পূর্ব প্রকাশিতের পর
তিনি তাঁর বাকী জীবনে তরীক্বতের প্রাপ্ত দায়িত্ব যথাযত পালন করে গেছেন, যেমন খেদমতে খলক্ব, দ্বীনের মেহনত ও রিয়াদ্বত এবং বৃটেনের বিভিন্ন স্থানে খানেক্বা প্রতিষ্ঠা করে আমৃত্যু তরবীয়ত প্রদান করেন। ঠিক তেমনিভাবে বেলায়তের উপর তিনি রচনা করেন, পূন্যের দিশারী।
বীর
বক্ষ্যমাণ আলোচনায় আল্লামা মুফতি মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী দুবাগী (রহ.)’র অসংখ্য গুনাবলী থাকা সত্বে ও আমি মাত্র তিনটি উপাদী বা শিরোনামের মধ্যে আলোচনাকে সীমাবদ্ধ রাখার কারন কি? উত্তরে বলতে পারি বর্তমান যান্ত্রিক সমাজে আমাদের মাঝে কিছু ভ্রান্ত ধারনা প্রচলিত আছে, যেমন যারা দ্বীনের মুজাহিদ তারা শুধু অস্ত্র-সস্ত্র আর যুদ্ধ-বিগ্রহ নিয়ে ব্যস্ত, তাসাউফের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই, থাকতে পারেনা। কেননা তাসাউফ নাকি মানুষকে মাটিতে মিশিয়ে ফেলে, আদ্রতা আর নম্রতা শেখায়। আসলে কি শুধুই তাই, মোটেই না, বাস্তবে তাঁরাই প্রকৃত মুজাহিদ যারা তাসাউফের উচ্চ মার্গে আরোহন করে দ্বীনের খেদমত চালিয়ে যান। জৈনপুরী-বদরপুরী ছিলছিলা সহ সকল হক্ব ও মক্ববুল তরীক্বত পন্থীদের সংগ্রামী জীবন এর সমুজ্জল প্রমান।
আবার কিছু নামধারী নতজানু আহলে তাসাউফের দাবীদার রয়েছেন যারা লোক সমাজের ভয়ে, নিজের জনপ্রিয়তাকে ধরে রাখার স্বার্থে, সবার কাছে ভালো থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ও হক্ব কথা বলা থেকেও বিরত থাকেন। আলহামদুলিল্লাহ আমি যে দ্বীনের মুজাহিদ এক পীর ও বীর আল্লামা মুফতি মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী দুবাগী (রহ.) সম্পর্কে লিখছি তিনি ছাত্র জীবন থেকে পার্থিব জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত হক্ব-বাতিলের দ্বন্ধে ছিলেন বেপরোয়া, সাহসী বক্তা, তর্কবাগীশ (মুনাযীর), বাতিলের আতংক।
বিভিন্ন মুনাযীরার ক্ষেত্রে তিনি একাই ছিলেন একশ। যেখানে যাকে যা বলা প্রয়োজন শিক্ষা দেয়ার স্বার্থে বা হক্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি তা বলেই ছাড়তেন - সেই হিসাবে আমরা তাঁকে এক সাহসী বীর সৈনিক হিসাবে জানতাম। শেষ বয়সে প্রায়ই তিনি অসুস্থ থাকতেন কিন্তু কোন দ্বীনী মাহফিলে দাওয়াত রাখলে, শারীরীক অবস্থাকে কোন গুরুত্ব না দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও মঞ্চে উপস্থিত হতেন, যেমন দেখেছি লন্ডনের সকল ঈদে মীলাদুন্নবী মাহফিলে, আল ইসলাহর সকল অনুষ্ঠানে, শামছুল উলামা আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.), আল্লামা বিস্কুটি (রহ.) এবং আল্লামা বর্নী (রহ.)’র ঈছালে ছওয়াব মাহফিলে।
একবার এই মহামনীষীর সাথে এক সপ্তাহের সফর সঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল, স্বল্প সময়ে তাঁর ছুহবত থেকে সামান্য যা দেখেছি তা উল্ল্যেখ করতে চাই। ২০১৫ সালের রবিউল আউয়াল মাসে আমেরিকা মিশিগানের ঈদে মীলাদুন্নবী (সাঃ) উদযাপন কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত দু’দিন ব্যাপী ঈদে মীলাদুন্নবী (সাঃ) মাহফিলের প্রধান অতিথি ছিলেন আল্লামা মুফতি মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী দুবাগী (রহ.), তাঁর সফর সঙ্গী ছিলেন তাঁর ছাহেবজাদা মাওলানা ওলীউর রহমান চৌধুরী এবং আমি নগন্য ও। সভাপতি হাজী এবাদুর রহমান সাহেবের সাথে আমরা বিভিন্ন মসজিদ সফর করেছি।
বায়তুল ইসলাম মসজিদে জুমার ইমামতি করেন আল্লামা দুবাগী ছাহেব, নামাযের এক্বামতের সময় একজন মুছল্লী প্রথম থেকে দাড়িয়ে ছিলেন, দুবাগী ছাহেব বললেন “হাইয়া আলাল ফালাহ” – বলতে দাড়াতে হয় এর আগে নয়, বসুন। একটি মুস্তাহাব আমলের বাস্তব শিক্ষা পেলাম। মাগরীবের নামাযে আমরা বায়তুন নূর মসজিদে হাজির হই, জামাতের এক রাকাত আমাদের মিস হয়ে যায়, জামাত শেষে তাবলীগ জামাতের এক বুযুর্গ এলান করলেন – নামায শেষে ঈমান আমল সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বয়ান হবে আমরা সবাই বসি ভাই। আমরা তখনও নামাযে, তাদের বয়ান শুরু হয়ে যায়, সালাম ফিরানোর পর আল্লামা মুফতি মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী দুবাগী (রহ.) বললেন, আগে আমাদেরকে নামায পড়তে দিন পরে বয়ান করবেন। উনার কথায় তারা থেমে গেল। অথচ আমরা বিদেশে মুসাফির, তাঁর সাহসিকতা দেখে তায়াজ্জুব হয়েছিলাম।
শুধু তাই নয়, সফরের পুরোটা সময় তিনি আমার মত নগন্যকে আল্লামা সম্বোধন করতেন, আমি লজ্জা বোধ করেছি, তবে বুঝতে পেরেছি এত বড় মাপের পীর ও বীরগন কত মহত হতে পারেন এবং অধীনস্থদেরকে কত উর্ধে মুল্যায়ন করেন। ইতোপুর্বে ২০০৪ সালে হজ্জের সফরে মুযদালিফার ময়দানে প্রথম সাক্ষাতে সেই মনীষীর সুন্নতের উপর আমল, তথ্যপুর্ন বয়ান এবং সাহসিকতায় আমাকে মুগ্ধ করেছিল।
আল্লামা মুফতি মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী দুবাগী (রহ.) স্বশরীরে আমাদের মাঝে আর বেঁচে নেই ঠিকই, এ লীলা নিকেতন থেকে তাঁর অবস্থান আজ দূরে বহু দূরে, মহীয়ান-গরীয়ান আল্লাহ পাকের করুনাসিক্ত হয়ে তিনি চলে গেছেন চিরকালীন সুখাবাসে। যেখান থেকে কেউ প্রত্যাবর্তীত হয়নি কোন দিন, কখনো। তবে কথা হলো, অসাধারণ ব্যক্তিত্বের পার্থিবলোকে আগমন যেমনি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ তেমনি পরলোক গমন ও তাৎপর্য মন্ডিত। সকল মৃত্যু সমান নয়, জ্ঞানীদের পরিভাষায় জ্ঞানী জনের মৃত্যু বিশ্বভূবনের মৃত্যু তুল্য।
সত্যিকার অর্থে আমরা গুনীজনের সঠিক মূল্যায়ন তখনই করতে পারবো, যখন তাঁদের পূন্যময় জীবন থেকে মনি-মুক্তাসম পাথেয় সংগ্রহ করবো, অনাগত প্রজন্মের কাছে তাঁর জীবনের শিক্ষাকে যথোপযুক্তভাবে প্রেরণ করতে সক্ষম হব।
উপসংহারে এ কথা বলতে পারি, আল্লামা মুফতি মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী দুবাগী (রহ.)’র সঠিক মূল্যায়ন কেবলমাত্র বক্তৃতা আর প্রকাশনার মাধ্যমে করা অসম্ভব, তিনি অনন্য-অতুলনীয়। আল্লামা মুফতি মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী দুবাগী (রহ.) একজন দ্বীনের প্রকৃত মুজাহিদ, সত্যিকার পীর এবং সাহসী বীর ছিলেন। তিনি ছিলেন এমন এক আলোর মশাল যা থেকে পথহারা তমসাচ্ছন্ন অনেক পথিক চলার পথের আলোক রশ্মি লাভে ধন্য হয়েছেন।
আল্লাহ পাক তাঁকে জাযায়ে খায়ের দান করে তার মায়ার ওলিকে জান্নাতুল ফেরদৌসে সু-উচ্চ আসনে সমাসীন করুন। আমীন।
লেখক : ইমাম ও খতীব, শাহজালাল জামে মসজিদ, কিথলী, ইংলেন্ড।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন