ক’দিন বাদেই সবার প্রিয় এই ইয়াহিয়া ভাই ছেড়ে যাবেন প্রিয় কর্মস্থল বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। এখানকার প্রশাসকের দায়িত্বে আর তাকে দেখা যাবে না। সবুজ মাঠের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে আগামী ১০ জানুয়ারি তিনি অবসরে যাচ্ছেন। প্রায় একমাস পরেই তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের অবসান ঘটলেও দেশের ক্রীড়াবোদ্ধাদের দাবি, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে সরকার যেন আরও কিছুদিন ইয়াহিয়াকে ক্রীড়াঙ্গনের সেবাদানের সুযোগ করে দেন। এ প্রসঙ্গে ইয়াহিয়ার কথা, ‘দীর্ঘদিন ধরে এখানে কাজ করছি, ছেড়ে যেতে তো খারাপ লাগবেই। কিছুই করার নেই, আস্তে আস্তে মানিয়ে নিতে হবে। এরই নাম জীবন।
জাহেদ খোকন
মো. ইয়াহিয়া। সাবেক ক্রীড়াবিদ ও সনদপ্রাপ্ত অ্যাথলেটিক কোচ। বর্তমানে দেশের স্বনামধন্য ক্রীড়া স্থাপনা বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের প্রশাসক। মাঠই যার আপন ঠিকানা। ঝড়, বৃষ্টি, বাদল, ঈদের ছুটি কিংবা শরীরিক অসুস্থতা- কোন কিছুই তাকে আটকে রাখতে পারেনা ঘরে। ছুটে আসেন প্রিয় কর্মক্ষেত্র বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। নিজ অফিস কক্ষে কাজের ফাঁকে বিচরণ করে বেড়ান এই স্টেডিয়ামের সবুজ মাঠে। যেন আপন মনেই কথা বলে যান ঘাসের সঙ্গে। ক্রীড়াপাগল এই মানুষটি খেলাধুলার পাশাপাশি মাঠকে এতটাই ভালোবাসেন যেন মাঠের সঙ্গে তার গড়ে ওঠেছে আতœীক সম্পর্ক। দিনের পর দিন মাঠে থাকতে থাকতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন মাঠ বিশেষজ্ঞ হিসেবে। মাঠের সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক প্রায় ৪০ বছর ধরে। সন্দেহতীতভাবেই তিনি একজন মাঠের মানুষ। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটি ক্রীড়া সাংবাদিকদের কাছে পরিচিত ‘ইয়াহিয়া ভাই’ নামে। তাঁর অফিসে গেলে কারোরই যেন খালি মুখে ফেরার উপায় নেই। অতিথিপরায়ন, প্রাণখোলা, রসিক, মিশুক, সদাহাস্যোজ্জ্বল ইয়াহিয়া ভাইয়ের অফিসটা যেন নিত্য দিনে কাজের ফাঁকে হয়ে ওঠে জম্পেশ এক আড্ডাখানা। দুপুরে তাঁর অফিসে গেলে জোর করে খাইয়ে দেবেন ভাত, জানতে চাইবেন সবার পরিবারের কুশল। ক্রীড়াঙ্গন নিয়ে নানা স্মৃতিচারণ আর আলাপচারিতার মাঝে কাটিয়ে দেবেন বেশ কিছুটা সময়। এতে সমৃদ্ধ হয় ক্রীড়া সাংবাদিকদের জ্ঞানের ভা-ার।
ক’দিন বাদেই সবার প্রিয় এই ইয়াহিয়া ভাই ছেড়ে যাবেন প্রিয় কর্মস্থল বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। এখানকার প্রশাসকের দায়িত্বে আর তাকে দেখা যাবে না। সবুজ মাঠের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে আগামী ১০ জানুয়ারি তিনি অবসরে যাচ্ছেন। প্রায় একমাস পরেই তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের অবসান ঘটলেও দেশের ক্রীড়াবোদ্ধাদের দাবি, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে সরকার যেন আরও কিছুদিন ইয়াহিয়াকে ক্রীড়াঙ্গনের সেবাদানের সুযোগ করে দেন। এ প্রসঙ্গে ইয়াহিয়ার কথা, ‘দীর্ঘদিন ধরে এখানে কাজ করছি, ছেড়ে যেতে তো খারাপ লাগবেই। কিছুই করার নেই, আস্তে আস্তে মানিয়ে নিতে হবে। এরই নাম জীবন। তবে সরকার যদি আমাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে ক্রীড়াঙ্গনের সেবা করার সুযোগ দেন, তাহলে আমি তা সানন্দে গ্রহণ করবো। আমি আমৃত্যুই কাজ করে যেতে চাই।’
অর্থনৈতিকভাবে দেশ যেমন সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তেমনি দেশের ক্রীড়াঙ্গনও এগোচ্ছে বলে ধারনা ইয়াহিয়ার। ‘যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেশজুড়ে যেভাবে ট্যালেন্ট হান্ট করা হচ্ছে, তা অবশ্যই প্রশংসনীয়’- এক নাগাড়ে বলে যান তিনি। ‘আমি মনে করি সারাদেশে বিভিন্ন ক্রীড়া ডিসিপ্লিনে অনেক মেধাবী (ছেলে-মেয়ে) অ্যাথলেট রয়েছে। তারা যদি সঠিক প্রশিক্ষণ পায়, তাহলে তাদের মাধ্যমে বাংলাদেশ অ্যাথলেটিক্সে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের হারানো গৌরব ফিরে পাবে, বিশেষ করে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে। দেশের সার্বিক ক্রীড়াঙ্গন নিয়ে আমি অনেক আশাবাদী। সেই সঙ্গে আশাকরি সহসাই অ্যাথলেটিক্সসহ অন্য খেলায় দেশের শিক্ষিত ছেলে-মেয়েরা এগিয়ে আসবে।’
ক্রীড়াঙ্গনের সেবা করার পাশাপাশি ইয়াহিয়া দীর্ঘদিন ধরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ও আত্মমানবতার কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ মো. মোস্তফা কামাল ফাউন্ডেশন। রাজধানীর মুরাদপুরে সামাজিক উন্নয়নমূলক এই প্রতিষ্ঠানের অফিস। এর সহ-সভাপতির দায়িত্বে আছন তিনি। যার প্রতিষ্ঠাতা শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের মা মালেকা বেগম। আর কামালের ছোট ভাই মোস্তাফিজুর রহমান হচ্ছেন সভাপতি। এই ফাউন্ডেশনের কাজ হচ্ছে ক্রীড়াঙ্গন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, গরিব-দুস্থদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করা, ছিন্নমূল শিশু ও গর্ভকালীন মায়েদের সেবা দান, বৃক্ষরোপণ ও আবাসহীন অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসন সমস্যার সমাধান করা।
এক সময়ের তারকা ক্রীড়াবিদ ও অ্যাথলেটিক কোচ মো. ইয়াহিয়ার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলায়। তিনি ১৯৫৮ সালের ৯ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মো. ইব্রাহিম ছিলেন পুলিশের এসবিতে। মায়ের নাম মেহেরুন নেসা। দুজনেই মারা গেছেন। চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে ইয়াহিয়া দ্বিতীয়। স্ত্রী কামরুন নাহার বকুল একজন গৃহিণী। দুই সন্তানের জনক এই ক্রীড়া পাগল মানুষটির বর্তমান নিবাস ধানমন্ডি। তাঁর একমাত্র ছেলে এএসএম কায়েস ব্যাংক কর্মকর্তা ও মেয়ে ইফফাত সুরাইয়া পরমা বিবিএ ফাইনাল পরীক্ষার্থী। ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে ইয়াহিয়ার শিক্ষাজীবন শুরু হলে সেখানেই তিনি ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। এরপর বাবার চাকরির বদলির সুবাদে চলে যান টাঙ্গাইলে। ওখানেই বেড়ে ওঠা। ১৯৭৩ সালে টাঙ্গাইল বিন্দুবাসিনী স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। ১৯৭৫ সালে সাদত কলেজ থেকে পাস করেন এইচএসসি। তারপর ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সেখান থেকেই উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। কলেজে পড়ার সময় ইয়াহিয়া ইন্টার কলেজ অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হন ১০০, ২০০ ও ৪০০ মিটার স্প্রিন্টে। ওই সময়ে তিনি টাঙ্গাইল জেলা দলের হয়ে বেশ কিছুদিন ফুটবলও খেলেন। উইঙ্গার এবং ফরোয়ার্ড পজিশনে তার নামডাক ছিলো সেই সময়। ঢাকায় এসে ‘৭৫ সালেই অভিযাত্রিক মালিবাগ ক্লাবের হয়ে তৃতীয় বিভাগ ফুটবল লিগে খেলেন। পরের বছর যোগ দেন দ্বিতীয় বিভাগের দল শান্তিনগর স্পোর্টিং ক্লাবে। সেবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে শান্তিনগর প্রথম বিভাগে ওঠে। এই ক্লাবে চার বছর খেলার পর আশির দশকের শুরুর দিকে যোগ দেন ইস্ট অ্যান্ড ক্লাবে। ওখানে এক বছর খেলে চলে যান ফরাশগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাবে।
ওই সময় তিনি মাস্টার্স পরীক্ষা দেন। বৃত্তিও পান। তখনকার একটা ঘটনা বদলে দেয় তার জীবনের গতিপথ। সেই স্মৃতিচারণ করেন ইয়াহিয়া, ‘তখন আমার এক জুনিয়র রুমমেট ছিল। নাম সত্যজিৎ সাহা। খুব ভাল ছেলে। আমাকে সব বিষয়ে অনেক সাহায্য করত। সে বলল, “একটা স্কলারশিপ পাওয়ার সুযোগ আছে। আপনি আবেদন করুন।” আমি ছিলাম অস্থির-চঞ্চল প্রকৃতির। বললাম, “আমার আগ্রহ নেই, তুমিই বরং আবেদন কর। সে বলল, “আমি সবকিছু ফিলাপ করে দিচ্ছি, আপনি শুধু স্বাক্ষর করুন”। বাধ্য হয়ে তাই করলাম। দরখাস্ত জমা দিলাম। আশ্চর্য, স্কলারশিপ পেয়েও গেলাম! গেলাম ভারতের পাতিয়ালায়, দশ মাসের কোর্স করতে। তখন সেখানে এশিয়ান গেমস হচ্ছিল। সেখানে আবার ইন্টারম্যুরাল গেমস হয়। তাতে অংশ নিয়ে আমি শ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদ হিসেবে নির্বাচিত হই। এটা বাংলাদেশের জন্য বিশাল গৌরবের ব্যাপার ছিল সে সময়।’ এরপর এ্যাথলেটিক্সের ওপর বিভিন্ন দেশে গিয়ে পরে আরও ৫টি ডিপ্লোমা এবং উচ্চতর কোর্স করেছেন ইয়াহিয়া। ১৯৮৩ সালে পাতিয়ালা থেকে ঢাকায় ফিরে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। তাঁর প্রথম চাকরি ঢাকা বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থায়। সংস্থাটির তখন কোন নিজস্ব মাঠ ছিল না। কেবলমাত্র জমি দখল করেছে মিরপুর স্টেডিয়ামে। মাঠ তৈরি সংক্রান্ত কাজের দায়িত্ব ছিল ইয়াহিয়ার ওপর। দক্ষতার সঙ্গে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত সেখানে কাজ করেন তিনি।
তারপর ১৯৯০-৯১ সালে চলে আসেন সাভারের বিকেএসপিতে, অ্যাথলেট কোচ হিসেবে। তখন সেখানে কোচের স্বল্পতা ছিল। এর পাশাপাশি শফিপুর আনসার একাডেমিতেও কাজ করেন। এ প্রসঙ্গে ইয়াহিয়া বলেন, ‘তখন আমি মানসম্পন্ন অ্যাথলেট তৈরির জন্য ‘ট্রায়াল এ্যান্ড এরর’ থিওরি নিয়ে কাজ শুরু করি। ভারতে গিয়ে পিটি ঊষা ও নাভজিৎ সিংয়ের মতো খ্যাতনামা অ্যাথলেটদের খুব কাছ থেকে ট্রেনিং করতে দেখেছি। গভীরভাবে তাঁদের পর্যবেক্ষণ করেছি। তখন তাদের অনুশীলনের সব খুঁটিনাটি খাতায় লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলাম। সেটাই বাংলাদেশে এসে অ্যাথলেট তৈরিতে প্রয়োগ করার চেষ্টা করি। সেই চেষ্টার ফসলও পাই। নিজের হাতে সফলভাবে গড়ে তুলি বিমল চন্দ্র তরফদার এবং মাহবুব আলমকে। ঢাকায় অনুষ্ঠিত ১৯৯৩ এসএ গেমসে বাংলাদেশ এ্যাথলেটিক্সের কোন ইভেন্টেই স্বর্ণ পাচ্ছিল না। শেষ ভরসা ছিল ১০০ মিটার স্প্রিন্ট। তাতে অংশ নিয়ে বিমল দ্রুততম মানবের খেতাব জিতে দেশের মুখ উজ্জ্বল করে। এরপর থেকেই বাংলাদেশ জাতীয় অ্যাথলেটিক্স দলের সঙ্গে ওঁৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ি।’ ১৯৯৩-২০০১ সাল পর্যন্ত মিরপুর স্টেডিয়ামের প্রশাসক ও অ্যাথলেট কোচ হিসেবে কাজ করেন। এছাড়া কোচ হিসেবে কাজ করেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে (পার্ট টাইম কোচ)।
নব্বই দশকের মাঝামাঝি অবশ্য বিকেএসপির চাকরি ছেড়ে কিছুদিনের জন্য চলে গিয়েছিলেন ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ে। তখন সেটা টঙ্গীতে ছিল। পাশাপাশি আনসারের হয়েও কাজ করা অব্যাহত ছিল। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ গেমসে আনসার পদক তালিকার শীর্ষস্থান অর্জন করে। সেবার আনসারের হয়ে বিভিন্ন ইভেন্টে স্বর্ণপদক জেতে ইয়াহিয়ারই সুযোগ্য ছাত্র মাহবুব, তালেব, আসলাম, কাশেম, মুনিরা এবং আনসারী। ইতোমধ্যে ইসলামী বিশ^বিদ্যালয় কুষ্টিয়ায় স্থানান্তরিত হলে ইয়াহিয়া সেখানকার চাকরিটাও ছেড়ে দিয়ে যোগ দেন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে (এনএসসি)। নব্বই দশকে মিরপুর স্টেডিয়াম ছিল ফুটবল ও অ্যাথলেটিক্সের জন্য। সেখানকার ফুটবল মাঠ ও এ্যাথলেটিক্স ট্র্যাক তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। পরে মিরপুর স্টেডিয়াম ক্রিকেটকে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। আবার ফিরে আসেন এনএসসিতে। তখন কমলাপুরে তৈরি হচ্ছিল বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মো. মোস্তফা কামাল স্টেডিয়াম। ইয়াহিয়া স্টেডিয়ামের মাঠ তৈরি করে দেন। ২০০৩ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত হন। ওই সময়ে মাঠে সিনথেটিক টার্ফ স্থাপনের যে প্রযুক্তি, তা আংশিকভাবে রপ্ত করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে তার ভাষ্য, ‘বাংলাদেশে এরকম সক্ষমতা একমাত্র আমিই অর্জন করেছি। ভবিষ্যতে কেউ যদি বিদেশ থেকে টার্ফ আমদানি করে এটাকে মাঠে স্থাপন করতে চায়, তাহলে আমি স্বল্প ব্যয়ে এই টার্ফ স্থাপন করে দিতে রাজি আছি।’
এছাড়া দেশের অনেক মাঠই খেলার উপযোগী করে তৈরি করে দিয়েছেন ইয়াহিয়া। যেমন : মিরপুর. কমলাপুর ও বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের মাঠ, শেখ জামাল ধানমন্ডি মাঠ, শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রের মাঠ (বসুন্ধরায়), ব্রাদার্স ইউনিয়ন মাঠ, সিলেট বিকেএসপির মাঠ (একটি অত্যাধুনিক জিমনেশিয়ামসহ) এবং বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটি মাঠ। বর্তমানে কাজ করছেন নারায়ণগঞ্জ স্টেডিয়ামের মাঠ নিয়ে। ‘মাঠ তৈরি করতে যে জ্ঞান থাকা দরকার, তা আমার যথেষ্টই আছে। মাঠের ব্যাপারে আমার ভীষণ দুর্বলতা আছে। কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সংস্থা বা ক্লাব যদি ভাল, আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত ও সুন্দর মাঠ তৈরি করতে চান, তাহলে আমি অতি অল্প খরচে মাঠ তৈরি করে দেব।’ ইয়াহিয়ার ঘোষণা।
মাঠ তৈরির প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অ্যাথলেটিক ফেডারেশনের অনারারি কোচ ইয়াহিয়া আরও বলেন, ‘শরীর সুস্থ রাখতে এবং খেলোয়াড় তৈরির জন্য ভাল মাঠের বিকল্প নেই। এজন্য আমি স্টেডিয়াম নই, বেশি পরিমাণে মাঠ তৈরির পক্ষে। এতে একটা এলাকার ছেলেমেয়েরা মনের আনন্দে খেলাধুলা করবে, এতে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ যথাযথভাবে হবে, কোন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকা-ের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে না। এটাই বেশি দরকার। আর এই প্রয়োজনীয় কাজটি করতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করি।’ মাঠ তৈরির পাশাপাশি তিনি আরেকটি উদ্যোগের সঙ্গেও জড়িত। বেশ কয়েক বছর ধরেই তিনি পল্টন মাঠে আয়োজন করে আসছেন পথশিশু বা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে ফুটবল প্রতিযোগিতা। ‘এই আসরটি আয়োজন করে ভীষণ আনন্দ পাই। আগামী জানুয়ারিতে তাদের নিয়ে আমি একটি বড় পরিসরে ক্রীড়া উৎসব আয়োজন করার ইচ্ছা আছে।’
শুধু সুখস্মৃতিই নয়, মাঠের মানুষ ইয়াহিয়ার বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনে মাঠ নিয়ে আছে দুটি দুঃসহ স্মৃতি। ২০১৩ সালের ৫ মে। হেফাজত ইসলামির বেশকিছু উগ্র কর্মী ঢাকা অবরোধের দিনে ঢুকে পড়ে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। ইয়াহিয়া তখন স্টেডিয়ামে একা থাকা অবস্থায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের মোকাবেলা করেন। পিস্তলের ভয় দেখিয়ে তাদের তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। ফলে তারা স্টেডিয়ামের কোন স্থাপনার খুব বেশি ক্ষতি করতে পারেনি। আরেকটি হলো ২০১০ সালে কুমিল্লা থেকে ঢাকা ফেরার পথে কাঁচপুরের মদনপুরে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হন তিনি। গাড়িতে তাঁর সঙ্গে ছিলেন তার স্নেহের শিষ্য, তারকা অ্যাথলেট মাহবুব আলম। মাহবুব মারা যান। তার অকালপ্রয়াণ আজও প্রচ- কষ্ট দেয় ইয়াহিয়াকে।
এতকিছুর পর সময় পেলে লেখালেখিও করে থাকেন ইয়াহিয়া। সম্প্রতি স্পোর্টস সায়েন্স, ইনজুরি, নিউট্রিশন, ট্রেনিং মেথড, গ্রোথ এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট নিয়ে একাধিক প্রবন্ধ লিখেছেন, যেগুলো বিভিন্ন পত্রিকা এবং অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে। ভবিষ্যতে এসব নিয়ে বড় আকারের একটি বই প্রকাশের পরিকল্পনা আছে তাঁর। তাছাড়া এ্যাথলেটদের ট্রেনিং পদ্ধতি নিয়ে ইংরেজি ভাষায় যেসব বই আছে, সেগুলো বাংলায় অনুবাদও করতে আগ্রহী তিনি, ‘এ ধরনের বই বাংলায় অনুবাদ হলে নিঃসন্দেহে দেশের অ্যাথলেটরা তা পড়ে অনেক উপকৃত হবে।’ বাংলাদেশ জাতীয় অ্যাথলেটিক্স দল নিয়ে কোচ ও কর্মকর্তা হিসেবে ইয়াহিয়া ২০০৪ সালে কাতার এশিয়ান গেমস এবং ২০১১ দিল্লী কমনওয়েলথ গেমসে যান। বর্তমানে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) গ্রাউন্ডস কমিটির সদস্য হিসেবে সুদক্ষ হাতে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। ২০১৪ সালে ক্রীড়াঙ্গনের শ্রেষ্ঠ প্রশাসক হিসেবে ‘কাগজ ও কলম বিজনেস এ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন। এমন একজন কর্মপ্রাণ, সুদক্ষ মাঠের কারিগরকে আরো কিছুদিন পেলে লাভ বই ক্ষতি হবে না বাংলাদেশ ক্রীড়াঙ্গনের। তার সুদক্ষ হাতের ছোঁয়ায় দেশের মাঠ আবারও ভরে উঠবে ক্রীড়াবিদে, ভরে উঠবে শূণ্য গ্যালারিগুলোও- এমনটাই প্রত্যাশা সকলের।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন