ইউরোপের গ্রীষ্ম ক্রমেই একটি অপ্রত্যাশিত চ্যালেঞ্জ পরিণত হচ্ছে। আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে তৈরি অদ্ভুত প্রখর তাপ কয়েক সপ্তাহ ধরে মহাদেশটি ঝলসে দিচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে চরম জ্বালানি ঘাটতিতে ভুগছে সমগ্র ইউরোপ। রাশিয়ান গ্যাসের সরবরাহ ছাড়া কীভাবে বাসস্থান ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে উষ্ণ ও চালু রাখা যায় তা নিয়ে ভাবছে।
এরমধ্যে গ্রীষ্মের প্রচন্ড খরতাপে ইউরোপের নদীগুলোর নাব্যতা সঙ্কট আরও বড় বিপদ ডেকে এনেছে। ইউরোপ জুড়ে খরা এখন একসময়ের প্রমত্তা নদীগুলোর পানি প্রবাহ কমিয়ে দিয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে শিল্প, পণ্য পরিবহন, বিদ্যুৎ ও খাদ্য উৎপাদনে। ইউরোপের ৬০ শতাংশ অঞ্চল এখন চরম খরা কবলিত। ইইউয়ের বাইরে যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপ মহাদেশের প্রায় অর্ধেক খরার প্রভাবে ভুগছে।
দাবানল ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি কমছে নদীর পানির স্তর। ফলে, কৃষি উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে এবং ব্যাহত হচ্ছে নৌচলাচল। প্রয়োজনীয় গভীরতার অভাবে পণ্যবাহী নৌযান ও ফেরি চলাচল বন্ধ হতে বসেছে। প্রচন্ড তাপে জনজীবন ওষ্ঠাগত হওয়ার সাথে সাথে ঝুঁকিতে পড়েছে জীববৈচিত্র্যও। ইউরোপীয় কমিশনের যৌথ গবেষণা কেন্দ্র সম্প্রতি সতর্ক করে বলেছে যে, ইউরোপের এবারের খরা গত ৫০০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক হতে পারে।
ইউরোপের আবহওয়ার বৈরি পরিবর্তনের ওপর নজর রাখার জন্য অর্থনীতিবিদরা আবহাওয়াবিদদের সাথে যোগ দিয়েছেন। ইতোমধ্যেই ইউরোপের প্রধান শিল্প উপত্যকায় গাড়ির যন্ত্রাংশ থেকে রাসায়নিক পদার্থ পর্যন্ত সমস্ত পণ্য বহনকারী জাহাজগুলোকে নদীর তলদেশের ধারালো আচড় এড়াতে অর্ধেক বা তার কম বোঝা নিয়ে ভ্রমণ করতে হচ্ছে। সামনের বছরগুলোতে পানির স্তরের আরও অনিবার্য হ্রাস অগ্রগতির নদীগুলোকে চলাচলের অযোগ্য করে তুলবে। এতে, হুমকির মুখে পড়েছে ইউরোপের জ্বালানি-শস্যসহ অন্যান্য বাণিজ্য।
সুইসজারল্যান্ডের কৃষকরা দুধের উৎপাদন হ্রাসের কারণে দুগ্ধজাত পণ্যের ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। ইউক্রেন তার সঞ্চিত শস্য বিক্রি শুরু করলেও সামনের বছর শস্য ঘাটতি দেখা দেবে, যা বিশ^কে খাদ্য সঙ্কট, পণ্যের উচ্চমূল্য, বাণিজ্য ঘাটতি এবং মুদ্রাস্ফীতির দিকে ঠেলে দেবে। নরওয়ে তার জলাশয়গুলোর নিম্ন স্তরের জন্য শঙ্কিত। দেশটি সতর্ক করেছ যে, এটি জার্মানির মতো দেশে জলবিদ্যুতের রফতানি কমিয়ে দিতে পারে। ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতির শক্তি সঙ্কট কয়লা পোড়ানোর মাধ্যমে প্রতিকার করা যেতে পারে যদি কেবলমাত্র পণ্যবাহী জাহাজগুলো রাইন নদীতে চলাচল করতে পারে। কিন্তু, নৌ চলাচলের অনুপযোগী হয়ে উঠছে কয়েকশ বছর ধরে জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও সুইজারল্যান্ডের অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ হ্রাইন নদী।
প্রায় ৮০০ মাইল দীর্ঘ হ্রাইন সুইজারল্যান্ডের পার্বত্য এলাকায় উৎপত্তি হয়ে অন্তত ইউরোপের ৬টি দেশের ভেতর দিয়ে দিয়ে উত্তর সাগরে গিয়ে পড়েছে। খরার কারণে পানির তাপমাত্রা বাড়ায় হ্রাইনের পোল্যান্ড ও জার্মানির অংশে পানির তাপমাত্রা অতিরিক্ত বাড়ার কারণে জুলাইয়ে শেষ দিকে কয়েক টন মাছের মৃত্যু ঘটেছে। দেশটির কোলোন শহরে একটি জনপ্রিয় ভাসমান রেস্তোঁরা এখন মাটিতে গিয়ে ঠেকেছে। কাউব শহরের প্রায় ২০ কিলোমিটার উজানে চর জেগে উঠেছে। জার্মানির পরিবেশমন্ত্রী স্টেফি লেমকি পরিস্থিতিকে বিপর্যয়কর আখ্যা দিয়ে বলেছেন যে, একটি পরিবেশগত বিপর্যয় সন্নিকটে।
জুলাইতে ফ্রান্স জুড়ে এক সেন্টিমিটারেরও কম বৃষ্টিপাত হয়েছে, যা ছয় দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে যেকোনো মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। ফ্রান্সের দীর্ঘতম নদী লয়ারের কিছু জায়গায় এখন পায়ে হেঁটে পার হওয়া যায়। মধ্য ইউরোপের সঙ্গে কৃষ্ণসাগরের সংযোগ ঘটানো বুলগেরিয়া, রোমানিয়া ও সার্বিয়ায় দানিউব নদীতে জরুরি ভিত্তিতে খনন করে নাব্যতা ধরে রাখতে হচ্ছে।
চ্যানেলগুলো উন্মুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য জাহাজ। ইতালির উত্তর-পশ্চিমা থেকে ভেনিসের দিকে প্রবাহিত দেশটির দীর্ঘতম নদী পো’র প্রবাহ এখন স্বাভাবিকের চেয়ে দুই মিটার কম। দেশটির মোট কৃষি উৎপাদনের প্রায় ৩০ শতাংশই হয় পো’র উপত্যকায়। এর পানির স্তর ৭০ বছরের ইতিহাসে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে যাওয়ায় ওই অঞ্চলে ভুট্টা, সূর্যমুখীসহ সব ধরনের শস্য উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষয় ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ইউরোস্ট্যাটের পরিসংখ্যান অনুসারে, ইউরোপের নদী ও খালগুলো সেখানকার প্রত্যেক বাসিন্দার জন্য বছরে অন্তত এক টন মালামাল পরিবহন করে, যা এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে প্রায় ৮ হাজার কোটি মার্কিন ডলার অবদান রাখে। ২০১৮ সালে হ্রাইনে ট্রানজিট সমস্যার কারণে ৫১০ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়েছিল ইউরোপের। কিন্তু এ বছর ক্ষতি আরও গুরুতর হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ইউরোপের নৌচলাচাল ব্যাহত হলে এর স্থলপথ দীর্ঘস্থায়ী যানজটের সম্মুখীন হবে এবং এই চাপ সরিয়ে নেওয়া সহজ নয়। একটি গড়পরতা জাহাজের সমান মালামাল পরিবহনে ১১০টির বেশি ট্রাকের প্রয়োজন, যেগুলোর সুদীর্ঘ লাইন এবং করোনা জনিত মৃত্যু ও রাশিয়া-ইউত্রেন যুদ্ধে সৃষ্ট লোকবল সমস্যার কারণে আরও গুরুতর হবে।
আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে ইউরোপে তৈরি হয়েছে আরও নানা সমস্যা। আন্তর্জাতিক বাজারে জ¦ালানির দাম ঊর্ধ্বমুখী। সুইজারল্যান্ডে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ২০১৭ সালের পর এবার সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। ঘাটতি মেটাতে জ্বালানির মজুত ব্যবহার করতে হচ্ছে দেশটিকে। একই কারণে নেদারল্যান্ডসে ফেরি চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। এতে বেশ কিছু এলাকায় যান চলাচলে বিপত্তি দেখা দিয়েছে।
ইতিহাসের ভয়াবহতম খরার কারণে ফ্রান্সের বেশিরভাগ অংশে পানি ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছে। রোন ও গ্যারোন নদীর পানির তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় তা দিয়ে পারমাণবিক চুল্লিগুলো যথেষ্ট শীতল করতে পারছে না ফ্রান্স। এতে দেশটিতে বৈদ্যুতিক সঙ্কট আরও বেড়ে গেছে।
তারওপর, রাশিয়া থেকে জ¦ালানি আমদানি ও নাব্যতা সঙ্কটের কারণে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে আসন্ন শীতে ইউরোপের বিদ্যুৎ উৎপাদন সন্দেহাতীতভাবে ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়বে। ইউরোপের অর্থনীতি ও ইতিহাস তার নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া, উর্বর মাটি এবং প্রথম মহাসড়ক ও জলপথ ছাড়া সম্পূর্ণ নয়। তবে আবহাওয়ার কঠোর পরিবর্তনের কারণে সমৃদ্ধ মহাদেশটির সৌভাগ্য হয়তো বেশিদিন স্থায়ী হবে না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
ishrat.dana@yahoo.com.
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন