শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

৯ দিনে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ১৬ জন নিহত

দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- চলছেই : মানবাধিকারের মারাত্মক লংঘন

| প্রকাশের সময় : ১০ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- থামছেই না। কথিত বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারে প্রতিনিয়তই দেশের কোনো না কোনো এলাকায় মানুষ নিহত হচ্ছেন।  বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের বন্ধের দাবি জানিয়েছেন মানবাধিকার নেতাকর্মীরা। তারা বলছেন, কথিত বন্দুকযুদ্ধের কারণে জনমনে বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। তাঁরা বলছেন, কথিত বন্দুকযুদ্ধের কারণে মানবাধিকার মারাত্মকভাবে লঙ্ঘন হচ্ছে। রাজধানীসহ দেশে ১৬ জন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন মাত্র ৮ দিনে। গত ৩০ নভেম্বর থেকে ৮ ডিসেম্বর এ ৯ দিনের মধ্যে এসব ঘটনা ঘটেছে। রাজধানীর রামপুরায় ২ জন, বাগেরহাটে ২ জন, কেরানীগঞ্জে ২ জন, ফরিদপুরে ২ জন, মেহেরপুরে ৩ জন, ধামরাইয়ে ১ জন, দিনাজপুরে ৩ যুবলীগ কর্মী এবং যশোরে ১ জন কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। নিহতদের পরিবারে সদস্যদের  অভিযোগ, আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর পরিচয়ে  সাদা পোশাকে তাদের ধরে নেয়া হয়েছিল। তারপর তাদের আর কোনো হদিস মিলেনি। ধরে নেয়া পরদিন লাশ পাওয়া গেছে। আবার কোনো কোনো ব্যক্তিকে ধরে নেয়ার ৪/৫ দিন পর লাশ পাওয়া গেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।  
গত বুধবার গভীর রাতে ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জে উপজেলার রুহিতপুরের পোড়াহাটি এলাকায় পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ২ জন নিহত হয়েছেন। এরা হলেন, মনতাজুল ইসলাম (৩৫) ও সবুজ (৩২)। কেরানীগঞ্জ মডেল থানার ওসি ফেরদাউস হোসেন জানান, পোড়াহাটি এলাকায় ডাকাতদল অবস্থান করছে গোপন সূত্রে এমন তথ্য জানতে পেরে থানা ও গোয়েন্দা পুলিশ যৌথভাবে সেখানে অভিযানে যায়। বিষয়টি টের পেয়ে ডাকাতরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। আত্মরক্ষার জন্য পুলিশও পাল্টা গুলি করে। পরে গুলিবিদ্ধ দু’জনকে উদ্ধার করে রাতেই মিটফোর্ড হাসপাতালে নেয়া হয়। রাত সাড়ে ৩টার দিকে চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন।
এর আগে গত বুধবার বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের বাদামতলী খালে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ২ জন নিহত হয়েছে। র‌্যাবের দাবি, নিহত দু’জন বনদস্যু। তারা হলেন, হোসেন মোল্লা ও আল আমিন।
র‌্যাব-৮-এর উপ-অধিনায়ক মেজর আদনান কবীরের ভাষ্য, দস্যু দমনের অংশ হিসেবে ওই দিন পূর্ব সুন্দরবনের বাদামতলী খালে অভিযান চালায় র‌্যাব। র‌্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে বনদস্যুরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। আত্মরক্ষায় র‌্যাবও পাল্টা গুলি ছোড়ে। প্রায় আধা ঘণ্টার বন্দুকযুদ্ধে উভয়ের মধ্যে ৪০০টি গুলিবিনিময় হয়। পরে তল্লাশি চালিয়ে বনের মধ্যে দুই দস্যুর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন র‌্যাবের সদস্যরা। স্থানীয় জেলেরা মৃতদেহ দুটি বনদস্যু হোসেন মোল্লা ও আল আমিনের বলে শনাক্ত করেন। প্রাথমিকভাবে জেলেদের মাধ্যমে জানা যায়, নিহত দু’জনের বাড়ি বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলায়।
গত বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে ফরিদপুর জেলা সদরের কৈজুরি ইউনিয়নের পেয়ারপুর গ্রামে বন্দুকযুদ্ধে ২ জন নিহত হয়। পুলিশের দাবি, ডাকাত দলের গোলাগুলির খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। পুলিশ ফাঁকা গুলি ছুড়লে গোলাগুলি বন্ধ হয়। পরে ঘটনাস্থলে দু’জনকে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। পুলিশ তাদের উদ্ধার করে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়। হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন।
ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক সিরাজুল ইসলাম জানান, পুলিশ দু’জনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নিয়ে আসে। হাসপাতালে আনার আগেই তাদের মৃত্যু হয়।
গত রবিবার রাতে ধামরাইয়ে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হানিফ (৪০) নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। রোববার রাতে ধামরাইয়ের দেওনাই এলাকায় কথিত বন্দুকযুদ্ধে এ ঘটনা ঘটে। পুলিশের দাবি, নিহত হানিফ একাধিক ডাকাতি ও ছিনতাই মামলার আসামি। এর মধ্যে ধামরাইয়ে ৬৫ লাখ টাকা ও আশুলিয়ায় ৮৫ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। নিহত হানিফের বাড়ি কামরাঙ্গীরচরের জালোয়াপাড়া এলাকায়। তিনি মৃত শামসুল হকের ছেলে।
ধামরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রিজাউল হক জানান, ওই দিন সন্ধ্যায় রাজধানীর একটি জায়গা থেকে হানিফকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে পুলিশ জানতে পারে, হানিফের সহযোগীরা ধামরাইয়ের কালামপুর-সাঁটুরিয়া সড়কে বড় ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছে। হানিফের সহযোগীদের ধরতে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে রাত একটা থেকে দেড়টার মধ্যে কোনো এক সময়ে আশুলিয়া ও ধামরাই থানার পুলিশ যৌথ অভিযানের উদ্দেশে রওনা দেয়। দেওনাই এলাকায় পৌঁছার পর হানিফের সহযোগীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। জবাবে পুলিশ পাল্টা গুলি ছোড়ে। এ সময় সহযোগীদের ছোড়া গুলিতে নিহত হন হানিফ।
মেহেরপুরের গাংনীতে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে  ৩  নিহত হয়েছেন। মঙ্গলবার ভোররাতে মটমুড়া গ্রামের একতা ইটভাটার পাশে এ ঘটনা ঘটে। পুলিশ বলছে, নিহতরা চাঁদাবাজ ছিল। মেহেরপুর পুলিশ সুপার আনিছুর রহমান জানান, মটমুড়া গ্রামের একতা ইটভাটা মালিক খবির উদ্দীনসহ কয়েকটি ইটভাটা মালিকের কাছে মোবাইলে চাঁদা দাবি করে অজ্ঞাত চাঁদাবাজরা।  ওইদিন ভোরের দিকে একতা ইটভাটায় ২০/২৫ জন অস্ত্রধারী চাঁদাবাজ হানা দিয়ে চাঁদা আদায়ের চেষ্টা করে। এসময় পুলিশ পৌঁছালে তারা দুটি বোমা নিক্ষেপ করে। পুলিশ পাল্টা গুলি চালালে শুরু হয় বন্দুকযুদ্ধ। এক পর্যায়ে চাঁদাবাজরা পিছু হটলে ঘটনাস্থলে তিনজনের লাশ পড়ে থাকতে দেখে পুলিশ।
রাজধানীর  রামপুরায় ৩০ নভেম্বর  র‌্যাবের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ২ হয়েছেন। তারা হলেনÑ ঝালকাঠির পবিত্র সমাচার এবং শরীয়তপুরের মো. আলী স্বপন ওরফে ছিনতাই স্বপন। তারা পেশাদার ছিনতাইকারী বলে দাবি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর।
র‌্যাব জানায়, একদল দুর্বৃত্তকারীদের সঙ্গে র‌্যাবের গুলিবিনিময় হয়। এতে দুই দুর্বৃত্ত গুলিবিদ্ধ হয়। তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। তাদের বিরুদ্ধে ছিনতাই ও ডাকাতির অভিযোগ রয়েছে। চক্রটি ১০ থেকে ১২ জনের। গতকাল রাতে তাদের ধরতে অভিযান চালানো হলে এ ঘটনা ঘটে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানায়, গতকাল গভীর রাতে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দুজনকে নিয়ে আসা হয়। পরীক্ষা শেষে তাদের মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
পুলিশের রামপুরা থানার ইন্সপেক্টর (অপারেশন) মোস্তাফিজুর রহমানের দাবি  তারা পেশাদার ছিনতাইকারী ছিল। তাদের বিরুদ্ধে রামপুরা, বাড্ডাসহ রাজধানীর কয়েকটি থানায় ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও অস্ত্র মামলা আছে।
গত বুধবার যশোরে দুই পক্ষের বন্দুকযুদ্ধে অজ্ঞাত পরিচয় (২৮) এক যুবক নিহত হয়েছেন।
বুধবার দিনগত রাত ২টার দিকে যশোর-মাগুরা সড়কের সদর উপজেলার পাঁচবাড়িয়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। যশোর কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইলিয়াস হোসেন বলেন, মধ্যরাতে পাঁচবাড়িয়া এলাকায় সন্ত্রাসীদের দুই গ্রুপের মধ্যে গুলি বিনিময়ের সংবাদ পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। এ সময় পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে সন্ত্রাসীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পরে সেখানে পড়ে থাকা গুলিবিদ্ধ যুবককে উদ্ধার করে হাসপাতালে আনার পথে তার মৃত্যু হয়। ওসি আরো জানান, ঘটনাস্থল থেকে একটি ওয়ান শ্যুটারগান, একটি গুলি ও একটি গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়েছে।
এদিকে কেরানীগঞ্জে ২ জন নিহতের ঘটনা জানতে চাইলে, ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার শাহ মিজান শাফিউর রহমান বলেন, নিহত মোনতাজুল ডাকাত সর্দার। তিনি সহযোগী সাঈদসহ ঢাকা ও আশপাশের বিভিন্ন জেলায় স্বর্ণের দোকানে ডাকাতি করে আসছিলেন।
পুলিশ বলেছে, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ঢাকা-মাওয়া সংযোগ সড়ক এলাকা থেকে মঙ্গলবার রাতে ওই দুই ব্যক্তিকে আটক করা হয়। পরদিন বুধবার তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা করা হয়।
পুলিশ সুপার বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার হওয়া মোনতাজুল ও সাঈদ জানান, কেরানীগঞ্জের রোহিতপুর বিসিক লাখিরচরের পোড়াহাটি এলাকায় লুণ্ঠিত মালামাল ও অস্ত্র আছে। পরে বুধবার রাত পৌনে একটার দিকে তাদের নিয়ে কেরানীগঞ্জ মডেল থানার পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি দল রোহিতপুর পোড়াহাটি এলাকায় অভিযান চালায়। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে ডাকাতদের অন্য সহযোগীরা গুলিবর্ষণ করেন। পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। পুলিশ সুপার বলেন, এ সময় মোনতাজুল ও সাঈদ পালানোর চেষ্টা করলে গুলিবিদ্ধ হন। গুরুতর আহত অবস্থায় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে নেয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁদের মৃত ঘোষণা করেন।
এদিকে ফরিদপুর শহরতলির মোল্লাবাড়ী-বাইপাস সড়কের পেয়ারপুরে বুধবার রাতে বন্দুক যুদ্ধে ২ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন।
ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নাজিমউদ্দিন বলেন, বুধবার রাত সোয়া ১২টার দিকে ডাকাতদের দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হলে পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে ফাঁকা গুলি ছোড়েন। পরে ডাকাতেরা পিছু হটলে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে দুই ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে। নিহত ব্যক্তিরা হলেন শরীয়তপুরের পালং উপজেলার চররোসন্দি গ্রামের ফারুক ফকির (৪৫) ও বরগুনার বেতাগী উপজেলার কদমতলা গ্রামের হৃদয় হোসেন মানিক (৩০)।
 অন্যদিকে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত ৩ যুবক। নাটোর পৌর যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসহ তিন যুবলীগ কর্মী। তাদের পরিবারগুলো নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। নিহতরা হলো নাটোর পৌর যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও শহরের কানাইখালী এলাকার সোনা মিয়ার ছেলে রেদওয়ান সাব্বির, একই এলাকার হাফেজ লুৎফর রহমানের ছেলে আব্দুল্লাহ ও শহরের কালুর মোড় এলাকার কালু মিয়ার ছেলে সোহেল রানা। তাদের মাথায় গুলির চিহ্ন রয়েছে। এদের বিরুদ্ধে নাটোর থানায় একাধিক মামলা করেছে।
পুলিশ, এলাকাবাসী ও পরিবার জানায়, গত শনিবার রাতে সদর উপজেলার তকিয়া বাজার এলাকায় কাজ শেষ শেষে যুবলীগ নেতা সাব্বির তার দুই বন্ধু আব্দুল্লাহ ও সোহেল একটি চায়ের দোকানে চা পান করছিল। রাত ১১টার দিকে সেখানে দুইটি হাইস গাড়ি যোগে ১৫/১৬জন তাদের মারপিট করে গাড়িতে তুলে নিয়ে রাজশাহীর দিকে চলে যায়।  পরে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে তিন যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়।
দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- থামছেই না। এটা বন্ধ করা প্রয়োজন। আটকের পর কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে যেভাবে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে এটা কোনো সভ্য সমাজে কাম্য নয়। এ কারণে মানবাধিকার মারাত্মকভাবে লংঘন হচ্ছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন