অপরাধ বাড়ছে। বদলেছে অপরাধের ধরণ। নিত্য নতুন কৌশলে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। ধর্ষণের পাশাপাশি বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়। শিশুরাও নিরাপদ নয়। নৃশংস হত্যার শিকার হচ্ছে অবুঝ শিশু। কিশোররা ভুগছে হতাশায়। ভয়ঙ্কর রুপ নিয়েছে কিশোর গ্যাং কালচার। শুধু রাজধানীতেই এক রাতে অর্ধশত ছিনতাইকারি গ্রেফতারের ঘটনা ভাবনার বিষয়। শিক্ষিত যুবকরাও জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন ধরনের অপরাধে। গ্যাঞ্জাম পার্টি, থুথু পার্টি, পরিচয় পার্টি, অজ্ঞান পার্টি, টানা পার্টিসহ বিভিন্ন নামে গড়ে উঠেছে অপরাধী চক্র। উদ্দেশ্য একটাই অভিনব পন্থায় টাকা পয়সা কেড়ে নেয়া। এছাড়া পেশাদারি বড় ধরনের প্রতারক চক্রতো রয়েছেই।
সমাজ বিজ্ঞানী ও মনোবিদরা বলেন, মহামারি করোনা পরবর্তী সারা বিশ্বেই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি অপরাধ বাড়ার পূর্বাভাস দিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। যে কারণে করোনা পরবর্তী সময়ে দেশে চুরি, ছিনতাই, দস্যুতা, ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতন বেড়েছে। খুন ও মাদকের ঘটনাও কম নয়। তারা বলেন, দেশে অর্থনৈতিক মন্দার কারনে অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে। কর্মহীন ছিন্নমূল কিছু মানুষও চুরি, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধকে বেছে নিচ্ছে জীবিকার তাগিদে। আবার নেশার অর্থের যোগান পেতে চুরি, ছিনতাই ও দস্যুতার মতো অপরাধে জড়াচ্ছে। এক কথায় সামাজিক বৈষম্য, অভাব, অনটন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নেতিবাচক প্রবণতার কারনে অপরাধ বাড়ছে।
গত মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর উত্তরা থেকে ছিনতাইয়ের অভিযোগে পুলিশ মো. আল রাজুসহ দুই যুবককে গ্রেফতার করে। পুলিশ বলছে, গ্রেফতারকৃতরা একটি চক্রের সদস্য। গ্রুপ ভিত্তিক এ চক্রের নাম ‘গ্যাঞ্জাম পার্টি’। এই চক্রের সদস্যরা অপরিচিতদের সাথে গায়ে পড়ে ঝগড়া করে। এরপর সব কেড়ে নেয়। তবে আশ্চর্য্যরে বিষয় হচ্ছে, এ চক্রের প্রধান রাজু হচ্ছেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তার সহযোগীরাও শিক্ষিত বেকার যুবক।
গত মাসের গোড়ার দিকের ঘটনা। আগারগাঁও রেডিও অফিসের রাস্তা ধরে রিকশারোহী এক ব্যাংক কর্মকর্তা ফিরছিলেন তালতলার বাসায়। ঘড়িতে তখন সময় রাত ৮টা। হঠাৎই তার রিকশাটি টেনে ধরেন হ্যান্ডসাম এক যুবক। রিকশারোহীকে উদ্দেশ্য করে গালিগালাজ করতে থাকেন। কারণ জানতে চাইলে রিকশারোহী তার গায়ে থুতু ফেলেছেন বলে অভিযোগ করতে থাকেন। রিকশারোহী যুবকের অভিযোগ অস্বীকার করতেই ওই যুবকের সঙ্গে মুহূর্তেই যোগ দেন আরো কয়েকজন। কয়েক সেকেন্ডর মধ্যেই যা হবার তা-ই হলো। ব্যাংক কর্মকর্তার মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ নিয়ে যুবকরা অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। ঘটনাস্থলের স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ওই এলাকায় ‘থুতু পার্টি’ নামে একটি চক্র গড়ে উঠেছে। এদের মধ্যে অনেকেই প্রভাবশালী পরিবারেরও সন্তান। যারা রাজনৈতিক নেতাদের কিংবা প্রভাবশালী বড় ভাইদের শেল্টারে রয়েছে।
আদাবর ও শ্যামলীতে ‘পরিচয় পার্টি’ নামে একটি ছিনতাইকারি চক্র গড়ে উঠেছে। এরা যে কোনো সময় কোন পথচারি কিংবা রিকশারোহীকে থামিয়ে তাকে পরিচিত বলে জানায়। কথা বলার ফাঁকে কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে তার সব কিছু কেড়ে নেয় এ চক্র।
গত মঙ্গলবার রাতে বনানীর একটি বস্তি ঘরের মাচা থেকে রুমান ইসলাম নামে ৭ মাসের এক শিশুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। শিশুটিকে তার মায়ের কোল থেকে নিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে প্রতিবেশি শহিদুল। পলিশ বলছে, শিশুটির ঘাতক শহিদুল নিজেও একজন কিশোর (১৪)। এ বয়সের একজন কিশোর ঠান্ডা মাথায় একটি শিশুকে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ করায় আইন প্রয়োগকারি সংস্থাও হিসেব মিলাতে পারছে না।
অপরাধ বিজ্ঞানীদের মতে, দারিদ্রতা, ভঙ্গুর পরিবার, পারিপার্শ্বিক প্রতিবেশ ও পরিবেশ, সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার শিথিল নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন অরুচিকর বিনোদন ও কল্পিত নায়ক-খলনায়কের মধ্যে সহিংস বিরোধ দৃশ্যের প্রদর্শন, গৃহবিবাদ, ভূমিহীনতা, মাদক সেবন-বিক্রি, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র কেনাবেচা ব্যবহার ইত্যাদি এ অপসংস্কৃতি শিশু কিশোর এমনকি যে কাউকেই হতাশা থেকে অপরাধী করে তুলতে পারে।
এ ধরনের সামাজিক অবক্ষয় ও অপরাধ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর মিসেস সালমা আক্তার ইনকিলাবকে বলেন, মহামারি করোনা পরবর্তী সারা বিশ্বেই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের বিষয়ে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। আমাদের দেশ বর্তমানে অর্থনৈতিক সঙ্কটে। বিশেষ কারে সাধারণ কিংবা খেটে খাওয়া মানুষ খুবই কষ্টের মধ্যে রয়েছে। অনেকের চাকরি নেই, কারো কারো কোনো কাজ নেই। অর্থনৈতিক সঙ্কটে কিশোররা বিপথগামী হবার একটা অন্যতম কারণ হতে পারে। অনেক অভিভাবক সন্তানদের প্রয়োজন হয়তো মেটাতে ব্যর্থ। এ কারনে কেউ কেউ বিপথে চলে যায়। সবচেয়ে বড় কথা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ শিশু-কিশোরদের জন্য প্রডাকটিভ কিংবা চিন্তাশীল কিছু কাজে ব্যস্ত রাখে। কিন্তু আমাদের দেশে সরকারিভাবে এরকম কোনো ব্যবস্থা নেই। শুধু তা-ই নয় শিশু কিশোরদের ব্যস্ত রাখার জন্য তেমন চিন্তাশীল কোনো ব্যবস্থা নেই।
তিনি আরো বলেন, আগে সন্তানরা কোথায় যায় কিংবা কার সাথে সময় কাটায় সেটি পরিবার জানতে পারতো। কিন্তু এখন ডিজিটালাইজ যুগ। সন্তানরা মোবাইল ফোনে নিজেদের বন্ধু বান্ধব কিংবা তার সহকর্মীদের সাথে নিজেরাই যোগাযোগ রাখে। পরিবার কিংবা অভিভাবকরা কিছুই জানতে পারে না। সালমা আক্তার বলেন, একেবারে ইউনিয়ন পর্যায় থেকে কিংবা শহরে ওয়ার্ড কাউন্সিলর পর্যন্ত তাদের নিজ নিজ এলাকায় অবস্থানরত কিশোরদের ব্যাপারে মনিটরিং করার একটা সিদ্বান্ত নিতে পারে। শিশু কিশোর কিংবা সন্তানদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত।
এদিকে চাঁদাবাজি, দস্যুতা, প্রাইভেটকার, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল চুরির ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রকাশ্যে এ ধরনের অপরাধ হচ্ছে। আর রাতের রাজধানী এখন অনেকটাই অরক্ষিত। অন্ধকার নামলে মানুষের চলাচল মোটেও নিরাপদ নয়।
রাজধানীতে প্রতিনিয়ত হচ্ছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। বাস্তবতা হচ্ছে, দেশে যে সংখ্যায় ছিনতাই সংঘটিত হচ্ছে, তার সিকিভাগও পুলিশের খাতায় রেকর্ড হয় না। কারণ ছিনতাইয়ের শিকার হবার পর কেউই নতুন করে পুলিশি ঝামেলায় জড়াতে চায় না। তবে অনেক ভুক্তভোগী বিশেষ প্রয়োজনে মোবাইল ফোন, জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা ব্যাংকের কার্ড হারিয়ে গেছে মর্মে নিছক একটি সাধারণ ডাইরি করে। এ ধরনের হারিয়ে যাবার ঘটনায় প্রতিদিনই শত শত জিডি হচ্ছে রাজধানীসহ দেশের থানাগুলোতে।
অপরাধ বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারপার্সন প্রফেসর খন্দকার ফারজানা রহমান ইনকিলাবকে বলেন, সমাজে প্রত্যেকের মধ্যে একটা ভোগবাদী মানসিকতার সৃষ্টি হয়েছে। অপরাধ করে হলেও টাকা আয় করতে হবে এমন মানসিকতা গড়ে উঠেছে। ব্যক্তিত্ববাদী প্রতিষ্ঠার যে লোভ এসেছে ব্যক্তিত্ববাদি সমাজ ব্যবস্থায় তা মানুষকে অপরাধী করে তোলার একটি বড় কারণ। এজন্য পরিবার একটি বড় বিষয়। আগে সোসাইটির মধ্যে একটি গার্ডিয়ানশিপ ছিলো। এখন সেটা একেবারেই অনুপস্থিত। সবাই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। একটি শিশু কিংবা কিশোরের সুস্থ মানসিকতা বিকাশে সমাজ ও রাষ্ট্রের যে ভূমিকা থাকার কথা তা এখন নেই। সামজিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। মাত্র ১৪ বছরের কিশোর একেবারেই ঠান্ডা মাথায় খুনের মতো ভয়ঙ্কর ও নৃশংসতায় জড়াবে এটা চিন্তার বিষয়।
ফারজানা রহমান আরও বলেন, অনেকগুলো কারনেই সামাজিক অপরাধ বৃদ্ধি পায়। অপরাধ প্রবণতার পেছনে মানসিক স্বাস্থ্যের একটি যোগযোগ রয়েছে। দেশে মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রধান্য দেই না। আমরা শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকলে যতটা গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা করি, মানসিক স্বাস্থ্যের অসুস্থতার দিকে সেভাবে যত্নশীল হই না। শিশুদের পজিটিভ চিন্তার যোগান দিতে পারি না। কেউ যখন বিভিন্ন কারনে হতাশায় ভোগেন আমরা বিষয়টি সহজভাবে সমাধানের চেষ্টা করি না। কিশোরদের দরকার খেলার মাঠ। অথচ আমরা তা দিতে পারি না। তার দরকার সুস্থ বিনোদন সেটিও নেই। শিশুদের প্রতি আমাদের সামাজিক নজরদারিও নেই। আমরা দিচ্ছি, মোবাইল ফোন কিংবা গেমস খেলার যন্ত্র।
তিনি আরো বলেন, বিভিন্ন কারনেও কেউ অপরাধী হয়ে উঠতে পারে। কেউ মাদকাসক্ত হয়ে উঠলে তার প্রতিনিয়ত মাদকের অর্থের যোগান পেতে বিকল্প আয়ের পথ না পেয়ে চুরি ছিনতাইসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়াবে এটাই স্বাভাবিক। এটা শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত যে-ই হোক এ কাজটিই করবে। শুরুতে ছোট ছোট অপরাধ করে এক সময় সে বড় অপরাধী হয়ে উঠে। সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে গেলে আইনশৃঙ্খলার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বাড়ে অপরাধের ঘটনা। তিনি আরও বলেন, আমাদের শিশু কিশোরদের নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। আমরা যদি এখনই তাদেরকে উপযুক্তভাবে গড়ে তুলতে না পারি তাহলে সমাজে বড় ধরনের অপরাধ সঙ্ঘটিত হবে।
রাজধানীতে অপরাধ বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া সেন্টারের ডিসি ফারুক হোসেন বলেন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। থানা এলাকায় টহল জোরদার ও নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অপরাধীদের শনাক্ত করতে নতুন কৌশলে কাজ চলছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন