পাবলিক পরীক্ষা, ভর্তি পরীক্ষা থেকে শুরু করে বিসিএস পরীক্ষা পর্যন্ত সর্বত্র প্রশ্নপত্র ফাঁস ও নিয়োগ বাণিজ্যের একটি দুষ্টচক্র জাতির ভবিষ্যতকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিগত দশকে প্রায় প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা অনেকটা অনিবার্য বাস্তবতা হয়ে দাঁড়ালেও সরকারের সংশ্লিষ্টদের কঠোর অবস্থানের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা অনেকটা কমে এসে সহনীয় মাত্রায় দাঁড়ালেও এখন আবার নতুন করে প্রশ্নপত্র ফাঁসের আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সারাদেশে চলমান এসএসসি, দাখিল ও সমমান পরীক্ষা বেশ নির্বিঘেœই চলছিল। দিনাজপুর শিক্ষাবোর্ডের কুড়িগ্রামের একটি কেন্দ্রের সচিবের বইয়ের শেল্ফে এসএসসির ৬টি বিষয়ের প্রশ্নপত্র একসাথে উদ্ধার হওয়ার মধ্য দিয়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র ফাঁসের পুরনো রোগ আবারো ধরা পড়ল। আপাত দৃষ্টিতে ধারণা করা হচ্ছে, ২০১৮ সালের পর এই প্রথম প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটল। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুসারে, দিনাজপুরের ভুরুঙ্গামারিতে প্রশ্নফাঁসের ঘটনাটি আকস্মিক। জনৈক কোচিং শিক্ষকের কাছে শিক্ষার্থীরা ফাঁস হওয়া লিখিত প্রশ্ন নিয়ে গেলে পরীক্ষার পর তা মূল প্রশ্নের সাথে হুবুহু মিল পাওয়া গেলে তিনি স্থানীয় সাংবাদিকদের জনান। সাংবাদিকরা স্থানীয় প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পুলিশ বিষয়টি উৎঘাটন করতে সক্ষম হয়। এভাবে উদঘাটিত না হলেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা অন্য কোথাও ঘটছে না তা হলফ করে বলা যাবে না।
প্রশ্নপত্র ফাঁস করে সংশ্লিষ্ট চক্রের সদস্যদের কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ার ঘটনা ইতোমধ্যে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমের অনুসন্ধানী রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে। অভিযুক্তদের গ্রেফতার ও বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছে। সেই সাথে পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র সরবরাহ এবং প্রশ্নপত্র নির্বাচনের ক্ষেত্রে বেশকিছু নিয়ম-কানুন ও বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। এর ফলে পাবলিক পরীক্ষায় আগেভাগে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দেয়ার সুযোগ অনেকটাই কমে গেছে। তবে তাতেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের পুরনো ব্যাধি যে নির্মূল হয়নি, ভুরুঙ্গামারীর এক কেন্দ্রসচিবের কক্ষে ৬টি বিষয়ের প্রশ্নপত্র উদ্ধারের মধ্য দিয়ে সেটা প্রমাণিত হলো। পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে একটি বিষয় ছাড়া বাকি সব বিষয়ের প্রশ্নপত্রের প্যাকেট খোলা পাওয়ার তথ্য খবরে প্রকাশিত হয়েছে। ইতোমধ্যে অনুষ্ঠিত দিনাজপুর বোর্ডের চারটি বিষয়ের পরীক্ষা বাতিল এবং দু’টি স্থগিত করা হয়েছে। একটি কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় পুরো শিক্ষাবোর্ডের পৌন দুইলাখ শিক্ষার্থীকে হতাশা ও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো, প্রশাসন যত নিয়ম-শৃঙ্খলা বা কড়াকড়ি আরোপ করুন, শিক্ষা ও পরীক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তা অনেক ক্ষেত্রেই থোড়াই কেয়ার করছে।
শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষা মানে শুধু লিখতে পড়তে জানা বা উচ্চ ডিগ্রী অর্জনের পরিসংখ্যানগত প্রবৃদ্ধি নয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অন্যতম জাতীয় লক্ষ্য হচ্ছে নৈতিক মানসম্পন্ন সুনাগরিক গড়ে তোলা। আমাদের আজকের সমাজবাস্তবতায় যে সর্বব্যাপী অবক্ষয়, ঘুষ-দুর্নীতি, মাদক ও সন্ত্রাসের মহামারি দেখা যাচ্ছে, তার মূলে রয়েছে শিক্ষার মানহীনতা, নিয়োগ বাণিজ্য, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অপরাজনীতি। পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস থেকে শুরু করে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগ এবং পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচনে অনিয়ম-দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতাসীনদের দলীয় আধিপত্য শিক্ষার মানহীনতা, অনৈতিকতা ও অবক্ষয়ের জন্য দায়ী। যে শিক্ষক বা কর্মকর্তা লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে নিয়োগ পেয়েছেন, তিনি শুধু বেতনের টাকায় সন্তুষ্ট নন। কোচিং বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য এবং প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা কামাই করে তিনি তার বিনিয়োগ বহুগুণে পকেটে ভরতে চাইবেন। এটাই স্বাভাবিক। এভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক বা কর্মকর্তারা তাদের পেশাকে মহৎ পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন না। তাদের অধীনে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাও অনৈতিকভাবে বেড়ে উঠে। আজকে আমাদের সমাজে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের কিশোর গ্যাং ও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। টিআইবি’র দুর্নীতি সূচকে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত সেক্টরগুলোর মধ্যে শিক্ষা বিভাগ অন্যতম। সমাজ ও রাষ্ট্রের অবক্ষয়, দুর্নীতি-লুণ্ঠন ও দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করতে হলে প্রথমেই দেশের শিক্ষা বিভাগকে ঘুষ-দুর্নীতি ও অপরাজনীতি থেকে মুক্ত করতে হবে। সর্বক্ষেত্রে মেধাবী ও যোগ্যদের দায়িত্বশীল পদে বসাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে স্বচ্ছ ও রাজনীতি নিরপেক্ষ ভূমিকা নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন