শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ঢাবিতে পড়াশোনা নিয়ে উৎকণ্ঠা

নিয়মিত ছাত্রলীগের কর্মসূচিতেই কাটে শিক্ষার্থীদের আগস্ট মাস

রাহাদ উদ্দিন | প্রকাশের সময় : ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

বাবাকে কল ব্যাক করে বললাম ‘আমাকে রাত ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত কল দিও না, এসময় আমার গেস্টরুম চলে।’ আজ চারদিন চলে বাবা আমাকে কোনো কলই দেই না! আগস্ট মাসের শেষদিকে বেশ কয়েকদিন যাবত এই লিখাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন গ্রুপে শেয়ার হতে দেখা যায়। লিখাটি লিখেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন স্টাডিজ বিভাগের এক শিক্ষার্থী। ওই শিক্ষার্থীর এই লিখাটির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্টরুম সংস্কৃতির ভয়াবহতা একটু হলেও আঁচ করা যায়। এবং এই দৃশ্যটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে সর্বজনীন। কিন্তু দিনভর ছাত্রলীগের রাজনৈতিক কর্মসূচি আর রাতে হলে হলে গেস্টরুমে ম্যানার শেখানোর নামে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের তীব্রতা পুরো আগস্ট মাস জুড়ে ছিল বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।
কেমন ছিল আগস্ট জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসীমউদ্দিন হলের ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত রুমে থাকা প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আসিফ আব্দুল্লাহ (ছদ্মনাম) বলেন, প্রথমত কাউকে হলে থাকতে অবশ্যই ১ম ও ২য় বর্ষে নিয়মিত প্রোগ্রাম ও গেস্টরুম করতে হবে এটাই ছাত্রলীগের রুলস। আর অন্যান্য মাসের তুলনায় আগস্ট মাসে এই চাপটা অনেক বেশি পরিমাণে ছিল। কারণ এ মাসে শোকাবহ আগস্টকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের নিয়মিত কর্মসূচি ছিল। প্রতিদিনই প্রোগ্রাম ছিল, কখনো দিনে ৩ থেকে ৪টা প্রোগ্রামও করতে হয়েছে আমাদের। ছাত্রলীগের এসব প্রোগ্রামে উপস্থিত না হলে রাতে গেস্টরুমে তাদের বিচার বসানো হতো নিয়মিত। যারা প্রোগ্রামে ফাঁকি দিয়েছে তাদের আলাদাভাবে বিভিন্ন কায়দায় শাস্তি দিত। এছাড়াও অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ তো আছেই। এদের একজনের দোষে অনেকসময় বাকি সব সহপাঠীকেও গেস্টরুমে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো ঘন্টার পর ঘণ্টা।
তবে ছাত্রলীগের এসব কর্মসূচিতে অংশ নেয়ায় পড়াশোনার ক্ষতির বিষয়টা মানতে নারাজ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন। তিনি বলেন, এটা কখনোই সম্ভব নয় যে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে অংশ নেয়ায় কারো পড়াশোনার ক্ষতি হয়েছে। বরং যারাই আমাদের কর্মসূচিতে অংশ নেয় তারা পড়াশোনা ও প্রোগ্রাম সমন্বয় করে নেয়।
মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সুজন (ছদ্মনাম) বলেন, ৪ মাসে সেমিস্টার হওয়ায় আগস্টে আমার সেমিস্টার ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়। এর আগের সেমিস্টারগুলোর তুলনায় এই সেমিস্টারে পরীক্ষার প্রস্তুতি ভালো ছিল না। ফলশ্রুতিতে যথারীতি পরীক্ষা তুলনামূলক খারাপই দিয়েছি। এর পেছনে সুজন দায়ী করেন ছাত্রলীগের নিয়মিত প্রোগ্রাম আর গেস্টরুমকে।
আগস্ট মাসে ছাত্রলীগের নিয়মিত কর্মসূচির চাপে বিভিন্ন হলের অনেক শিক্ষার্থী হল ছেড়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিটা হলের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের দিয়ে পূর্ণ করা হয় ছাত্রলীগের কর্মসূচি। গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস বাদ দিয়েও করতে হয়েছে এসব প্রোগ্রাম। শুধু পরীক্ষার আগের রাতে ছুটি মিলতো শিক্ষার্থীদের। এফ রহমান হলের প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, পড়াশোনার কথা জানালে ভাইয়েরা বলে-ঢাবিতে কি পড়াশোনা লাগে নাকি? পরীক্ষার আগের রাত পড়লেই তো পাস!
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের এক শিক্ষার্থী জানান, প্রতিদিন রাতে ভাইয়েরা গ্রুপে জানিয়ে দিত পরের দিনের কর্মসূচির কথা। প্রোগ্রামে উপস্থিতি কম হলে রুম থেকে বের করে দেয়ার হুমকিও দিত। আবার যারা প্রোগ্রামে কম যায় তাদেরকে মিনি গণরুম থেকে বের করে তুলনামূলক বড় গণরুমে পাঠানো হয়। এভাবেই প্রতিদিন সকাল সকাল প্রোগ্রামের ডাক, রাতে গেস্টরুম আর রুম এমনকি হল থেকে বের করে দেয়ার হুমকিসহ নানা উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার মধ্য দিয়ে কেটেছে পুরো আগস্ট।
এদিকে আগস্ট মাসে নিজেদের সংযত রাখলেও সেপ্টেম্বরের প্রাক্কালেই শুরু হয়েছে ছাত্রলীগের বেপরোয়া আচরণ। ৩১ আগস্ট রাতে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের ১০২৭ নাম্বার রুমে গেস্টরুমে দেরি করে যাওয়ায় ৬ শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনা গত দু’দিনে মেইন স্ট্রিংয়ের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোতে প্রচারিত হয়েছে। এর আগেও গত ৬ মাসে বিভিন্ন হলে প্রায় ৩০টি শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।
বিষয়টি নিয়ে কথা বললে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, ছাত্রলীগের কর্মীরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভরসার জায়গা। তাদের পড়াশোনার সুযোগ করে দেয়াসহ যাবতীয় প্রয়োজনে প্রশাসনের সাথে কথা বলার জন্য এবং সেটি নিশ্চিত করার জন্য ছাত্রলীগ কাজ করে। ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে আসা এটা হচ্ছে যে, আমরা শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতির উপরই আমরা সবসময় ভরসা করি। শিক্ষার্থীরা তাদের প্রয়োজনে যখন তাদের ভালো লাগে তাদের ল্যাব, পরীক্ষা, ক্লাস এসবের সাথে সমন্বয় করেই তারা আসে। শিক্ষার্থীদের জোর করে কর্মসূচিতে নেয়ার অভিযোগ মানতে নারাজ সাদ্দাম।
প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির আহ্বায়ক ও বিজয় একাত্তর হলের প্রভোস্ট প্রফেসর আব্দুল বাছির বলেন, আমার হল প্রশাসন তাদের শতভাগ দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করে থাকে। শিক্ষার্থীদের সার্বিক বিষয়ে যথেষ্ট খোঁজ খবরও নেয়া হয়।
শিক্ষার্থীরা হল প্রশাসন থেকে বরাদ্দ দেয়া সিটে না উঠে কেন ছাত্রলীগের দেয়া সিটে উঠে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমার হলে প্রশাসন থেকে যে সিট দেয়া হয় সে সিটেই শিক্ষার্থীদের উঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। তবে অন্যান্য হলের বিষয়টা শুরুতে তিনি মানতে না চাইলেও পরে দুঃখপ্রকাশ করেন। এমনটা আসলে হওয়া উচিত না। হল প্রভোস্ট হিসেবে মনোনয়ন দেয়া হয় সৎ, যোগ্য ও বিচক্ষণ শিক্ষকদের। তাদের দায়িত্বই হচ্ছে শিক্ষার্থীদের যাবতীয় সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন