শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

উন্নয়নে উপেক্ষিত নিরাপত্তা

চট্টগ্রামে একের পর দুর্ঘটনা প্রাণহানিতেও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চলছে প্রকল্প বাস্তবায়ন

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ২১ আগস্ট, ২০২২, ১২:০০ এএম

চট্টগ্রামে একের পর এক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির পরও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে গেছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ছয় হাজার কোটি টাকার পানিবদ্ধতা নিরসনে মেগা প্রকল্প, নগরীর লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গায় শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত সাড়ে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পসহ বেশির ভাগ উন্নয়ন প্রকল্প চলছে চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় যে কোন সময় এসব প্রকল্প এলাকায় বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা করা হচ্ছে। চরম ঝুঁকি আর আতঙ্ক নিয়ে পথ চলছেন নগরবাসী।

পানিবদ্ধতা প্রকল্পের আওতায় নগরীর সবকটি খালে সংস্কার কাজ চলছে গত কয়েক বছর ধরে। খোঁড়াখুঁড়ির কারণে এখন প্রায় সব খাল-নালা উম্মুক্ত। উম্মুক্ত খালে পড়ে শিশু, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীসহ অনেকের প্রাণ গেছে। ষোলশহর এলাকায় নর্দমায় পড়ে যাওয়া সবজি ব্যবসায়ী সালেহ আহমদের লাশও মিলেনি। এখনও নগরীর অরক্ষিত এসব খাল-নালা মৃত্যুফাঁদ হিসেবে রয়ে গেছে। খাল-নালায় পড়ে পর পর কয়েকজ জনের মৃত্যুর পর সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

কমিটি উম্মুক্ত খাল-নালায় নিরাপত্তা বেস্টনী দেওয়াসহ কয়েক দফা সুপারিশ করেছে। তবে এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। নগরীতে প্রায় ৫০০টি স্পটে খোলা খাল-নালা মরণফাঁদ হিসেবে রয়ে গেছে। এলাকার বাসিন্দারা চরম ঝুঁকি নিয়েই পথ চলছেন। খাল-নালা সংস্কারের দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের হলেও মেগা প্রকল্পের আওতায় থাকায় এখন ওই দায়িত্ব সিডিএর। কোন দুর্ঘটনা ঘটলে একে অপরকে দোষারোপ করছে সিডিএ-সিটি কর্পোরেশন। চান্দগাঁও এলাকায় ক্রেন পড়ে এই প্রকল্পের এক শ্রমিক নিহতের ঘটনাও ঘটেছে।

ঢাকায় গার্ডার পড়ে প্রাইভেটকার আরোহী পাঁচজনের বেঘোরে মৃত্যুর পর চট্টগ্রামের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। কারণ ঝুঁকিপর্ণ অবস্থায় চলছে নির্মাণ কাজ। বিগত ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর নগরীর বহদ্দারহাটে ফ্লাইওভারের গার্ডার ধসে ১৩ জনের প্রাণহানি হয়। এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতা থাকার পরও এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে নিরাপত্তার বিষয়টিকে অগ্রাধিক দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বাউন্ডারি, সেফটিনেটের মতো অপরিহার্য সরঞ্জামের কিছুই ব্যবহার করা হচ্ছে না এখানে। ব্যস্ততম উন্মুক্ত সড়কে সাধারণ যানবাহনের সঙ্গে চলছে ক্রেন, এক্সেভেটরের মতো ভারী নির্মাণ যন্ত্রপাতি। এতে বড় দুর্ঘটনার শঙ্কায় সাধারণ মানুষ। তবে সিডিএর কর্মকর্তাদের দাবি, আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার আর জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে তাগিদ দেয়া হয়েছে।

নগরীর প্রধান এই সড়কে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজ করছে সিডিএ। চট্টগ্রাম বন্দর, বেশ কয়েকটি বেসরকারি কন্টেইনার ডিপো, চট্টগ্রাম ও কর্ণফুলী ইপিজেডসহ শিল্প কারখানার কারণে এই সড়কটি ব্যস্ততম। ট্রাফিক পুলিশের হিসেবে ছোট-বড় মিলিয়ে দৈনিক ১৮ থেকে ২০ হাজার যানবাহন চলাচল করে সড়কটিতে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে যে পরিমান নিরাপত্তা সরঞ্জাম ব্যবহার করার কথা, বাস্তবে তা নেই। সড়কের মাঝ বরাবর চলছে পাইলিং। কোথাও কোথাও টিনের ঘেরাও থাকলেও বেশিরভাগ এলাকা অরক্ষিত। অরক্ষিত অবস্থায় উপরে তোলা হচ্ছে নির্মাণ সামগ্রী। পিলারের উপরে ঢালাইয়ের সময় নির্মাণ সামগ্রী ছিটকে পড়ছে চারিদিকে।

কোন কোন এলাকায় সড়কেই বড় বড় গর্ত। বিশেষ করে নগরীর ইপিজেড থেকে সিমেন্ট ক্রসিং অংশে পুরো সড়ক এখন ঝুঁকিপূর্ণ। ওই অংশে পাইলিংয়ের কাজ শেষ হলেও এখন চলছে নর্দমা সংস্কারের কাজ। সড়কে খোঁড়াখুঁড়ির কারণে পুরো এলাকা ডোবার আকার ধারণ করেছে। কোন কোন অংশে হাটু থেকে কোমর সমান গর্তে কাদা পানির প্লাবন। তাতে প্রতিদিনই রিকশা, অটোরিকশা, টেম্পো উল্টে ঘটছে ছোটখাট দুর্ঘটনা। কয়েকবার কার্ভাডভ্যান ও কনটেইনারবাহী লরি উল্টে যায় সড়কে। পথ চলতে গিয়ে পথচারীরা পা পিছলে পড়ছেন, আহত হচ্ছেন। মাসের পর মাস এমন অবস্থা হলেও এসব গর্ত ভরাটের কোন উদ্যোগ নেই। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও বাসিন্দাদের চরম দুর্ভোগের মুখোমুখি হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ওই সড়কে হয়ে হেঁটে প্রতিদিন হাজার হাজার শ্রমিক ইপিজেডের কারখানায় আসা-যাওয়া করেন। তারা পড়েছেন মহাবিপাকে। পাইলিংয়ের সময় বেশ কয়েকটি অংশে ওয়াসা ও গ্যাসের লাইন কাটা পড়ে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, কোন রূপ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই এক্সপ্রেসওয়ের গার্ডার তোলা হচ্ছে। ওই সময় সড়কে একাংশ বন্ধ রাখা হলেও অন্য অংশে যানবাহন চলাচল করে। তবে এক্সপ্রেসওয়ের নিচে কোন নিরাপত্তা বেষ্টনী নেই। গার্ডার বসানের পর ঝালাইয়ের কাজও চলে উম্মুক্ত অবস্থায়। সরেজমিন দেখা যায় নগরীর ব্যস্ততম সল্টগোলা এলাকায় চলছে গার্ডার বসানোর কাজ। উপরে কাজ চলছে আর কোন নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই নিচে চলছে ভারী যানবাহন ও গণপরিবহন। এতে নিরাপত্তাহীনতায় পথ চলছেন অনেকে। প্রকল্পটির মেয়াদ এবং সময় দফায় দফায় বাড়ছে। সেইসাথে কাজে ধীরগতিতে মানুষের দুর্ভোগও বাড়ছে।

এসব মেগা প্রকল্পের পাশাপাশি নগরীতে ব্যক্তি পর্যায়ে ভবন নির্মাণেও নেই যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এতে প্রতিনিয়ত ভবন থেকে পড়ে কিংবা ভবনের ওপর থেকে নির্মাণসামগ্রী পড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। নির্মাণ শ্রমিকের পাশপাশি পথচারীরও প্রাণ যাচ্ছে। অনেকে জীবনের তরে পঙ্গু হচ্ছেন। এসব দেখার দায়িত্ব যাদের তাদের উদাসিনতা ও অবহেলায় এমন দুর্ঘটনা ঘটছে। প্রাণহানির পরও নিরাপত্তায় নেই কোন উদ্যোগ। বহদ্দারহাটের দুর্ঘটনায় ১৩ জনের মৃত্যু আর অন্তত ১৫ জনের পঙ্গুত্ব বরণের ঘটনায় একটি মামলা হয়। সেই মামলার বিচারও এখন থমকে আছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন