স্বা ধী ন পা র ভে জ : রাজিবকে যারা ভালোভাবে চিনেন তারা নির্দ্বিধায় বলে দিতে পারেন যে- এই ছেলেটা খুবই পাজি। বাজ্জাতের হাড্ডি। এমনকি ওর বাবা-মাও তাকে নিয়ে দারুণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তাছাড়া স্কুলের সহপাঠিরাও তার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। তবে স্কুলে তার কিছু দুষ্টু প্রকৃতির বন্ধুও রয়েছে, যাদের সাথে জোট বেঁধে সে নানা দুষ্টুমি করে বেড়ায়। এই যেমন, দূরে লুকিয়ে থেকে কাউকে ঢিল ছোড়া, না বলে বা চুরি করে অন্যের টিফিন খেয়ে ফেলা এমনকি বেঞ্চের ওপর কারো বসার জায়গাতে কাঁদা লেপ্টে রেখেও মানুষকে বিরক্ত করত পাঁজিটা। এসবই ছিল তার নিত্যদিনের কাজকর্ম। এসব দুষ্টুমির কারণে বাবা-মা মাঝেমধ্যেই তাকে ঢাপুস ঢুপুস পিটুনি দেয়। বেশি অভিযোগ পেলে না খাইয়েও রাখে দু‘এক বেলা। তবু সে দুষ্টুমি ছাড়বে না। এমনই বদের হাড্ডি এই ছেলেটা।
তবে দুষ্টুমির কারণে বাবা-মা তাকে পিটুনি দিলেও ওর দাদু কিন্তু ওকে মোটেও মারত না। তিনি রাজিবকে খুবই আদর করতেন। সারাক্ষণ রাজিবকে তার কাছে রাখতে চাইতেন এবং যতক্ষণ কাছে পেতেন ততক্ষণই আদর করতেন আর একই সাথে সমপরিমাণ উপদেশও দিতেন। কোমল স্বরে নানা উদাহরণের মাধ্যমে বোঝাতেন- দাদুভাই, মানুষের সাথে দুষ্টুমি করতে হয় না। মানুষকে কষ্ট দিতে হয় না। এই বিশাল সৃষ্টি জগতে মানুষই হলো সেরা জীব। তুমি মানুষকে ভালোবাসো, সবার সাথে ভালো ব্যবহার করো। দেখবে তোমাকেও সবাই আদর করবে।
ধুর! রাজিবের ভালোই লাগেনা সারাক্ষণ দাদুর এই প্যানপ্যানানি। তাই সে দাদুর কাছেই ভিড়তে চায় না। তবু দাদু ডেকে ডেকে তাকে উপদেশ দিতেই থাকেন।
সেদিন ভোর সকালে ঘুম থেকে উঠে বইপত্তর নিয়ে স্কুলে যাচ্ছিল রাজিব। সঙ্গে ছিল এ পাড়ারই আরো দুজন সহপাঠি। ফসলে ভরা একটা সবুজ মাঠ পার হয়ে স্কুলে যেতে আসতে হয় ওদের। সেদিনও হালকা শীতের মধ্যে কুয়াশায় ঢাকা ক্ষেতের সরু আইল ধরে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিল ওরা। একটু খানি হাঁটার পরই ওদের চোখে পড়ল ওরা যে আইল ধরে হাঁটছে ঠিক একই আইলের ওপর দিয়ে বিপরিত দিক থেকে দুটি বাচ্চা মেয়ে এ গ্রামের কে.জি স্কুলে পড়তে আসছে। তাদের দেখে রাজিবের সঙ্গী ছেলে দুটো বলেছিলÑ এক পাশে সরে দাঁড়া রাজিব, মেয়ে দুটিকে যাওয়ার সুযোগ করে দে।
কিন্তু রাজিবের মাথায় তখন দুষ্টু বুদ্ধি চেপেছিল। সে হেসে বললÑ আরে ধুর! আমি কেন সরে দাঁড়াবো? পারলে মেয়ে দুটি নেমে ফসলের ক্ষেত মাড়িয়ে যাক গে। তোরা দেখিস, আমি ওদেরকে নিচে নামিয়েই ছাড়বো।
এমনকি পাঁজি রাজিব করেছিলোও সেটা। সঙ্গী ছেলেরা জায়গা করে দিলেও রাজিব আইলের ওপর ঠায় দাঁড়িয়েছিলো। ফলে বাচ্চা মেয়ে গুলো বেজার হয়ে মুখ কালো করে নিচে নেমে জায়গাটা অতিক্রম করলো। সেটা দেখে রাজিবের সে কি উল্লাস! বজ্জাত একটা।
কিন্তু তার ঠিক পরেই ঘটলো এক অভাবনীয় ঘটনা। আচমকা কোত্থেকে দুটি কুকুর একসাথে বিপরিত দিক থেকে ঐ আইল ধরেই তাদের দিকে ভীষণ জোড়ে ছুটে আসতে লাগলো। যা দেখে রাজিব হঠাৎই খুব ভয় পেয়ে যায় এবং দ্রুত আইল ছেড়ে নামতে গিয়ে মাটির ঢেলায় পা আটকে যায় তার। আচমকা সে হুরমুর করে আছাড় খেয়ে নিচে পড়ে যায়। তার সারা গায়ে ক্ষেতের মাটি আর কুয়াশার শিশির লেগে একবারে কাদায় মাখামাখি হয়ে যায়।
এসব দেখে ওর সঙ্গী ছোট্ট ছেলেটা হঠাৎ বলে ওঠে- এবার শিক্ষা হয়েছে তো? মানুষকে পথ ছাড়লিনা, কিন্তু কুকুর তোকে ঠিকই মাটিতে শুইয়ে ছাড়লো!
ছোট ছেলেটার এই আনমনে বলে ফেলা কথাটা কিন্তু রাজিবকে খুবই বিচলিত করে তুললো। মাটি থেকে শরীরটা তুলে উঠে দাঁড়িয়ে সে আপন মনে ভাবতে লাগলো, দাদু তো তাহলে ঠিকই বলেন। মানুষই এই দুনিয়ার সবচেয়ে দামি প্রাণী। আর তাই মানুষকে কখনো কষ্ট দিতে নাই। অন্যায়ভাবে কেউ মানুষকে বিরক্ত করলে তাকেও নিশ্চয় অপদস্ত হতে হয়। এই যেমন একটু আগে একটা ইতর প্রাণী কুকুরের কাছে তাকে চরমভাবে শায়েস্তা হতে হলো।
সে আপন মনে ভাবতে থাকে। ভাবতেই থাকে।
ভেবে ভেবে এক সময় রাজিবের দু’চোখের কোন অশ্রুতে ভরে ওঠে। দু’হাত দিয়ে কাপড়ে লেগে থাকা ময়লা গুলো ঝেড়ে পরিষ্কার করতে করতে সে মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করে, মানুষের সাথে আর কখনোও খারাপ ব্যাবহার করবেনা সে। এখন থেকে সে নিজের চেয়ে ছোটদের ¯েœহ করবে, বড়দের শ্রদ্ধা করবে। তাছাড়া বাবা-মা আর দাদুর কথা মেনেও চলবে।
কোন পাঁজি ছেলে নয়, সবার কাছে এবার একটা লক্ষ্মি ছেলে হয়ে উঠবে সে....।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন