শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

মুমিন জীবনে অনুসরণীয় চরিত্র

মুহাম্মদ ইয়াসিন আরাফাত ত্বোহা | প্রকাশের সময় : ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়েছেন। আরো দিয়েছেন শক্তি-সাহস। তিনি সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের জন্য আদর্শ তথা অনুসরণীয় চরিত্র নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কেননা মানুষ প্রকৃতিগত ভাবে অনুকরণ প্রিয়। প্রতিটা মানুষের স্মৃতিপটে একটি কাল্পনিক ছবি হৃদয়ঙ্গম করা থাকে; যার আাদলে মানুষ নিজেকে গড়ে তোলার চেষ্টা করে। প্রতিটা মানুষ এমন একটি আদর্শকে নিজের মাঝে ধারণ করতে চায়; যে আদর্শের মধ্যে নেই কোনোরূপ কপটতা, মেকিতা বরং থাকবে নিষ্কলুষতা। ছোট বেলায় মানুষ নিজের বাবাকে জাগতিক আদর্শ হিসেবে বেছে নেয়। বড় হওয়ার সাথে সাথে যখন দেখে তার বাবার থেকেও সফল মানুষ রয়েছে তখন সে নতুন করে ঐসফল মানুষকে আদর্শ হিসেবে বেছে নেয়। অতঃপর যখন পড়াশোনার গন্ডি অনেকদূর পেরিয়ে যায়; বুঝতে শিখে, শিখে ব্যাখ্যা করতে তখন সে নতুন রূপে সোনালী মানুষদেরকে আদর্শ হিসেবে বেছে নেয়। যখন নিজের আদর্শ মানুষটির থেকেও অন্য কাউকে অধিক সচ্চ, দক্ষ, যোগ্য, পরোপকারী ও নিষ্কলুষ হিসিবে দেখে তখন নতুন ব্যক্তিকে অনুকরণ শুরু করে। বেড়ে ওঠার সাথে সাথে আদর্শের প্রতিচ্ছবির পরিবর্তনটা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। সহজাত প্রবৃত্তি হল কোন মানুষের আচরণের একটি অংশ। মানুষের সকল প্রকার সহজাত প্রবৃত্তির বিপরীতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা আচরণ বিধি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। অনুসরণের ক্ষেত্রেও তিনি এমন একটি আদর্শকে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন; যে চরিত্রের ব্যাপারে তার শত্রুরাও পৃথিবীর সেরা চরিত্রবান মানুষরূপে তাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। যার আমানতদারিতা এতো বেশি ছিলো যে, শত্রুরাও তার কাছে সম্পদ আমানত রাখতো। তার দ্বারা পৃথিবীর কোনো মানুষ কোন সময়ের জন্য কষ্ট পাননি। প্রস্তরাঘাতে রক্তাক্তকারী জাত শত্রুদেরও ক্ষমা করেছেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা কর্তৃক মানবজাতির জন্য নির্ধারিত সেই আদর্শের মানুষটি হলেন বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারী ইসলামের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, পৃথিবীর সর্বকালের সেরা মানুষ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। প্রতিটা মানুষ স্বপ্ন নিয়ে বেচেঁ থাকে। বেড়ে ওঠার সাথে সাথে স্বপ্নরা বড় হয়। যিনি রাজনৈতিক নেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি রাজনীতিবিদদের মধ্য থেকে দাপটশালী উত্তম কাউকে অনুসরণ করেন। যিনি শিক্ষকতায় পেশায় নিয়োজিত হওয়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষককে অনুসরণ করেন। আবার যিনি ভুগোলবিদ হওয়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি ভূ-তত্ত্বে বিজ্ঞ কাউকে অনুসরণ করেন। যিনি অর্থনীতিবিদ হওয়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি অর্থ-তত্ত্বে বিজ্ঞ কাউকে অনুসরণ করেন। অর্থ্যাৎ যিনি যে কেন্দ্রীক নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখেন তিনি সে কেন্দ্রীক বিজ্ঞ কাউকে অনুসরণ করেন। কিন্তু কথা হলো, সাধারণ একজন মানুষের মত কোনো মুমিন ব্যক্তি কি যাকে তাকে অনুসরণ করতে পারে? কখনোই না। কেননা আমরা জানি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা মানুষের জীবন বিধান হিসেবে আল-কুরআনকে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আবার সে আল-কুরআনের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি হিসেবে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উপস্থাপন করেছেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ’ (সূরা আহযাব, আয়াত: ২১)। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ”আর নিশ্চয় তুমি মহান চরিত্রের উপর অধিষ্ঠিত” (সূরা আল-ক্বলম আয়াত-০৪)।

আমরা ইতহাস থেকে জানতে পারি যে, ইসলামের শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বজ্ঞানে গুণান্বিত মানুষ। তিনি একাধারে রাষ্ট্রনায়ক, সমরবিদ সেনাপতি, আইনবিদ, বিচারপতি, যুক্তিবিদ, দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, ভুগোলবিদ, সমাজবিদ, পদার্থবিদ, চিকিৎসাবিদ ইত্যাদি সকল বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। ঐতিহাসিক, গবেষক ও জৌতিবিজ্ঞানী মাইকেল এইচ হার্ট একদল গবেষক নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণার পর তিনি বিশ্ব ইতিহাসে সর্বাধিক আলোচিত ও প্রভাব বিস্তারকারী একশত ব্যক্তিত্বকে বাছাই করে ইসলাম ধর্মের স্থপতি হযরত মোহাম্মদ সা. কে সর্বাধিক আলোচিত ও প্রভাব বিস্তারকারী প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসাবে নির্বাচিত করে বিশ্বে সাড়া জাগানো তার দি হান্ড্রেড গ্রন্থে প্রথম স্থান দান করেন। মজার ব্যাপার হলো উক্ত গ্রন্থের লেখক ও প্রকাশক উভয়েই খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী। তিনি তার গ্রন্থের শুরুতে উল্লেখ করেন, দি হান্ড্রেড গ্রন্থে দুনিয়ার সব চাইতে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকায় মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নাম প্রথমে রেখেছি বলে অনেক পাঠকই আশ্চর্য হতে পারেন, কিন্তু একথা নিঃসন্দেহে সত্য যে, ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উভয় ক্ষেত্রে সর্বাধিক সফল ব্যক্তিত্ব। তাঁর জন্ম সাধারণ পরিবারে অথচ তিনি বিশ্বের প্রধান ধর্মের প্রবর্তক এবং পরবর্তীতে হয়ে উঠেন পৃথিবীর সর্বাধিক প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তাঁর মৃত্যুর তের শত শতাব্দীর পরে আজও তাঁর প্রভাব অত্যন্ত শক্তিশালী ও ব্যাপক। মাইকেল এইচ হার্ট শুধু হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেই শ্রেষ্ঠত্ব দান করেননি। ইসলাম ধর্মকেও প্রধান ধর্ম বলে স্বীকৃতি দান করেছেন।

স্যার উইলিয়াম মূর বলেছেন, ‘সর্বশ্রেণীর ঐতিহাসিকরা একবাক্যে হযরত মুহাম্মদের যৌবনকালীন স্বভাবের শিষ্টতা ও আচার ব্যবহারের পবিত্রতা স্বীকার করেছেন। এরকম গুণাবলি সে সময় মক্কাবাসীর মাঝে বিরল ছিল। এই সরল প্রকৃতির যুবকের সুন্দর চরিত্র, সদাচরণ তার স্বদেশবাসীর প্রশংসা অর্জন করে এবং তিনি সর্বসম্মতিক্রমে ‘আল-আমিন’ বা বিশ্বাসী উপাধি পান।’ বিশ্বখ্যাত নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ’ বলেন, যদি আগামী একশ বছরের মধ্যে শুধু ইংল্যান্ড নয়, সারা ইউরোপকে শাসন করার সম্ভাবনা কোনো ধর্মের থেকে থাকে, তাহলে সে ধর্ম হবে শুধু ইসলাম। আমি সবসময় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর ধর্ম সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করে এসেছি এর আশ্চর্য জীবনীশক্তির জন্য।

সাম্য প্রতিষ্ঠায় মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন অনন্য রোল মডেল। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত, ‘ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধে (আরোহীর অভাবে) বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা), হযরত আলী (রা), হযরত আবু লুবাবা (রা) তিনজনই পালাক্রমে একটি উটের ওপর আরোহণ করে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে যখন রাসূল (সা)-এর উট টানার পালা আসত, তখন রাসূল (সা)-এর হুকুমে সাহাবি হযরত আলী ও আবু লুবাবা উটে আরোহণ করতেন। অতঃপর হযরত আলী ও আবু লুবাবা উট টানলে রাসূল (সা) উটে আরোহণ করতেন।’ (তাবকাতে ইবনে সা’দ-২/২১)

বিচারপতি হিসেবে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা বর্ণনা না করলেই নয়। একবার মাখজুমী গোত্রের এক কুরাইশী মহিলা চুরি করে ধরা পড়ে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হাত কেটে ফেলার নির্দেশ দেন। নির্দেশ শুনে লোকজন খুব পেরেশান হয়ে পড়লো। কারণ সেই মহিলা ছিল সম্ভ্রান্ত গোত্রের। তারা বলাবলি করতে লাগলো, উসামা ইবনু যায়িদ ছাড়া আর কে আছে, যাকে আল্লাহর রাসূল (সা) অত্যধিক ভালোবাসতেন। তারা উসামা (রা) কে সুপারিশের জন্য রাসূল (সা) এর কাছে পাঠালেন। যখন তিনি এ ব্যাপারে রাসূল (সা) এর সাথে কথা বললেন, তখন নবী করীম (সা) বললেন, ‘‘হে উসামা! তুমি কি আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা না করার সুপারিশ করতে এসেছো?’’ তখন উসামা ইবনু যায়িদ ভয় পেয়ে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাকে মাফ করে দিন। আমার ভুল হয়েছে। অতঃপর নবী আকরাম (সা) মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুতবা দিলেন। প্রথমে আল্লাহর হামদ ও সানা পেশের পর বললেন, ‘হে লোক সকল! তোমাদের পূর্ববর্তী লোকজন এ কারণেই ধ্বংস হয়ে গেছে। যখন তাদের মধ্যে কোন সম্ভ্রান্ত ও প্রভাবশালী লোক চুরি করতো তখন তারা তাকে ছেড়ে দিত এবং দুর্বল লোক চুরি করলে তাকে শাস্তি দিত। (চলবে)

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন