শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

সীরাত সাহিত্য এবং নারী সমাজের মুক্তিতে এর প্রভাব

ড. মুর্শিদা খানম | প্রকাশের সময় : ১১ আগস্ট, ২০২২, ১২:০০ এএম

পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন বলেছেনঃ- “অতঃপর তাদের পালনকর্তা তাদের দোয়া (এই বলে) কবুল করে নিলেন যে, নিশ্চয় আমি তোমাদের কোনো পরিশ্রমকারীর পরিশ্রমই বিনষ্ট করি না। তা সে পুরুষ হোক কিংবা নারী। তোমরা পরস্পরে এক”(সূরা আল ইমরান আয়াত নম্বর ১৯৫) এ আয়াত থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, আমলের দিক থেকে সৃষ্টিকর্তার কাছে সবাই সমান। সে পুরুষ হোক বা নারী হোক। আমাদের সমাজে আমরা এখন দেখছি নৈতিক অবক্ষয় মূল্যবোধের অভাব অনাচার জেঁকে বসেছে। নারী নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছে। সর্বত্র নারীরা লাঞ্চিত হচ্ছে। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় নিত্য নতুন নারী লাঞ্চনার খবর আসে। অথচ ইসলাম একজন নারীকে এত উচ্চ মর্যাদা দান করেছে, তা সমাজবিজ্ঞানীরা ভুলতে বসেছে। পাশ্চাত্যের পণ্ডিতদের মুক্ত থিওরী আর ফ্যাশন সমাজের নারীসহ সকলের স্মার্টনেস হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ বর্তমান নারী শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকলের প্রতি যে অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে তা, জাহেলিয়াতকেও হার মানায়। জাহিলি যুগের পিতা কর্তৃক আপন কন্যা ধর্ষনের তথ্য নেই। এখন এমন ঘটনাসহ দড়ি বেঁধে প্রকাশ্যে নারীর উপর নির্যাতন এখন সমাজে অহরহ দৃশ্যমান। আমরা যদি একটু চিন্তা করে দেখি যে, ইসলামের আগমনের পূর্বে নারীর সম্ভ্রম এর মর্যাদা ছিল না। নারী-পুরুষ অবাধে মেলামেশা করতো। রাতের বেলায় নারীরা মদ, গান-বাদ্যের মহোৎসব করতো।

সে যুগে কন্যা সন্তানের জন্মকে তারা অমর্যাদাকর মনে করত, লজ্জাষ্কর মনে করতো। তাদের সমাজেও পরিবারে কোনো অধিকার ছিল না। কিন্তু পৃথিবীতে মানবতার মুক্তিদূত নবীকুল শিরোমনি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু সালামের আগমন ঘটে। তখন থেকেই নারীরা তাদের যথাযোগ্য চিরসম্মান ও চিরমর্যাদা লাভ করে। নারীদের প্রতি উত্তম আচরণ এর ব্যাপারে রাসূল সাল্লাহু সাল্লাম বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখতেন। তিনিই সর্বপ্রথম নারীর উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে, কোরআনুল কারিমের মাঝেই পুরুষের সঙ্গে নারীদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল। একইভাবে নারীদের মধ্যে মা, স্ত্রী-কন্যাদের তাদের স্বামীর সম্পত্তির এবং বিশেষ অবস্থায় বোনদের ভাইয়ের সম্পত্তির উত্তরাধিকার সাব্যস্ত করা হয়েছে। ইসলামের আগমনের আগে পৃথিবীর বুকে আর কোনো ধর্মই এভাবে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেনি। একইভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম নারীদের স্বামীর সম্পদের মালিকানা দান করেছেন। স্বামীর অধিকার নেই যে স্বামী হওয়ার কারণে সে তার স্ত্রীর সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করতে পারবে। নারী তার সম্পদ খরচ করার ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা রাখে। নারীর আবেগ, অনুভূতির প্রতিও তিনি যথেষ্ট খেয়াল রাখতেন। একবার নবী (সাঃ) নামাজ পড়াবার সময় একটি বাচ্চার কান্না শুনতে পেলেন, এজন্য নামাজ পড়ানো তিনি তাড়াতাড়ি শেষ করেছিলেন। তারপর, বললেন, একটি বাচ্চা কাঁদছিল। আমার মনে, হল ওর মায়ের মনে কষ্ট হচ্ছে। কাজেই, আমি তাড়াতাড়ি নামাজ শেষ করলাম যাতে বাচ্চার মা তার খবর নিতে পারে। রাসুল (সাঃ) যখন কোন সফরে যেতেন তখন নারীরাও সঙ্গে থাকতেন। যার ফলে, সবাইকে তিনি ধীরে ধীরে চলতে বলতেন। একবার এরকম অবস্থায় যখন সৈনিকরা তাদের ঘোড়া ও উটগুলিকে লাগাম ঢিলা করে দিয়ে জোরে তাড়া করতে করতে শুরু করল। তখন তিনি বললেন আরে তোমরা করছ কি? করছ কি? কাঁচের প্রতি খেয়াল রেখো? কাঁচের প্রতি খেয়াল রেখো? অর্থাৎ করছো কি? এখানে নারীরাও সঙ্গে সঙ্গে আছে তো! তোমরা যদি এভাবে উঠে গিয়ে তাড়াতে থাকো তাহলে তো ওই কাচগুলি ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে। (সহীহ বুখারী) একবার এক যুদ্ধের ময়দানে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ার কারণে ঘোড়াগুলোকে কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছিল না। এমনকি রাসুল (সাঃ) পর্যন্ত ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়েছিলেন, অনেক নারী পরে গিয়েছিলেন। এ সময় একজন সাহাবী পিছন থেকে রাসুল (সাঃ) কে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলেন। রাসুল সাঃ এর পা তখন রেকাবের মধ্যে আটকে ছিল এবং তিনি ঝুলন্ত অবস্থায় ছিলেন। তিনি তাড়াতাড়ি নিজের পা ছাড়িয়ে নিজেকে মুক্ত করলেন এবং ওই সাহাবী কে লক্ষ্য করে বললেন, “আমাকে ছাড়ো ওই দিকে নারীদের দিকে যাও”। এছাড়াও রাসুল সালাম এর ওফাতের সময় ঘনিয়ে এলে তিনি সব মুসলমানদের সমবেত করে যে সব ওসিয়ত করেছিলেন তার মধ্যে একটি উপদেশ ছিল। এরকম যে, আমি তোমাদের সাথে আমার এই শেষ ওসিয়ত করছি যে, “নারীদের সঙ্গে যেন সর্বদা উত্তম আচরণ করা হয়”। তিনি প্রায় সময় বলতেন, “যার ঘরে মেয়েরা আছে এবং সে তাদের লেখাপড়া শেখায় এবং ভালোভাবে তরবিয়ত করে। কেয়ামতের দিন আল্লাহ তা'আলা তার জন্য জাহান্নামের আগুন হারাম করে দিবেন”। (তিরমিযী) সাধারণ আরবদের মধ্যে এটি রেওয়াজ ছিল যে, নারীরা যদি কোন ভূল-ত্রূটি করত, তবে তাদেরকে মারধর করা হতো। রাসুল (সাঃ) যখন এ বিষয়ে জানতে পারলেন, তখন তিনি বললেন, “নারীরা আল্লাহ তায়ালার দাসি”। তোমাদের নয়, তাদেরকে কখনোই মারধর করবে না। তিনি আরো বলেন, যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে না কিংবা তাকে মারধর করে তার সম্পর্কে আমি তোমাদেরকে বলে দিচ্ছি যে, সে আল্লাহর দৃষ্টিতে সৎ বলে বিবেচিত হবে না। এ ঘোষণার পর নারীর অধিকার রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যে, রাসূল (সাঃ) এর অনুগ্রহে প্রথমবারের মতো নারী'রা স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করে। (আবু দাউদ) । হযরত মাবিয়া আল কুশাইরি (রাঃ) বলেছেন, আমি রাসুল সালাম কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের স্ত্রীর অধিকার কি? বলুন। তিনি বললেন, “আল্লাহ তোমাকে যা খেতে দিয়েছেন তা থেকে তুমি তাকে খেতে দাও, আল্লাহ তোমাকে যা পরতে দিয়েছেন তা থেকে তুমি তাকে পরতে দাও। তুমি তাকে ঘর থেকে বের করে দিও না। (আবু দাউদ)
সুতরাং স্পষ্টতই সকলের অনুধাবনযোগ্য যে ইসলাম এমনই এক জীবন ব্যবস্থা যার নারী-পুরুষ প্রত্যেকের অধিকার খুব সুন্দর ভাবে সংরক্ষণ করে এবং একটি সুন্দর সমাজ গঠনে নারী-পুরষ উভয়ের অবদান রাখার বিষয়টি ঘোষণা করে।
পরিশেষে, স্বীকার করতেই হবে যে রাসুল (সাঃ) নারীর যে মর্যাদা, অধিকার ও সম্মান প্রতিষ্ঠা করেছেন তা বিরল। পৃথিবীর বুকে এর চেয়ে বড় ইনসাফ কোনোদিনও অন্য কোন ধর্ম বা পাণ্ডিত্যের মাঝে আসতে পারে না। মহান আল্লাহ তায়ালা সেই মহান পুরুষ নবী (সাঃ) এর প্রতি আনুগত্যে অটল থাকার এবং তার প্রতিষ্ঠিত নারীর মর্যাদা উপলব্ধি করার এবং সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করার তৌফিক আমাদেরকে দান করুন আমিন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন