বর্তমান বিশ্বে পর্যটন একটা লাভজনক শিল্প। বিশ্ব জুড়েই চলছে এ শিল্পের চরম প্রতিযোগিতা। পর্যটন শিল্পের প্রসার ঘটিয়ে এশিয়ার অনেক দরিদ্র দেশও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে, সমৃদ্ধ করছে তাদের অর্থ ভান্ডার। প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে বিভিন্ন দেশ এগিয়ে চলেছে। শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান, ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর আজ আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে। তাদের অব্যাহত প্রয়াসে আকর্ষণ করছে লাখ লাখ পর্যটকদের। আয় করছে কোটি কোটি ডলার। তাদের রাজস্ব আয়ের বিরাট অংশ যোগান আসছে পর্যটন শিল্প থেকে।
আমাদের দেশ প্রাকৃতিক স¤পদ ও সৌন্দর্য্যে ভরপুর। কোন কোন অঞ্চল সামান্য ব্যয়ে আন্তরিক প্রচেষ্টায় পর্যটন স্পটে রূপান্তর মোটেই কঠিন বা ব্যয়সাধ্য ব্যাপার নয়। সিলেট একটি আকর্ষণীয় শহর, আধ্যাত্মিক রাজধানী নামে খ্যাত। স¤পদের দিক দিয়েও পিছিয়ে নেই। এর ইতিহাস প্রাচীন। শতবর্ষ পূর্বে আঁকাবাঁকা টিলা ও পাহাড়ের মাঝখানে নদীর তীরে গড়ে উঠে এ সুন্দর শহর। সিলেট একসময় কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, জ্ঞানী, গুণী, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পদচারণায় মুখরিত হতো। এ শহরের গুণগান গেয়ে অনেকেই লিখেছেন গান, কবিতা, শিল্পী এঁকেছেন ছবি, সাহিত্যিক রচনা করেছেন সাহিত্য। পরিতাপের বিষয়, আমরা এ সুন্দর শহরের চাকচিক্য সৌন্দর্য্য আর প্রকৃতি প্রদত্ত আকর্ষণকে ধরে রাখতে পারিনি। আবাসস্থল গড়ে তুলতে কেটে সমতল করা হচ্ছে এর চারপাশের সবুজ টিলা। বর্ষাকলে উপর থেকে ভেসে আসা পলি মাটিতে সুরমা নদীর নাব্য হারালেও এ থেকে মাটি উত্তোলন করা হচ্ছে না। সিলেট আজ তার অতীত ঐতিহ্যকে হারাতে বসেছে।
সিলেটে রয়েছে বেশ ক’টি আকর্ষণীয় স্থান ও স্থপতির নিদর্শন যা পর্যটকদের আকর্ষণ করে থাকে। ঐতিহ্যবাহী আলী আমজাদের ঘড়ি আর চান্নীঘাটের সিঁড়ি বহুদিন থেকে পরিচিত প্রাচীন স্থাপত্যের অনুপম নিদর্শন হিসেবে। ১৯৩৬ সালে নির্মিত কীনব্রিজের পশ্চিম পার্শ্বে অবস্থিত আলী আমজাদের ঘড়ি। এর বড় বড় কাটা দূর হতে চোখে পড়ে। ঘড়ির জন্যে নির্মিত হয়েছে বড় আকারের একটি কাঠামো। আলমীরার মত এ কাঠামোটিকে অনেকেই ঘড়িঘর বলে সম্বোধন করে। ঘড়িটির সাথে বেশ কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা জড়িত। পৃথিম পাশার জমিদার ছিলেন আমজাদ খাঁ। তাঁর পিতা ছিলেন জমিদার আলী আহমদ খাঁ। দানবীর আমজাদ খাঁ দিল্লীতে দেখে এসেছিলেন অনুরূপ একটি বিশাল ঘড়ি। দর্শনীয় স্থানে এমন একটি ঘড়ি স্থাপনে তিনি মন স্থির করলেন। অবশেষে স্থির হলো এটা স্থাপিত হবে সুরমার তীরে সিলেট শহরের প্রবেশ মুখে। দর্শনীয় স্থানে এমন একটি বিশাল ঘড়ি স্থাপন প্রযুক্তির দিক থেকে যেমন ছিল বিস্ময়কর তেমনি সামাজিক দিক থেকেও ছিল এর উল্লেখযোগ্য অবদান।
১৮৭৪ সালে ইংরেজ সরকার প্রশাসনিক সুবিধার্থে সিলেটকে আসাম প্রদেশে অন্তর্ভুক্ত করে। প্রতিবাদ উঠলো সিলেটে। ভারতের বড়লাট তখন নর্থব্রæক। সিলেটবাসীকে সান্ত¦না দিতে তিনি সিলেটে এলেন। সিলেটবাসী উত্তেজনার বশবর্তী না হয়ে বড় লাটকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে সুরমা নদীর বুকে চান্নী ঘাটের সিঁড়ি নির্মাণ করে। ২২টি সোপানে নির্মিত নদী ঘাটের এ সিঁড়িগুলো তখন দর্শনীয় হয়ে উঠে। এসময় আলী আমজাদ ঘড়িটি প্রত্যক্ষ করলেন। এ সিঁড়ি ও ঘড়ি তখনকার দিনে ছিল দর্শকের জন্যে এক বিস্ময়। সিলেটে ছড়া হলো ‘চান্নী ঘাটের সিঁড়ি, আলী আমজাদের ঘড়ি আর বঙ্ক বাবুর দাড়ি’। উল্লেখ্য, তখন সিলেটে বঙ্ক বাবু নামক এক ভদ্রলোক ছিলেন তার মুখের দাড়ির দীর্ঘতা ছিল প্রায় ১ ফুটের মত । দাড়িগুলো এমনভাবে গোছানো থাকতো যা দর্শকের আকৃষ্ট করতো। সিলেটের আসামভ‚ক্তি ও লর্ড নর্থ ব্রæকের সিলেট আগমনের সাথে চান্নী ঘাটের সিঁড়ি আর আলী আমজাদের ঘড়ি ঘনিষ্ট হয়ে আছে।
সিলেট শহরের উত্তর পূর্ব কোণে অবস্থিত বাদশাহী আমলের কারুকার্যময় শাহী ঈদগাহ আর সুরমা নদীর উপর কীনব্রীজ সিলেটে পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। সুরমা নদীর উপর নির্মিত এ ব্রীজটি সিলেটকে দেশের অন্যান্য এলাকার সাথে যুক্ত করে রেখেছে যুগ যুগ ধরে। ব্রীজটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯৩৩ সালে আর সম্পন্ন হয় ১৯৩৬ সালে। এতে ব্যয় হয় ৫৬ লাখ টাকা। দর্শনীয় এ ব্রীজটির দৈর্ঘ্য ১১৫০ ফুট আর প্রস্থে ১৮ ফুট। তৎকালীন আসামের গভর্ণর মাইকেল কীন-এর নামানুসারেই ব্রীজটির নামকরণ করা হয় কীনব্রীজ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে লীলাভ‚মি সিলেটের শোভাবর্ধনে সহায়ক হিসাবে কাজ করছে ঐতিহ্যবাহী এ কীনব্রীজ। অগনিত রিক্সা নানা প্রকার যানবাহন ও হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন ও ব্রীজ দিয়ে যাতায়াত করে। এখানকার সৌন্দর্য্য বিমোহিত করে পর্যটকদের।
সিলেটের আরেক দশর্নীয় স্থান শাহী ঈদগাহ। সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মিত এটি সিলেটের প্রাচীন ঐতিহ্যের এক নিদর্শন। একটি ছোট্ট টিলার উপর সুন্দর কারুকার্য খচিত এ ঈদগাহ নির্মাণ করেন ফৌজদার ফরহাদ খাঁ। তিনি ছিলেন স¤্রাট আওরঙ্গজেব কর্তৃক নিয়োজিত সিলেটের তদানীন্তন শাসনকর্তা। তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগ, তদারকী ও তত্ত¡াবধানে ঐতিহাসিক শাহী ঈদগাহ নির্মিত হয়। তিনদিকে নিচু খোলা মাঠ, প্রশস্ত পুকুর আর পরিকল্পিত উপায়ে রোপিত বৃক্ষরাজি ঈদগাহের আকর্ষণ বৃদ্ধি করেছে। এ ঈদগাহে রয়েছে, ২২টি সিঁড়ি ১৫টি গম্বুজ এবং ছোট বড় ১০টি গেইট। একই সাথে এখানে প্রায় দেড় লাখ মুসল্লী ঈদের নামাজ আদায় করতে পারেন। শাহী ঈদগাহের দূরত্ব সিলেট রেলওয়ে স্টেশন হতে ৫ কিলোমিাটার আর ওসমানী বিমানবন্দর হতে ৭ কিলোমিটার। ঈদগাহটি সিলেট শহরের কেন্দ্রবিন্দু হতে ২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট। ১৯৪৫-৪৬ সালে পাক, ভারত, বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর সেনানী মোহা¤মদ আলী জিন্নাহ, মহাত্মা গান্ধী, শওকত আলী, হোসেন শহীদ সোহারাওয়ার্দীসহ অগনিত রাজনীতিবিদ এ ঈদগাহ ময়দানে স্বাাধীনতার স্বপক্ষে বক্তৃতা করে সিলেটকে এবং সিলেটের মানুষকে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন।
পর্যটকদের আকর্ষণে সিলেটে আছে অনেক প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক এলাকা। ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ির’ দেশ এ সিলেট। বিস্তৃত আছে দেড় শতাধিক চা বাগান। এসব বাগান হতে দেশের ৯৫ ভাগ চা উৎপন্ন হয়ে থাকে। এসব বাগানে কর্মরত চা শ্রমিকদের চালচলন, রীতিনীতি, আচার-আচরণ জীবন ও কর্মধারা বেশভ‚ষা এবং চা কুড়ানো পদ্ধতি দর্শকদের আকৃষ্ট ও অভিভ‚ত করে। সিলেটে রয়েছে দেশের বৃহত্তম জলপ্রপাত যা বড়লেখা পাথারিয়ার মাধবকুÐে অবস্থিত। নতুনভাবে আবিষ্কৃত হামহাম জলপ্রপাত পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত একটি পর্যটন স্পট হিসেবে ইতিমধ্যে পরিচিতি লাভ করেছে। দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত হলেও এ জলপ্রপাত দেখতে প্রতিনিয়ত শত শত মানুষ ভিড় করে। হামহাম জলপ্রপাতে যাতায়াতের জন্য এখনো রাস্তাঘাট তৈরি হয়নি, খাওয়া থাকার বা বিশ্রামের সুযোগ-সুবিধা নেই। পর্যটকদের আকর্ষণে এ ব্যপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন পর্যটন কর্পোরেশনের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। মাত্র ক’বছর আগে সিলেট শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে গোয়াইনঘাট উপজেলায় রাতারগুল নামক এক নতুন পর্যটন স্পট এর সন্ধান মিলেছে। বর্ষা মৌসুমে পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নৌকা বা স্পিড বোটে সেখানে ভিড় জমান অসংখ্য ভ্রমণ পিপাসু পর্যটক। সরকার এর উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছেন।
জৈন্তাপুর রাজবাড়ী, সুনামগঞ্জের বিল ও হাওর, টেকের ঘাটের চুনাপাথর আহরণ কেন্দ্র, ছাতক থেকে ভোলাগঞ্জের রোপওয়ে লাইন হরিপুর আর কৈলাস টিলার গ্যাসফিল্ড আকর্ষণীয় ও দর্শনীয় স্থান। সিলেট শহর প্রান্তে অবস্থিত আউলিয়াকূল শিরোমণি হযরত শাহজালাল (রঃ) ও শাহপরাণ (রঃ) অগনিত পীর আউলিয়া দরবেশের মাজার, উপকন্ঠে সারিবদ্ধভাবে সাজানো টিলারাজি, মানিকপীর টিলা, মনারায়, সিভিল সার্জন টিলা, গির্জা, ফরেস্ট হিলস আবহাওয়া অফিস, এমসি কলেজ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, আলুর তল, পুলিশ লাইন, ক্যাডেট কলেজ, বন বিদ্যালয়, ওসমানী বিমানবন্দর ও হাসপাতাল, ন্যাচারাল পার্ক, পর্যটন মোটেল, ক্যান্টনমেন্ট এর মত আকর্ষণীয় স্থান। কর্তৃপক্ষের কার্যকর উদ্যোগ, আন্তরিকতা, প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয় করলে মাত্র ৩/৪ বছরে সিলেটকে সৌন্দর্য্যরে লীলাভূমিতে ও পর্যটন শহরে রূপান্তর কোন কঠিন কাজ নয়। প্রাচীন ঐতিহ্যে লালিত সিলেটকে ইচ্ছামত সাজিয়ে পার্ক, উদ্যান, ক্ষুদ্রাকার বনাঞ্চল আর শহরের রাস্তার অবৈধ স্ট্যান্ড উঠিয়ে যানজটমুক্ত করে শহরকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রেখে পর্যটন শহরে রূপান্তর করলে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আগমন বাড়বে। প্রচুর আয় করাও সম্ভব হবে।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন