সংবিধান অনুযায়ী ২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওার কথা। জাতিসংঘসহ উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলো চায় সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চায় সরকারে থেকেই ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের মতোই পাতানো নির্বাচন। অন্যদিকে জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে মাঠের বিরোধী দল হিসেবে বিএনপিসহ দেশের অধিকাংশ দল চায় নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। এ নির্বাচনকে সামনে রেখে আন্দোলনে নেমেছে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। একই সঙ্গে ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার দাবিতে আন্দোলনরত অন্যান্য দলগুলোর সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচি পালনের লক্ষ্যে সংলাপ চালিয়ে যাচ্ছে দলটি। এতে বেশ সাড়া পাচ্ছে। বিএনপির এই সুচিন্তিত কর্মকৌশলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকদের মাথায় চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। ফলে টানা তিন টার্ম থেকে ক্ষমতায় থাকা দলটির বিএনপিকে ভয়ভীতি দেখাতে নেতাদের নামের তালিকা তৈরি করছে; পুরনো মামলা নতুন করে চালু করছে। একই সঙ্গে আইন শৃংখলা বাহিনী এবং দলটির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের মাঠে নামিয়ে বিএনপির আন্দোলনের গতিরোধ করতে চাচ্ছে। এতে করে রাজপথে সংঘাত সংঘর্ষ-রক্তারক্তি এবং বিএনপির পাঁচজন নেতার প্রাণহানি ঘটেছে। কিন্তু বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন এমন এক ডজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা কোনো কিছুতেই থামবেন না। যত বাধাই আসুন তারা রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলকে কোনঠাসা করবেন। কারণ তারা বিশ্বাস করেন ‘রাজপথ যে দলের নিয়ন্ত্রণে থাকে নির্বাচনে ফলাফলও সে দল পক্ষ্যে যায়’।
২০১৮ সালের নির্বাচনে ‘দিনের ভোট রাতে’ হয়ে যাওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বিএনপি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে দেশব্যাপী কর্মসূচি পালন করছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির এসব কর্মসূচিতে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন তারা। কর্মসূচিতে বাধা, হামলা, মামলা এমনকি পুলিশের গুলিতে সহযোদ্ধাদের মৃত্যুতেও ভীতি নয় বিএনপি নেতাকর্মীরা। বরং শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে আন্দোলন আরও বেগবান করার শপথ নিয়েছেন তারা। বিএনপির নীতিনির্ধারণী নেতারা মনে করেন, মাঠের আন্দোলনে চাঙ্গা ভাব এবং জনসম্পৃক্ততা দেখে সরকার এরই মধ্যে ভড়কে গিয়েছে। তাই চলমান আন্দোলন ঠেকাতে এবং বানচাল করতে তারা নানারকম কূটকৌশলের আশ্রয় নিতে পারে। অতীতের মতো নিজেরা অপকর্ম করে দায় চাপাতে পারে বিএনপির উপর।
এজন্য আন্দোলন পরিচালনায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছে বিএনপি। শীর্ষ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত বার্তা পৌঁছে দেয়া হয়েছে কর্মসূচি পালনে সতর্ক থাকার। আঘাত এলে তবেই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বলা হয়েছে। ছদ্মবেশে কেউ যেন কর্মসূচিতে অনুপ্রবেশ করে বানচাল করতে না পারে সেজন্য অঙ্গসংগঠনের নেতাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এছাড়া যে কোন কর্মসূচির আগে সংশ্লিষ্ট নেতাদের নিয়ে বৈঠক করছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেখানেই দেয়া হচ্ছে কৌশলের দিকনির্দেশনা। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, জনআকাক্সক্ষার সাথে সঙ্গতি রেখে কর্মসূচি নিয়ে আমরা মাঠে থাকবো। এসব কর্মসূচি বানচাল করতে সরকার ষড়যন্ত্র করবে মেনে নিয়েই আন্দোলন পরিচালনা করছি। তবে আমরা সকর্ত আছি, যে কোন ধরণের প্রতিবন্ধকতা, আঘাত আসলে রুখে দেয়া হবে। এখন আমরা যারা নীতিনির্ধারক আছি তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে কর্মীদের সাথে তাল মেলাবো নাকি পিছিয়ে থাকবো। তবে কর্মীরা মাঠে নামলে নেতাদের না নেমে উপায় থাকবে না।
বিএনপি সূত্রে জানা যায়, গত ২২ আগস্ট থেকে জ্বালানি তেল, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, নেতাকর্মী হত্যার প্রতিবাদে উপজেলা, থানা, পৌরসভা ও ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে বিক্ষোভ সমাবেশ করছে বিএনপি। এসব কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে উজ্জীবিত হয়ে উঠেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। বিএনপি নেতারা অভিযোগ করে বলেন, জনস্বার্থে এবং জনগণের সাথে সম্পৃক্ত ইস্যুতে বিএনপি যখন মাঠে-ঘাটে, গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে জনগণকে সাথে নিয়ে সরকার পতনের আন্দোলন বেগবান করছে তখনই নতুন করে ফের হামলা-মামলা-গ্রেফতার শুরু হয়। এর মাধ্যমে বিএনপি নেতাকর্মীদের মাঝে ভীতি ছড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
বিএনপির তথ্য অনুযায়ী, গত ৩১ জুলাই থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলমান কর্মসূচি চলাকালে ৫ জন নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে ২ হাজার ৭৬৮ জন। এর মধ্যে পুলিশের গুলিতে ৪ জন (ভোলায় আব্দুর রহিম, নূরে আলম, নারায়ণগঞ্জে শাওন, মুন্সীগঞ্জে শহীদুল ইসলাম শাওন) এবং আওয়ামী লীগের হামলায় যশোরে একজন। একই সময়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৭৫টি মামলা করা হয়েছে, যেগুলোতে আসামী করা হয়েছে ২৫ হাজার জনকে। এর মধ্যে এজহারভুক্ত আসামী ৫ হাজার ৪৭০ জন।
এছাড়া সারাদেশে অন্তত অর্ধশতাধিক স্থানে হামলার ঘটনা ঘটে, হামলা-ভাঙচুর করা হয় সিনিয়র নেতাদের বাড়ি-ঘর এবং গাড়িতে। যশোরে স্থায়ী কমিটির মরহুম সদস্য তরিকুল ইসলাম ও লক্ষীপুরে কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানীসহ বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীর বাড়িতে হামলা করা হয়। ফেনীতে ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টুর গাড়িবহরে ও কুমিল্লায় আরেক ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লাহ বুলুসহ তার স্ত্রীর ওপর হামলা করে রক্তাক্ত করা হয়। পরবর্তীতে ঢাকায় মোমবাতী প্রজ্জ্বলনের কর্মসূচিতে স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, সাংগঠনিক সম্পাদক শ্যামা ওবায়েদ, নির্বাহী কমিটির তাবিথ আউয়ালের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর থেকেই বদলে যায় বিএনপির কর্মসূচির চিত্র। এখন প্রতিটি সমাবেশেই হামলা প্রতিরোধে বিএনপি নেতাকর্মীরা বাঁশের লাঠিতে জাতীয় পতাকা বেধে অংশগ্রহণ করছেন। প্রস্তুত থাকছেন যেকোন ধরণের বাধা-হামলা প্রতিরোধে।
এর মধ্যে গত বুধবার নতুন করে বিভাগীয় শহরে মহাসমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। আগামী ১২ অক্টোবর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০টি বিভাগীয় শহরে এসব সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। ধারাবাহিক এসব কর্মসূচি সরকারের পতন নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত চালিয়ে যেতে চায় দলটি। প্রয়োজনে ধীরে ধীরে আন্দোলনের গতি বেগবান ও জোরদার করারও পরিকল্পনা নীতিনির্ধারকদের।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ বলেন, চলমান আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকেই হামলা, মামলা, গ্রেফতার বেড়ে গেছে। অতীতের মতো গায়েবী মামলা দেয়া হচ্ছে। তবে নেতাকর্মীরা এবার প্রতিরোধ করা শুরু করেছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সংঘর্ষে জড়াতে পারে, সরকার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে আন্দোলন দমনে চেষ্টা করতে পারে। ইতোমধ্যে বিএনপি নেতাকর্মীদের তালিকা করতে চিঠিও দিয়েছে পুলিশ। তবে আমরা সতর্ক আছি। কোন উস্কানিতে, ষড়যন্ত্রে পা দিব না। নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণকে সাথে নিয়ে এই সরকারের পতন নিশ্চিত করা হবে। এরপর নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব এডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, বিএনপির চলমান আন্দোলন একদিকে যেমন নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করেছে, অন্যদিকে দেশের মানুষকেও সম্পৃক্ত করেছে। তবে আন্দোলন পরিচালনায় আমরা পরিপূর্ণ সতর্ক। কারণ যে দলটি (আওয়ামী লীগ) সরকারে আছে তারা অনেক পুরনো ও অভিজ্ঞ। একারণে তাদের কুবুদ্ধির মাত্রাও বেশি। তারা ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশনে (নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে এবং অন্যকে অপদস্ত করতে ছদ্মবেশে অপকর্ম করে অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে দেয়া) পারদর্শী। এটার কোন প্রমাণ করতে হয় না, কারণ তারা অবিরাম প্রপাগান্ডার মাধ্যমে সেটাকে প্রমাণ করতে চায়। আমরা আওয়ামী লীগের চক্রান্ত সম্পর্কে জানি এবং আমাদের উন্নয়ন সহযোগী ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোকেও এসব বিষয়ে জানানো হয়েছে। আমাদের এবারের আন্দোলন সরকারের পতন নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত চালিয়ে যাবো। ধাপে ধাপে এটি জোরদার করা হবে।
দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, সরকারের আচরণ দস্যু দলের মতো। তারা ঘোষণা দিয়েই বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর হামলা, গুলি করে, পিটিয়ে হত্যা করার যজ্ঞে মেতে উঠেছে। তিনি বলেন, সম্প্রতি তথ্যমন্ত্রী বলেছেন ‘বিএনপি’র সব সমাবেশ প্রতিহত করা হবে।’ এর আগে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বিএনপি’র কর্মসূচি প্রতিহতের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও শাসকদলের ক্যাডারদের বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে হামলা চালাতে লেলিয়ে দেয়া হয়েছে। পুলিশ ও দলীয় সন্ত্রাসীদের দিয়ে হামলা করিয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হত্যা, খুন-জখম ও পঙ্গু করার পর প্রধানমন্ত্রীসহ ওবায়দুল কাদের ও হাছান মাহমুদ সাহেব’রা যে ভাষায় কথা বলছেন তাতে মনে হয়-এসব সহিংস ঘটনায় তারা মেতে উঠেন আনন্দে। দুর্বিনীত আওয়ামী শাসকগোষ্ঠীর একমাত্র আরাধ্য যেন তেন প্রকারে ক্ষমতায় থাকা। তবে দেশের মানুষ দুঃশাসনের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে। গুলি করে, হত্যা করে, হামলা করে প্রতিবাদী কন্ঠরোধ করা যাবে না, সরকারের পতন ঠেকানো যাবে না।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, গত ২২ আগস্ট থেকে জনগণের দাবি নিয়ে আমরা আন্দোলন শুরু করেছি, সেই আন্দোলনে যখন মানুষ আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের আহবানে জেগে উঠেছে, তখন তারা একে দমন করার জন্য সন্ত্রাসের আশ্রয় নিয়েছে। জুলুন নির্যাতনের পথ নিয়ে আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছে। তারা শান্তিপূর্ণ সমাবেশে, শান্তিপূর্ণ মিছিলে, কর্মসূচিতে লাঠি, বন্দুক এবং টিয়ার গ্যাস নিয়ে আক্রমণ শুরু করেছে। তবে জনগণের উত্তাল তরঙ্গ শুরু হয়েছে। একটা দূর্বার গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই সরকারকে আমরা পদত্যাগে বাধ্য করবো।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন