করোনাকালীণ বাস্তবতায় কোটি কোটি মানুষের আয় রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়া, অত:পর চলতি বছরের শুরুতে ইউক্রেন যুদ্ধসহ একের পর প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি এক চরম বিপর্যয় ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কারণে দেশ থেকে অর্থ পাচারের ধারা সব সময়ই ছিল। কিন্তু গত এক দশকের বেশি সময় ধরে দেশ থেকে অর্থপাচারের প্রবণতা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এ সময়ে দেশ থেকে যে পরিমান অর্থ পাচার হয়েছে, তা স্বাধীনতা পরবর্তী চল্লিশ বছরের চেয়েও অনেক বেশি। এই দশকে দেশের মানুষের উপর মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমান অন্তত ১০ গুণ বেড়েছে। এটি এমন সময়ে ঘটেছে, যখন দেশের মানুষকে একটি তথাকথিত উন্নয়নের ডামাডোলের মধ্যে রাখা হয়েছে। এ দেশের মানুষ গণতান্ত্রিক-অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে লাখো মানুষের প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল। স্বাধীনতার এক দশকের মাথায় আবারো সামরিক স্বৈরাচারের দখল থেকে গণতন্ত্র মুক্ত করতে দেশের মানুষকে আবারো ৯ বছর সংগ্রাম করতে হয়েছে। অবশেষে ডান-বাম, মডারেট, সেক্যুলার-ইসলামিস্ট, জাতীয়তাবাদীসহ সব রাজনৈতিক দল ও জোটের সম্মিলিত আন্দোলন, সমজোতা, আকাক্সক্ষা ও ঐক্যমত্যের মধ্য দিয়ে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হয়। নির্বাচনকালীন অন্তবর্তী তত্তাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাই হচ্ছে, আমাদের দেশে রাজনৈতিক ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর তথা গ্রহণযোগ্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তনের মাইলফলক অগ্রগতি। তিনজোটের রূপরেখা অনুসারে ত্বত্তাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলেও এই ব্যবস্থার অধীনে ১৯৯১ সালে দেশে প্রথমবারের মত অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনে সক্ষম হয়েছিল। ক্ষমতায় গিয়ে বিএনপি এই ব্যবস্থাকে বাদ দিয়ে নিজেদের অধীনে নির্বাচন করার চেষ্টা করেছিল। তবে ১৯৯৬ সালের একতরফা নির্বাচনের আগেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সংবিধানে তত্তাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অর্ন্তভুক্তির প্রয়োজনে সেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেছিলেন এবং তিনি তার কথা রেখেছিলেন। সংবিধানে তত্তাবধায়ক ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্তির আইন করে তিন মাসের মধ্যেই সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে নতুন নির্বাচনের তফশিল ঘোষা করা হয়েছিল এবং সেই নির্বাচনে খুব সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে থেকে জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে ১৯৭৫ এর ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করেছিল। এক মেয়াদ ক্ষমতায় থাকার পর ২০০১ সালের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের ক্ষমতায় ফিরে আসার মধ্য দিয়ে আবারো প্রমান হয়ে যায়, ইনকাম্বেসি ফ্যাক্টরের কারণে এ দেশে নিরপেক্ষ নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসা অসম্ভব। চারদলীয় সরকারের মেয়াদ শেষে তত্তাবধায়ক প্রশ্নে অহেতুক বির্তক এবং দেশে পরিকল্পিত নৈরাজ্য সৃষ্টি, লগি-বৈঠা লাঠি দিয়ে রাজপথে পিটিয়ে নির্মমভাবে মানুষ হত্যার পৈশাচিক ঘটনার মধ্য দিয়ে রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে ওয়ান-ইলেভেনের সেনা সমর্থিত তত্তাবধায়ক সরকার দুইবছর দেশ চালিয়ে তাদের অধীনে নির্বাচন দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে ক্ষমতায় আসার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সেই নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভ‚রাজনৈতিক স্ট্রাটেজি ও গোপন সমঝোতার তথ্য ইতিমধ্যে নানা মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
ওয়ান-ইলেভেন সরকারের ধারাবাহিকতায় দেশি-বিদেশি সমঝোতার নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে দশম এবং ২০১৮ সালের ২৯ডিসেম্বরের একাদশ নিবার্চনের পর পর আমাদের জাতীয় জীবন থেকে দেড় দশক পেরিয়ে গেছে। এ সময়ে বাংলাদেশ থেকে অন্তত ১০ লক্ষকোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। পশ্চিমা অর্থনীতিকে ভাটারটান এবং চীন-ভারতের মত দেশগুলোতে নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনা জেগে ওঠার প্রেক্ষাপটে ভ‚-রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনাসমুহ কাজে লাগানো যায়নি। দেশের শিক্ষিত তরুনরা প্রত্যাশিত চাকরি থেকে বঞ্চিত হলেও ভারতীয় লাখ লাখ তরুণ এ সময়ে এ দেশের চাকরির বাজার ঢুকে পড়েছে। উন্নয়নের নামে দেশের মানুষের উপর ১০ গুণ বৈদেশিক ঋণের বোঝা চাপিয়ে, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার, মানবাধিকার ও কর্মসংস্থানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে ভারতের বাণিজ্য ও রেমিটেন্সের কামধেনুতে পরিনত হয়েছে বাংলাদেশ। যেসব উন্নয়নের ঢাকঢোল পিটিয়ে গত একযুগ ধরে দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্নটিকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে, তার অন্যতম একটি সূচক হচ্ছে বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে চারদলীয় জোট সরকারের ব্যর্থতাকে পুঁজি করে একে একটি প্রধান রাজনৈতিক এজেন্ডার সাথে যুক্ত করা হয়েছে। বিদ্যুত খাতের উন্নয়নে ব্যয় করার হাজার হাজার কোটি টাকার বাজেট ও খরচ প্রক্রিয়াকে সব মহলের প্রশ্নের বাইরে রাখতে এ ক্ষেত্রে আইন করে ইন্ডেমনিটি দেয়া হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারিদের সুবিধা দিতে গ্যাস ও আমদানি করা জ্বালানিভিত্তিক অর্ধশতাধিক রেন্টাল বিদ্যুতকেন্দ্রের সাথে চুক্তি বার বার নবায়ন করা হলেও জ্বালানি খাতের টেকসই উন্নয়নে কোনো উদ্যোগ না নেয়ার খেসারত এখন দেশের জনগণকে দিতে হচ্ছে। মাত্র দুই বছর আগে সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা লোডশেডিং যাদুঘরে পাঠানোর কথা বলেছিলেন। দেশকে মধ্য আয়ের দেশে পরিনত করার দাবিদার সরকার এখন অর্থাভাবে বিদ্যুতকেন্দ্র চালু রাখতে তেল-গ্যাস কিনতে পারছেনা। বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পুর্ণতা বা শতভাগ বিদ্যুতায়ন অর্জনের সময়কে স্মরণীয় রাখতে রাজধানীতে আলোক উৎসব পালনের পর এখন সারাদেশে গড়ে ৮ ঘন্টার বেশি লোডশেডিং চলছে। বিদ্যুতের ঘাটতির কারণে দেশের শিল্পোৎপাদন, রফতানি এবং কৃষি উৎপাদনে ধসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ সপ্তাহে বাংলাদেশ চেম্বার অব কর্মাস-এর সেমিনারে গ্যাস-বিদ্যুতের চলমান পরিস্থিতির উন্নতি না হলে দেশের অনেক কলকারখানা বন্ধ হয়ে প্রায় অর্ধকোটি শ্রমিকের কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছে। গ্যাস-বিদ্যুতের এই বেহাল পরিস্থিতি থেকে নিরঙ্কুশ রাজনৈতিক ক্ষমতার অ্যাবসুলিউট দুর্নীতির চরম পরিস্থিতির চিত্রই প্রকাশিত হচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধ ও বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার আশঙ্কাকে সামনে রেখে আগামি বছর একটি দুর্ভীক্ষের আশঙ্কা বেশ আগেভাগেই উচ্চারিত হচ্ছে। দেশে গণতন্ত্র না থাকলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকেনা। এহেন পরিস্থিতিতে দেশে দুর্ভীক্ষ অনিবার্য হয়ে উঠে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যাপক সহায়তা পাওয়ার পর চোর-চাটার দলের লুটপাটের কারণে দুর্ভীক্ষের সম্মুখীন হয়েছিল বাংলাদেশ। স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন ছাড়া আগামি বছরের সম্ভাব্য বিপর্যয় ও দুর্ভীক্ষের আশঙ্কা থেকে দেশকে মুক্ত করা অসম্ভব হতে পারে।
জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক গুরুত্বের নিরিখে কৃষকের স্বার্থকে অগ্রাহ্য করে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ করা অসম্ভব। সবচে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে কৃষি উৎপাদন ও কৃষকের স্বার্থের পাশাপাশি উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থার সমন্বয় তথা উৎপাদক ভোক্তাদের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ সেতুবন্ধন রচনা করতে না পারলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা একসময় চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে। একদিকে দেশীয় কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় দরিদ্র কৃষকরা আরো দরিদ্র হয়ে পড়ছেন, তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে রেমিটেন্স কমে যাওয়া এবং জাতীয় আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে, অর্থনীতির এই ভারসাম্যহীনতাই অর্থনৈতিক বিপযর্য়ের সূত্রপাত ঘটায়। দেশে রাজনৈতিক আন্দোলন, হরতাল-অবরোধের মত ঘটনায় ব্যবসায়-বানিজ্য ও শিল্প বিনিয়োগে যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল তা থেকে উত্তরণে কোন কার্যকর উদ্যোগ না থাকলেও গত এক দশকে বিরোধিদলের তেমন কোন রাজনৈতিক আন্দোলন কর্মসূচি না থাকায় দেশে এক ধরনের স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করেছে। এহেন বাস্তবতায় দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ বা সম্ভাবনা থাকলেও বাস্তবে তার উল্টোটাই দেখা গেছে। অর্থনীতির প্রায় সব সূচকেই নেতিবাচক প্রবণতা এবং রাজনৈতিক সমঝোতার কোন সম্ভাবনা এখনো মূর্ত হয়ে না উঠা এবং গ্রহণযোগ্য ও ক্ষমতাসীনদের প্রভাবমুক্ত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের দাবীতে বিরোধি জোট আবারো হরতাল-অবরোধের মত কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। এ ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয় সামাজিক-রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলাকে আরো জটিল ও দীর্ঘায়িত করে তোলার আশঙ্কা তৈরী করেছে। এ নিবন্ধ যখন লিখছি, তখন সমুদ্রে ও দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং অঘাত করেছে। দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। উপকূলীয় এলাকায় চার থেকে সাত নম্বর বিপদসঙ্কেত চলছে। বিদ্যুৎ ও সারের ঘাটতির পর ঘূর্ণীঝড় সিত্রাংয়ের কারণে যদি দেশের কৃষি উৎপাদনে ২০ ভাগ ঘাটতি দেখা দেয় তা পূরণ করার অর্থনৈতিক সামর্থ্য এই মুহূর্তে আমাদের নেই।
প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, মার্কিন কূটনীতিক হেনরী কিসিঞ্জার এক সময় বলেছিলেন, ‘কন্ট্রোল অয়েল, ইউ কন্ট্রোল নেশন, কন্ট্রোল ফুড অ্যান্ড ইউ কন্ট্রোল দ্য পিপল’। তেল বা জ্বালানী ব্যবস্থাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রনে রাখতেই তারা গত ৭০ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সেখানে একটি স্থায়ী ‘ওয়ার জোন’ গড়ে তুলেছে। হেনরি কিসিঞ্জারের পূর্বসূরী মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের পরিকল্পনাবিদ জর্জ কেনান ১৯৪৮ সালে প্রদত্ত এক রিপোর্টে যা লিখেছিলেন, বাংলায় ভাবার্থ করলে তার অর্থ দাড়ায় অনেকটা এ রকম- ‘বিশ্বের জনসংখ্যার মাত্র ৬.৩ ভাগ মানুষের দেশ হয়েও আমরা বিশ্বের ৫০ ভাগ সম্পদের নিয়ন্ত্রন ভোগ করছি। বিশেষত আমাদের সাথে এশিয়দের মধ্যে সম্পদে বৈষম্য বিশাল। এ অবস্থায় আমরা যেন তাদের অসুয়া বা শত্রæতার লক্ষ্য হয়ে না পড়ি সে দিকে বিশেষ খেয়াল রেখেই এই বৈষম্য ধরে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।’ অর্থাৎ আমাদের মত এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এমনভাবে পরিচালনা করতে হবে বা ব্যস্ত রাখতে হবে, যেন আমরা কখনো সম্পদ ও সুযোগ সুবিধা সম্পর্কে কোন কার্যকর প্রশ্ন তোলতে না পারি। তবে গত ৭ দশকে বিশ্বের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে গেছে। ইতিমধ্যে চীন ও ভারতের মত এশীয় দেশগুলো অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা পুঁজিবাদী শক্তির জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে। যদিও তাদের বিশাল জনসংখ্যার কারনে জনগনের জীবনমানের উন্নয়ন ও সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তা পশ্চিমা দেশগুলোর সমকক্ষ বা ধারেকাছেও যেতে পারছেনা। সম্পদের পুঞ্জিভবনের মধ্য দিয়েই পুঁজিবাদী অর্থনীতির চরম বিকাশ বা লক্ষ্য অর্জিত হয়। এক সময়ের ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ এখন চীন-ভারতের মত আঞ্চলিক শক্তির দ্বারা ভাগাভাগির মধ্যে পড়ছে। সে ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ও দুর্বল দেশগুলোর জনগন এবং তাদের সম্পদ আঞ্চলিক শক্তির টার্গেটে পরিনত হয়। বড় দেশগুলোর কর্পোরেট নিয়ন্ত্রনের হাত থেকে ক্ষুদ্র দেশগুলোর রাজনৈতিক স্বাধীনতা, সামরিক নিরাপত্তা, পররাষ্ট্রনীতি, বাণিজ্য, কৃষিব্যবস্থা এবং সাংস্কৃতিক স্বাত্যন্ত্র কোনকিছুই বাদ যায়না। কৃষি ও শিল্পে ভর্তুকি, টেরিফ ও ননটেরিফ বেরিয়ার ইত্যাদি ইস্যুগুলো নিয়ে এমনকি বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যেও নানাবিধ টানপোড়েন সৃষ্টি হতে দেখা যায়। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, জি-এইট, জি-টুয়েন্টি এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ফোরামগুলোর মধ্যকার বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে যে সকল স্বার্থ রক্ষিত হয় তা’ শেষ পর্যন্ত তেলা মাথায় তেল দেয়ার মত দুর্বল ও সবিধাবঞ্চিত শ্রেনীর স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে বিদ্যমান সম্পদ ও অর্থনৈতিক বৈষম্য টিকিয়ে রাখতেই বেশী তৎপর রয়েছে।
জ্বালানীর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক খাদ্য সরবরাহ চেইন সব সময়ই বিশ্বরাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে আছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দীর্ঘ তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। চাল-ডাল, তেল-চিনি, পেঁয়াজ-আলুর মত নিত্যপণ্য যখন তখন সাধারন মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়া এবং নীরব সরব দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ার অভিজ্ঞতাও আমাদের আছে। দেশে বর্তমানে চলমান মূল্যস্ফীতির আগে বিগত ওয়ান-ইলেভেন তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সময় বাংলাদেশের মানুষ পচাত্তুর পরবর্তী ৪ দশকের মধ্যে নিত্যপণ্যের সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির কবলে পড়েছিল। ২০০৭ সালের নভেম্বরে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক বিদ্ধংসী সামুদ্রিক ঘূর্ণীঝড় সিডরের আঘাতে বাংলাদেশের দক্ষিনের জেলাগুলোতে প্রলয়ঙ্করী ধ্বংযজ্ঞ সৃষ্টি হয়। তাৎক্ষণিকভাবেই অন্তত: ১০ হাজার মানুষের প্রাণসংহারি এই ঘূর্ণীঝড়ে দেশের কৃষি ও অবকাঠামো খাতের হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি সাধিত হয়। সে সময় বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো ত্রান ও অর্থনৈতিক সাহায্য নিয়ে আর্তমানবতার সেবায় ও পুনর্বাসনে পাশে দাড়ালেও প্রতিবেশী দেশ ভারত বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতি ও দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার মধ্যে এক ধরনের কুটনৈতিক দরকষাকষিতে লিপ্ত হয়েছিল। বিদেশী মিডিয়ায় একে ভারতের ‘ফুড ডিপ্লোমেসি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। গেøাবাল পলিটিসিয়ান নামের একটি অনলাইন ম্যাগাজিনে ২০০৮ সালের জানুয়ারীতে প্রকাশিত একটি নিবন্ধের শিরোনাম ছিল- ‘ইন্ডিয়া’স ফুড ডিপ্লোমেসি: দ্য আদার ফেইস অব অ্যা ফ্রেইন্ড’, ভারতের খাদ্য ক‚টনীতি: এক বন্ধুর ভিন্ন চেহারা। বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতি এবং খাদ্যমূল্যের আকাশ ছোঁয়া উর্ধ্বগতির সময় ২০০৭ সালে সেপ্টেম্বরে প্রতিবেশী ভারত বাংলাদেশের কাছে বিক্রির জন্য চুক্তিবদ্ধ সাড়ে ৫ লাখ টন চাল সরবরাহ আটকে দেয়। নভেম্বরে ঘুর্নীঝড় সিডরে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যার্থে ও পুনর্বাসনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সউদী আরব, পাকিস্তানসহ বন্ধুরাষ্ট্রগুলো এগিয়ে এলেও ভারতের ভূমিকা ছিল তুলনামূলকভাবে শীতল ও চাতুর্যপূর্ণ। সব শেষে ভারতের তৎকালীণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশ সফরে আসলেও তিনি বাংলাদেশের সাথে ইতিমধ্যে এলসিকৃত চাল সরবরাহের শর্ত হিসেবে ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা প্রদান এবং চট্টগ্রাম বন্দর ব্যাবহারের বিষয়টি জুড়ে দেন। বিদেশি মিডিয়ায় প্রকাশিত নিবন্ধটির অনুবাদ করলে শুরুতেই বলা হয় ‘বাংলাদেশের সাথে ভারতের খাদ্য বাণিজ্যের একটা খুবই অদ্ভুত ব্যাপার রয়েছে, একদিকে এর লক্ষ্য হচ্ছে দেশটির কৌশলগত গুরুত্বকে খাটো করে ফেলা, সেইসাথে বাংলাদেশের স্বাধীন-সার্বভৌমত্বের পরিচয়কেও গুরুত্বহীন করে তোলা।’ পরিবর্তিত বিশ্বব্যাবস্থায় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক আধিপত্যবাদী শক্তি কোন দেশকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সামরিক কৌশলের পাশাপাশি, অর্থনীতি, ব্যবসায়-বাণিজ্য, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, খাদ্য নিরাপত্তার মত বিষয়গুলোকে ব্যবহার করে থাকে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মত জনসংখ্যাবহুল দেশগুলোকে নিজস্ব কৃষি, পরিবেশ ও খাদ্য নিরাপত্তার মত ইস্যুগুলোকে জাতীয় নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার মত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। চলমান বিশ্বপরিস্থিতিতে আমাদের অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তা এক নাজুক অবস্থার মুখোমুখী দাঁড়িয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলহানির আশঙ্কা বেড়েই চলেছে। সরকারের পক্ষ থেকেই একটি দুর্ভীক্ষের আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছে। এহেন বাস্তবতায় সংবিধানের দোহাই দিয়ে গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথ আবারো রুদ্ধ করে একটি রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে দেশকে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও দুর্ভীক্ষের মুখে ঠেলে দেয়া হবে রাজনৈতিক আত্মঘাতের সামিল।
bari_zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন