বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

হেফাজতে মৃত্যুতে বাড়ছে উদ্বেগ

পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর দায় অবশ্যই রাষ্ট্রের : এমএসএফ পুলিশ হেফাজতে কে রশি কিংবা আত্মহত্যার উপকরণ সাপ্লাই দেয় : হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন হাইকোর্টের নির্দেশনা মানছে না আইন প্রয়োগকারী

হাসান-উজ-জামান | প্রকাশের সময় : ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে নাগরিকদের মধ্যে বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনও এ নিয়ে উদ্বিগ্ন। আইন প্রয়োগকারি কতিপয় অসাধু সদস্যের বিরুদ্ধে অসদাচরণসহ ক্ষমতার অপব্যবহারের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। গত আগস্ট মাসে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে থাকা ৩ জন আসামির মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া থানা থেকে কারাগারে যাবার কয়েক দিনের মধ্যেই মারা গেছে একজন। আসামি ধরার সময় পুলিশের ধাওয়া খেয়ে মারা গেছে দুইজন। পুলিশের দাবি, থানা হেফাজতে থাকা আসামিদের একজন আত্মহত্যা করেছেন। বাকিদের মৃত্যু হয়েছে অসুস্থজনিত কারণে।
এসব ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) বলেছে, পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু, নির্যাতন ও হয়রানি বেড়েছে। পুলিশ অথবা কারা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনার দায় অবশ্যই রাষ্ট্রের উপর বর্তায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এহেন কর্মকাণ্ড ও আইনবহির্ভূত আগ্রাসী আচরণ চরম উদ্বেগের বিষয়। যা নাগরিক জীবনে চরম উৎকণ্ঠা ও ভীতি সৃষ্টি করছে। এতে করে ক্রমাগত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থাহীনতার জন্ম দিচ্ছে।
গত ১৯ আগস্ট রাজধানীর হাতিরঝিল থানা হাজতে থাকা ২৫ বছরের যুবক সুমন শেখের আত্মহত্যার ঘটনা এখনো মেনে নিতে পারেনি তার পরিবার। সুমনের মৃত্যুর প্রতিবাদে থানার সামনে বিক্ষোভ-সমাবেশ, বিচার না পেয়ে নিহতের লাশ গ্রহণে পরিবারের অস্বীকৃতি, অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের চেষ্টা এবং এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠনের ঘটনা দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোচিত সমালোচিত হয়েছে। সুমনের স্ত্রী জান্নাত আরাসহ পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, সুমনকে ধরে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে থানা হেফাজতে পুলিশের নির্যাতন সইতে না পেরেই সুমন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। পুলিশের দাবি, গত ১৯ আগস্ট দিবাগত রাতে হাতিরঝিল থানা হাজতে সুমন তার পরনের ট্রাউজার লোহার গ্রিলের সঙ্গে বেঁধে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করে।
সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে গত ১৭ জুলাই কুমিল্লার মুরাদনগরের বাসিন্দা সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক আনোয়ার হোসেনকে ধরে নিয়ে যায় চান্দিনা থানা পুলিশ। দেয়া হয় মামলা। পরদিন আনোয়ারের ঠিকানা কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে। গত ১১ আগস্ট ভোরে কারাগারে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে পাঠানো হয় কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আনোয়ার। ভুক্তভোগী আনোয়ারের স্ত্রী রহিমা বেগমের অভিযোগ, গ্রেফতারের পর চান্দিনা থানার এসআই আমিনুর রহমানের নির্যাতনে তার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে। থানায় নিয়ে এসআই আমিনুর তার স্বামীকে বেদম নির্যাতন চালায়। এতে তিনি গুরুতর অসুস্থ হন। কারাগারেও সুচিকিৎসা মেলেনি তার স্বামীর।
গত ১৬ আগস্ট ডিবি পুলিশ ঢাকার রমনা এলাকা থেকে ১ হাজার ইয়াবাসহ গ্রেফতার করে কক্সবাজারের টেকনাফের বাসিন্দা সিদ্দিককে। পরদিন সকালে তাকে আদালতের মাধ্যমে পুনরায় পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়। ওই দিন পেটের ব্যথায় অসুস্থ হয়ে পড়লে রাতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তিনি মারা যান।
২৩ আগস্ট গাইবান্ধা জেলা আদালতের হাজতখানায় জমিজমা সংক্রান্ত মামলায় জামিনে থাকা আসামি সাঘাটা উপজেলার পবনতাইর গ্রামের বাসিন্দা তাহের মাহমুদ (৬৫)-এর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে তাকে গ্রেফতার করে হাজতখানায় রাখা হয়। সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়লে পুলিশ তাকে হাসপাতালে পাঠালে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এদিকে গত ১৩ আগস্ট রাতে কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার গল্লাই পশ্চিমপাড়া গ্রামের খারকান দিঘিরপাড়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আসামি নাছির উদ্দিন, তার স্ত্রী সেলিনা বেগম ও মেয়ে তানজিনা আক্তারকে গ্রেফতারে তাদের বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালায়। এ সময় একই ঘরে থাকা নাছিরের স্ত্রী সেলিনা বেগম প্রাকৃতিক ডাকের কথা বলে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যায়। পুলিশ খোঁজাখুঁজি করে সেলিনা বেগমকে না পেয়ে নাছির উদ্দিন ও তার মেয়ে তানজিনাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে আসে। পরদিন সকালে বাড়ির পাশে ভেসে ওঠে সেলিনা বেগমের লাশ।
গত ২৮ আগস্ট কক্সবাজারের চকরিয়ায় নদীর তীরবর্তী জুয়া খেলার অভিযোগে পুলিশের অভিযানে পানিতে লাফিয়ে পড়া ৩ যুবকের মধ্যে শফি আলম নামে একজনের লাশ উদ্ধার হয় নদী থেকে। গত ৫ আগস্ট বগুড়ার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার চাঁদপাড়া মাদ্রাসার প্রভাষক আব্দুল আলিমকে ছাগল চোর সন্দেহে স্থানীয় থানার এএসআই রশিদুল ইসলাম শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছেন। গুরুতর অবস্থায় তাকে ভর্তি করা হয় সোনাতলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।
এসব ঘটনায় মানবাধিকার সংগঠন এমএসএফ মনে করে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে অপতৎপরতা চলছে মানবাধিকারের চরম লংঘন ও ন্যায়বিচার না পাওয়ার ক্রমবর্ধমান অবক্ষয়ের চিত্র। যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং নাগরিক জীবনে চরম উৎকণ্ঠা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আস্থাহীনতার জন্ম দিচ্ছে। ভুক্তভোগীদের আবেদন সত্ত্বেও অনেক ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত বা বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়নি। বরং কিছু কিছু ঘটনা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বরং আইনি প্রক্রিয়া শুরুতে বাধা প্রদান করেছে।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী এলিনা খান ইনকিলাবকে বলেন, থানা হেফাজতে মৃত্যু কিংবা নির্যাতন কেন হবে? স্বাধীনতাতো অর্জন করেছি এগুলো না দেখার জন্যই। পুলিশের হেফাজতে কেন একজন মানুষ আত্মহত্যা করবে, কে রশি কিংবা আত্মহত্যার উপকরণ সাপ্লাই দেয়। সরকার কর্তৃক এগুলো অবিলম্বে বন্ধ হওয়া উচিৎ। থানা হেফাজতে এ রকম ঘটনার ক্ষেত্রে ভূক্তভোগীর স্বজনদের এমনকি একজন ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে ঘটনাস্থলেই নিহত ব্যক্তির লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন আনুষঙ্গিক সবকিছু করা উচিৎ। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের দ্বারা নাগরিকরা যাতে কোন ধরনের হয়রানির শিকার না হন সরকারকে তা নিশ্চিত করতে হবে।
আইন ও শালিস কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, কাউকে গ্রেফতার করার সময় কিংবা গ্রেফতার পরবর্তী জিজ্ঞাসাবাদের সময় হাইকোর্টের যে নির্দেশনা রয়েছে সেগুলো মানছে না আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। হাইকোর্টের নির্দেশনা ছিলো কাউকে গ্রেফতারকালে তার স্বজনদের অবহিত করা এবং জিজ্ঞাসাবাদকালে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির শারীরিক ও মানষিক অবস্থা পর্যালোচনা করা। আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদকালে কাঁচ ঘেরা কক্ষের বাইরে তার আইনজীবি ও স্বজনদের উপস্থিতির কথাও নির্দেশে উল্লেখ ছিলো। কিন্তু এগুলো মানা হচ্ছে না। একজন আসামিকে গ্রেফতারের পর তার নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা গ্রেফতারকৃত সংস্থার নৈতিক ও আইনগত দায়িত্ব। একজন সুস্থ মানুষ আসামি হিসেবে থানা হেফাজতে থাকাবস্থায় আত্মহত্যা কেন করবে? সেখানে এমন কি ঘটনা ঘটেছে যাতে তার মানষিক পরিবর্তন হয়েছে। থানায় সিসিটিভি মনিটরিং করার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরও অবহেলা রয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর পরিচালক নাসির উদ্দিন এলান ইনকিলাবকে বলেন, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা যখন কাউকে গ্রেফতার করে, রিমান্ডে নেয়, কখনো টর্চার করে স্বীকারোক্তি আদায়ের আবার কখনো টর্চার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি আদায় করতে। একজন আসামিকে যে কারণেই নির্যাতন করুক না কেন, সব কিছুর মূলে রয়েছে টাকা আদান-প্রদান। এলান বলেন, যখন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কিংবা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ব্যবহার করা হয়, তখন তারা নিজেদের অনেক শক্তিশালী মনে করে। এক প্রকার দায়মুক্তি ভাব দেখা দেয়। তখন তারা জবাবদিহিতার বাইরে চলে যায়। তিনি আরো বলেন, সব সরকারের শাসনামলেই আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু বর্তমানে এতটাই ব্যাপকহারে ব্যবহার করা হচ্ছে যে, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কতিপয় সদস্য বেসামাল হয়ে পড়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন