এখনো ভুলিনি বাবার হাতে হাত রেখে প্রথম স্কুলে প্রবেশের স্মৃতি। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে ঈদগাহে যাওয়ার দিনগুলোর কথা। ভুলেনি পা পিছলে পড়তে গিয়ে সেই হাতটি। যে হাতটি প্রথমেই সহায়ক হাত হিসেবে এগিয়ে আসত সেই হাতটির কথা। সে ভিন্ন কেউ নন, তিনি আমার বাবা। অথচ সেই বাবাকে কী প্রচন্ড রকমের আঘাত দিয়েছিলাম। স্নেশীতল রক্তের বন্ধনকে অস্বীকার করে একদিনের নোটিশে প্রেমিকের হাত ধরে বেরিয়ে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম কোনো দিন ফিরব না। কোনো এক দিনের জন্য তাকাতে হবে না পেছনের দিকে। কিন্তু না। মাত্র পাঁচ মাসের ব্যবধানে আমার চিন্তাধারা ভুল প্রমাণিত হলো। পুনরায় বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই বাবার কাছে ছুটে আসতে হলো। যাকে প্রেমিক, এক অদ্বিতীয় অবলম্বন ভেবেছিলাম, সে মানুষটির রাতারাতি মুখোশ খুলে যাওয়ায়। জেনে সে আমাকে নয়, বাবার প্রভাব সম্পত্তির লোভেই আমাকে তার জীবনে জড়িয়েছে। আর বাবা কোনো প্রশ্ন না করেই বুকে জড়িয়ে নিয়ে ছিল অবাধ্য সন্তান এই আমাকে। যে দলছুট সর্বহারা, ভালোবাসা প্রেম বন্ধন থেকে। কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ছাত্রী জ্যোতি বিশ্বাস। কখনো কেউ কোনো একজন চলতি পথে কাউকে বাবা বলে সম্বোধন করে, করা মাত্রই সতর্কভাবে তাকাই। দেখি, তাদের বাবাদের চেহারা, স্নেহ নির্ভরতার মাঝে আমার বাবাকে খুঁজে পাওয়া যায় কিনা। পত্রিকার পাতা উল্টিয়ে উল্টিয়ে অগণিত বাবার ছবির সাথে স্মৃতির স্থপতি আমার বাবার ছবি মিলিয়ে দেখি। আছে কী, কোনো মিল! না, নেই! আমার বিশ্বাস একাগ্র ধারণা, বাবার আমি ছাড়া কোনো একটি জগৎ ভালোবাসার ক্ষেত্র ছিল না। তাই যেদিন স্বামীর হাতে নির্যাতিত হয়ে বাবার কাছে নালিশ জানিয়ে ছিলাম, সেদিন বাবা হয়তো তা সহ্য করতে পারেননি। তাই মুহূর্তের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক করে চিরবিদায়ের দেশে হারিয়ে গেলেন তিনি। বাবা হারিয়ে যাওয়ার পর বুঝেছিলাম, তিনি তার ব্যক্তি জীবনে সকল বেদনা কষ্টবোধ হতাশা লুকিয়ে সদা হাসিমুখে রাখতেন। আমাদের সুখী দেখতেই সর্বক্ষণ আশ্বাস-প্রতিশ্রুতির বাণী শোনাতেন। আর আমরা তার সন্তান হয়ে নিজেদের একান্ত সমস্যার মোকাবেলা করে তাকে আশ্বস্ত রাখতে পারিনি। পারিনি সন্তান হয়ে নির্ভরতা নির্ভীক একটি পৃথিবী উপহার দিতে। তাই বাবা দিবসে বাবার প্রতি এই অকৃতজ্ঞ সন্তানের আকুতি, বাবা তুমি যেখানেই থাকো ক্ষমা কর। নিজের একান্তভাব প্রকাশে বলছিলেন ঢাকা মেডিকেলের স্টাফ-নার্স সাবরিণা সিদ্দিকা। স্কুল ছুটি শেষে বের হতে হতে ৫টা বেজে ৩০ মিনিট লেগে যেত। অনেকটা ইচ্ছে করেই দেরিতে বের হতাম। অফিস ফেরত বাবার ছায়াতলে বাড়ি ফিরব বলে। ছুটির দিনগুলোতে ব্যাগ ভড়তি বাজার নিয়ে বাবা যখন বাড়ি ফিরতেন তখনো দৌড়ে যেতাম। জানতাম, আমার পছন্দের খাবারগুলোই বাবা কিনে এনেছেন। অথচ সে বাবাকে যখন আমেরিকার ডিবি পাওয়া মাত্র এড়িয়ে গিয়ে উন্নত জীবনযাপন ভোগবিলাসকে প্রাধান্য দিয়ে চলে গেলাম প্রবাসে, সেদিন একটিবারের জন্যও ভাবিনি আমার অবর্তমানে বাবার দিনগুলো কীভাবে কাটবে। বাবা কার কথা ভেবে ভেবে অফিস থেকে ফিরবে। বাজারের থলি হাতে ক্লান্ত-শ্রান্ত ঘামে ভেজা শরীরে বাড়ি ফিরবে। প্রবাসে যাওয়ার পরও ব্যস্ততার অজুহাতে বাবার সাথে তেমন একটা যোগাযোগ হতো না। মাঝেমধ্যে পকেট মানি বাবদ বাবাকে ডলার পাঠাতাম। মায়ের কাছে শুনেছি, অভিমানে সে টাকা বাবা স্পর্শও করতেন না। মাঝেমধ্যে শুধু বলতেন, মেয়েটাকে কতদিন দেখি না। বাবার অসুস্থতার কথা কানে এলে আসব আসব করেও যখন অনেক দিন কেটে যাচ্ছিল এমন এক প্রেক্ষাপটে নিকটতম আত্মীয়র মাধ্যমে শুনতে পেলাম বাবার মৃত্যুর সংবাদ। শোনামাত্রই ইচ্ছে হচ্ছিল সব ছেড়েছুড়ে চলে আসি। কিন্তু বাধাধরা নিয়মের জালে জড়িয়ে তখনো ছুটে আসা সম্ভব হলো না। আর যখন এলাম, তখন বাবার সমাধিস্থলও অনেকটা মাটির সাথে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। সেই সমাধিস্থলের ভূমি স্পর্শ করে বলতে ইচ্ছে করছিল, বাবা এই লোভি অকৃতজ্ঞ সন্তানকে ক্ষমা করুন। যে রক্তের সম্পর্ক ভালোবাসার বন্ধন দেশ, মা, মাটিকে অস্বীকার করেছিল। বলছিলেন প্রবাসে অবস্থানকারী মেয়ে নারী নুসরাত জাহান ইলা। শুধু এ কজন নয়। এমন অনুতপ্ত সন্তান আমাদের মাঝে সামান্য হলেও আছেন। যারা আবেগের বসতি হয়ে নিজ ইচ্ছা, চাওয়া-পাওয়ার একচেটিযা প্রাধান্য দিয়ে পিতৃত্বের বন্ধনকেও অনেক সময় এড়িয়ে যায়। আবার প্রয়োজন সামান্য আঘাতেও পিতার শরণাপন্ন হয়। তাকে চিন্তামগ্ন করে। বিলাসবহুল উন্নত জীবনযাপনের ইঙ্গিতে বিচ্ছেদের দেয়াল তোলে। কিন্তু সময় তার নির্ধারিত নিয়মেই চলে। সে নিয়মের যথার্থতা পালনে এই ছায়াশীতল আশ্রয় দানকারী বাবারা একদিন চিরতরে না ফেরার দেশে হারিয়ে যায়। তখন এই আমরা সন্তানরা সত্যিকার অর্থেই হই অবলম্বনহারা। পরিশেষে অনুতপ্ত করা ছাড়া কোনোই পথ খোলা থাকে না। তাই সব সন্তানের উদ্দেশে অনুরোধ, বাবার উপস্থিতি ও সময় থাকতেই বাবাদের প্রতি যথার্থ সম্মান-ভালোবাসার পরিবেশ প্রেক্ষাপট তৈরি করে নিতে মনোযোগী হওয়াই হবে বাবা দিবসসহ প্রতিটি দিন ক্ষণে মুহূর্তের হিসাবে সকল সন্তানদের উদাত্ত আহ্বান আবশ্যক কর্তব্যসূচক অধ্যায়ও বটে।
খন্দকার মর্জিনা সাঈদ
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন