জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছরেরও বেশি সময় আগেই সংঘাতময় হয়ে উঠেছে রাজনীতি। রাজধানী ছাড়াও দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে এই সংঘাত। বিগত কিছুদিন ধরেই জেলা-উপজেলা-থানায় থানায় বিএনপির সমাবেশগুলোতে করা হচ্ছে হামলা, হামলার পর তাদের নামেই দেয়া হচ্ছে মামলা। কোথাও কোথাও বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও পুলিশ সংঘর্ষে জড়াচ্ছে। এবারের হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছেন না দলের সিনিয়র ও কেন্দ্রীয় নেতারাও। নেতাকর্মীদের বাড়ি-ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও করা হচ্ছে হামলা ও ভাঙচুর। যার সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে গত শনিবার কুমিল্লায় একটি ঘরোয়া প্রোগ্রামে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী বরকত উল্লাহ বুলু ও তার স্ত্রীর ওপর হামলা করা হয়।
হামলায় গুরুতর আহত হয়ে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন তারা। একই দিন সন্ধ্যায় রাজধানীর বনানীতে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন কর্মসূচি পালনকালে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করা হয়। এতে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, ঢাকা উত্তর সিটির বিগত নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। এর মধ্যে তাবিথ আউয়াল গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। এর দুই দিন আগে গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিরপুরে বিএনপি শান্তিপূর্ণ সমাবেশের প্রস্তুতিকালে নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালানো হয়।
বিএনপি ও গণমাধ্যমের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিগত দেড় মাসেই বিএনপির অর্ধশতাধিক সমাবেশে হামলা করা হয়েছে, পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন ৩ জন নেতাকর্মী, নেতাকর্মীদের নামে মামলা হয়েছে ৭৫টি, গ্রেফতার করা হয়েছে ৩৩৮ জনের অধিক, আহত হয়েছেন ১ হাজার ৭৩০ জনের অধিক, নামসহ অজ্ঞাতনামা আসামীর সংখ্যা ২০ হাজারের অধিক।
বিএনপি নেতারা বলছেন, জ্বালানি তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় মূল্যবৃদ্ধি, অর্থনৈতিক সঙ্কট, লুটপাট, অর্থপাচারসহ নানা কারণে সরকার পুরোপুরিভাবে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশগুলোতে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ দেখে সরকার ভীত হয়ে পড়েছে। তাই তারা বিএনপি যে কোন কর্মসূচি দেখলেই হামলা করছে। এমনকি মোমবাতী প্রজ্জ্বলনের মতো নিরীহ কর্মসূচিও তারা সহ্য করতে পারছে না। তবে ভয় দেখিয়ে বিএনপির আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না। তারা বলছেন, সারাদেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর যতই গুলি, হত্যা, হামলা, মামলা, গ্রেফতার করা হচ্ছে ততই সরকারবিরোধী আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা বাড়ছে, নেতাকর্মীরা ইস্পাত কঠিন ঐক্য ও শপথ নিয়ে রাজপথে রক্ত ঠেলে দিতে প্রস্তুত হচ্ছে। যার উদাহরণ পুলিশের গুলিতে ইতোমধ্যে তিনজন নিহত ও অসংখ্য আহত হওয়ার পরও আন্দোলন আরো বেগবান হয়েছে।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, আওয়ামী লীগ এখন যে কৌশল নিয়ে বিএনপির ওপর হামলা করছে সেটি ভয় দেখানোর জন্য। তারা সরকার ও রাষ্ট্রকে এক করে ফেলেছে। একদিকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা হামলা করছে অন্যদিকে তাদের সাথে পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্য অংশ নিচ্ছে। এটি আওয়ামী লীগের দেউলিয়াত্বের প্রমাণ। কারণ তারা এখন আর বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে পারছে না, এমনকি দলীয়ভাবেও না। এজন্য পুলিশ-প্রশাসনের সহায়তায় বিএনপিকে দমনের চেষ্টা করছে।
বিএনপি নয়, আওয়ামী লীগই ভয় পেয়েছে উল্লেখ করে আলাল বলেন, যখন কেউ ভয় পায় তখন তাদের আচরণ হয় উছৃঙ্খল, যা এখন আওয়ামী লীগ করছে। কোন কিছুতেই বিএনপি ভীত নয়। বর্তমান সরকারের পতন নিশ্চিত করা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন আদায় করতে কৌশলগতভাবে বিএনপি আন্দোলন এগিয়ে নিবে।
বিএনপির এই নেতা অভিযোগ করে বলেন, দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া এবং বিগত দিনে ছাত্রলীগের পদবীধারী কিছু পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তার কারণে পুরো পুলিশ ও প্রশাসনকে জনগণের প্রতিপক্ষ বানিয়ে দেয়া হয়েছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেন, শেখ হাসিনা তার পেটোয়া বাহিনী দিয়ে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে। গত ১৪ বছরে পেলে-পুশে একটা নেকড়ে বাহিনী তৈরি করেছে। তাদেরকে লেলিয়ে দিয়েছে বিএনপির বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রকামী মানুষদের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা দেশের বাহিরে গেছেন, তিনি দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে কাকে কি দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন, কাকে কিভাবে মারতে হবে, বিএনপি’র কোন কর্মসূচিতে কিভাবে হামলা হবে বলা মুশকিল; এ ধরনের দিকনির্দেশনা হয়তো দিয়ে গেছেন অনেকে বলছে। আমরা সেটার প্রমাণের বহিঃপ্রকাশ অক্ষরে অক্ষরে দেখতে পেলাম। তবে বিএনপি চুপ করে থাকবে, এটা মনে করার কোন কারণ নেই। আমরা প্রতিটি রক্ত কণার উপযুক্ত জবাব দিব। প্রতিটি আঘাতের উপযুক্ত জবাব দিব।
বিএনপি ও গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩১ জুলাই ভোলায় বিএনপির প্রতিবাদ মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা আব্দুর রহিম। একই ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে পরবর্তীতে নিহত হন জেলা ছাত্রদলের সভাপতি নূরে আলম। আর ১ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন যুবদল কর্মী শাওন। এছাড়া গত ২২ আগস্ট থেকে বিএনপি ঘোষিত থানা ও উপজেলা পর্যায়ে বিক্ষোভ সমাবেশে ৪০টির বেশি স্থানে হামলার ঘটনা ঘটে। এছাড়া যশোরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির মরহুম নেতা তরিকুল ইসলামসহ বেশ কয়েকটি স্থানে নেতাকর্মীদের বাড়িতে হামলা হয়েছে। ফেনীতে ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টুসহ অসংখ্য নেতাকর্মীর ওপরও হামলার ঘটনা ঘটেছে।
খুলনা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শফিকুল আলম মনা বলেন, বিএনপির নেতাকর্মীদের রক্তে সারা দেশ রঞ্জিত। প্রয়োজনে আরও রক্ত দিয়ে গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনা হবে। তিনি বলেন, এই সরকার চরমভাবে ব্যর্থ, অযোগ্য ও লুটেরা। পদে পদে তাদের ব্যর্থতা ও তাবেদারি প্রমাণিত। জনগণ তাদের সঙ্গে নেই। এরা টিকে আছে বিদেশী প্রভু ও দেশীয় অস্ত্রবাজ বাহিনীর ছত্রছায়ায়। জ্বালানি তেল, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ জানাতে বিএনপির কর্মসূচিতে গুলি করে তিনজনকে হত্যা করা হয়েছে। আহত অসংখ্য। উল্টো তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক শিষ্ঠাচারকে ধ্বংস করে বরকত উল্লাহ বুলু ও তার স্ত্রীর ওপর হামলা চালিয়ে রক্তাক্ত করা হয়েছে। বনানীতে মোমবাতি প্রজ্জ্বলনের মতো নীরিহ কর্মসূচিসহ সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে পৈশাচিক হামলা হয়েছে।
বিএনপি ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত ফিরে যাবে না মন্তব্য করে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আমরা রাস্তায় নেমে গেছি। আমাদের পরিবারকে বলেছি, আমাদের জীবনের চিন্তা করবা না, দেশকে মুক্ত করার আন্দোলনে আছি। আমরা কেউ ফিরে যাব না। আমরা শেখ হাসিনার পতন ঘটিয়ে আমরা বাড়ি ফিরে যাব। এই যে রাস্তায় নেমেছি হয় জীবন দিয়ে যাব, অথবা বেঁচে থাকলে দেশকে মুক্ত করব।
পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকার সমালোচনা করে তিনি বলেন, পুলিশ ও প্রশাসনের অনেকেই আজকে তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব ভুলে আওয়ামী লীগের ভূমিকা পালন করছে, এটা শুধুমাত্র বাংলাদেশের সংবিধানের লঙ্ঘন নয়; এটা আন্তর্জাতিক ক্রাইমের আওতায় পড়ে। তাদের সকলকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে কেউ রেহাই পাবে না। যারাই বাড়াবাড়ি করবে তাদের কারও রক্ষা হবে না।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আওয়ামী লীগ আরেকটি পাতানো নির্বাচন করে ক্ষমতায় যাওয়ার পাঁয়তারা করছে। সে কারণে আবার তারা বিরোধী দলের ওপর চড়াও হতে শুরু করেছে। গুলি, ভাঙচুর এবং হত্যা করে বিরোধী দলকে মাঠ থেকে সরিয়ে দিতে চায়। মাঠের ভেতরে একা থেকেই আওয়ামী লীগ নির্বাচন করতে চায়। এবার আর তা হবে না। আমরা এবার কোনোমতেই পরাজিত হব না। কারণ, এবার বিজয় লাভ করতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই।#
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন