঘাতকালীন সময়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইসলামী আন্দোলনের মহানায়ক হিসেবে তিনি যেমন দৃঢ়তার সাথে সমস্ত ঘটনাগুলো মোকাবেলা করেছেন, তেমনি একজন সুদক্ষ নৈতিক শিক্ষক হিসেবে ইসলামের অগ্রসেনাদের যথোচিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি ইসলামী সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় আইন কানুন, নিয়ম-বিধি সম্পর্কেও লোকদেরকে ক্রমাগত শিক্ষা দান করেছিলেন। এটা স্পষ্টত অনুমান করা যায়, এ সময়ে অবতীর্ণ দুটি গুরুত্বপূর্ণ সূরা নিসা ও সুরা মায়েদা অধ্যয়ন থেকে। আল্লাহপাকের কাছে নারী-পুরুষের মর্যাদা আলাদা নয়। (চলবে)

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন