শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে নিহত ২৪

আহত কয়েকশ’ মানুষ : বাড়িঘর, গাছপালা, রাস্তাঘাট বিধ্বস্ত : তলিয়ে গেছে ফসলের মাঠ, মাছের ঘের

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২৬ অক্টোবর, ২০২২, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় তাণ্ডব চালিয়ে ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ বিদায় নেয়ার পর বিভিন্ন জায়গায় আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে ক্ষতচিহ্ন। বাড়িঘর, গাছপালা, রাস্তাঘাট বিধ্বস্ত হয়েছে, মাছের ঘেরসহ ফসলের জমি তলিয়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে গাছপালা পড়ে ২৪ জন নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে চট্টগ্রামে শিশুসহ ৯ জন, লৌহজংয়ে মা-মেয়ে ও নাঙ্গলকোটে ঘুমন্ত অবস্থায় একই পরিবারের তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে কয়েকশ’ মানুষ। আশ্রয়শিবির ছেড়ে বাড়িতে ফিরে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন অনেক মানুষ। উপকূলীয় অধিকাংশ জেলায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্ধকারে রয়েছেন সেসব এলাকার মানুষ। মোবাইল ফোন চার্জ করতে না পারায় স্বজনের খোঁজখবর পর্যন্ত নিতে পারেননি অনেকে। আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো তথ্যে প্রতিবেদন।

চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের তাণ্ডব ও প্রবল জলোচ্ছ্বাসে চট্টগ্রামে শিশুসহ ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ২০ জন। জলোচ্ছ্বাসে দেশের অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জের গুদাম, আড়তে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলে তলিয়ে গেছে ফল-ফসলের মাঠ। বিধ্বস্ত হয়েছে কাঁচা-আধা পাকা বসতঘর। সিত্রাংয়ের তাণ্ডব চলাকালে মীরসরাই বঙ্গবন্ধু শিল্পাঞ্চল এলাকায় একটি ড্রেজার ডুবে আট শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা ডুবে যাওয়া ড্রেজার থেকে লাশ উদ্ধারে অভিযান শুরু করেছে। প্রবল জোয়ারে সীতাকুণ্ডের একটি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে চার মাস বয়সী এক শিশুর লাশ ভেসে এসেছে। ঘূর্ণিঝড় কেটে যাওয়ার পর গতকাল সকাল থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পুরোদমে চালু হয়েছে। জেটি থেকে বহির্নোঙরে সরিয়ে নেয়া ১৭টি জাহাজ ফের জেটিতে ভেড়ানো হয়েছে। গভীর সাগরে চলে যাওয়া ৭০টি মাদার ভেসেল বহির্নোঙরে ফিরে এসেছে। সেখান থেকে লাইটারেজ জাহাজে পণ্য খালাস শুরু হয়েছে। সচল হয়েছে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও।
গত সোমবার রাত থেকে শুরু হওয়া ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের তীব্রতা কম হলেও প্রবল জলোচ্ছ্বাসে বন্দরনগরীর বিশাল এলাকা ছাড়াও উপকূলীয় অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। প্রবল স্রোতের তোড়ে ফাটল ধরেছে পতেঙ্গার শহররক্ষা বাঁধ তথা সৈকত সড়কে। সড়ক উপচে জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয় পতেঙ্গা, হালিশহর, ইপিজেড, আগ্রাবাদ, চাক্তাই, খাতুনগগঞ্জ, আছদগঞ্জ, বাকলিয়া, চাঁন্দগাওসহ বিস্তীর্ণ এলাকা। জলোচ্ছ্বাসে চাক্তাই, খাতুনগঞ্জে গুদাম, আড়তে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। হালিশহর পতেঙ্গা এলাকায় শিল্প কারখানা, দোকানপাট ও গুদাম, আড়ত প্লাবিত হওয়ায় ব্যাপক ক্ষতি হয়।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় ও প্রবল জোয়ারে উপকূলীয় ৬৬টি ইউনিয়নে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ৯৪টি বসতবাড়ি সম্পূর্ণ এবং পাঁচ হাজার ৭৬০টি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫৮ হাজার বাসিন্দা।
মীরসরাই থেকে ইমাম হোসেন জানান, ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে মীরসরাই উপকূলের সন্দ্বীপ চ্যানেলে বালু তোলার ড্রেজার ডুবে আট শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। গত সোমবার রাত ১০টায় উপজেলার সাহেরখালী ইউনিয়নের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের ৩ নম্বর জেটি এলাকার পশ্চিমে এ ড্রেজার ডুবির ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন- পটুয়াখালীর চরজৈনকাটি এলাকার বাসিন্দা আনিস মোল্লার দুই ছেলে শাহীন মোল্লা ও ইমাম মোল্লা, একই এলাকার ইউসুফ আলী হাওলাদারের পুত্র বশর হাওলাদার, মৃত লোকমান ফকিরের পুত্র জাহিদুল কবির, সেকান্দার হাওলাদারের পুত্র আল-আমিন হাওলাদার, নুরু সর্দারের পুত্র আলম সর্দার, আবদুল হক মোল্লার পুত্র মাহমুদ মোল্লা ও রহমান খানের পুত্র তারেক মোল্লা।
ড্রেজারটি থেকে বেঁচে ফেরা শ্রমিক মো. সালাম জানান, জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে সৈকত-২ নামে তাদের ড্রেজারটি ডুবে যায়। এর মালিক সৈকত এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে নিয়োগ দিয়েছে বেপজা। ড্রেজারটিতে থাকা ৯ শ্রমিকের মধ্যে তিনি কিনারে আসতে পারলেও বাকি ৮ শ্রমিক আটকা পড়েন।
এদিকে সীতাকুণ্ড উপজেলা সংবাদদাতা জানান, ঘূর্ণিঝড়ের পর গতকাল সকালে কদমরসুল এলাকার আচোয়া শিপ ইয়ার্ড থেকে চার মাস বয়সী এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে এ ছেলে শিশুটি কোনো এলাকা থেকে ভেসে আসে। জলোচ্ছ্বাসে ভেসে আসা অর্ধ শতাধিক মহিষ উদ্ধার করেছে স্থানীয় প্রশাসন।
স্টাফ রিপোর্টার, কুমিল্লা থেকে জানান, কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের হেসাখালের খামারপাড়া গ্রামে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে ঘরের চালে বড় গাছ পরে ঘুমন্ত অবস্থায় একই পরিবারের তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতরা হলেন, মালয়েশিয়া প্রবাসী নেজাম দিন, স্ত্রী শারমিন আক্তার সাথী ও কন্যা নুসরাত আক্তার লিজার।
জানা যায়, গত সোমবার রাতে স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে নির্মাণাধীন নতুন ভবনের পাশে পুরাতন টিনের চালার ঘরে ঘুমিয়ে পড়েন মালয়েশিয়া প্রবাসী নেজাম। রাত ১০টার দিকে ঘরের পাশে থাকা বিশাল একটা রেইন ট্রি গাছ ঘরের চালের ওপর পড়ে তিন জনের বুকে চাপা দেয়। এ সময় তাদের চিৎকারে স্থানীয় লোকজন করাত দিয়ে গাছ কেটে তিন জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন।
নিহতের ভাই জানান, মাত্র এক মাস আগেই মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফিরেন নেজাম। স্ত্রী কন্যাকে নতুন ঘরে তুলে দিয়ে আগামী মাসেই আবার ফিরে যাবার কথা ছিলো তার।
ভোলা জেলা সংবাদদাতা জানান, গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকেই আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়তে শুরু করেছে ভোলা উপকূলের মানুষ। সকালে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলেও তেমন বৃষ্টিপাত হয়নি। তবে ঝড়ে কবলে পড়ে ঘর ও গাছের চাপায় নিহত হয়েছেন চারজন। এদের মধ্যে ভোলা সদরে একজন, দৌলতখানে একজন ও চরফ্যাশন উপজেলায় একজন নিহত হয়েছে। নিহতরা হলেন- চরফ্যাশনের হাজারিগঞ্জ ইউনিয়নের মনির, দৌলতখানের পৌর ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বিবি খাদিজা, ভোলা সদরের ধনিয়া ইউনিয়নের মফিজল হক ও লালমোহনের লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের ফাতেমাবাদ গ্রামের গৃহবধূ রাবেয়া বেগম।
এদিকে সিত্রাংয়ের প্রভাবে গত রোববার রাত থেকে ভোলায় বিদ্যুৎ, সড়ক-মহাসড়ক ও বসতঘরসহ গাছ ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অনেকে। গাছের আঘাতে আহত হয়েছে প্রায় অর্ধশত মানুষ। এছাড়া উপকূলীয় এলাকায় বেড়িবাঁধের বাহিরে বিপদ সীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়া ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে রয়েছে চরম জন দুর্ভোগে সময় পার করছেন সেখানকার মানুষ। অন্যদিকে মাছের ঘের, পুকুর, কৃষি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। ভোলা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তৌহিদুর ইসলাম বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে, নিহতদের পরিবারে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহায়তা দেওয়া হবে।
লৌহজং (মুন্সীগঞ্জ) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে গাছ চাপায় একই পরিবারের মা-মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি শিশুর বাবা আব্দুল রাজ্জাক। গতকাল সামবার রাতে উপজেলায় কনকসার ইউনিয়নে ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন, মা আসমা বেগম ও মেয়ে সুরাইয়া।
এছাড়া উপজেলায় বিভিন্নস্থানে সিত্রাংয়ের প্রভাবে টানা বৃষ্টিপাত ও গাছপালা ও বসতঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। বন্ধ রয়েছে লৌহজং-মাওয়া সড়কে যানচলাচল। সোমবার রাত থেকে উপজেলার সর্বত্র বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। স্থানীয়রা জানান, স্বামী-স্ত্রী ও ৫ বছরের শিশু সন্তানসহ ঘরের ভিতর ঘুমিয়ে ছিল। এ সময় ঝড়ে চাম্বল গাছ ঘরের ওপরে পরলে গাছের চাপা পরে মা-মেয়ের মৃত্যু হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সংবাদদাতা জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কসবায় ঝড়ে ঘরের ওপর গাছ ভেঙে পড়ে এক জনের মৃত্যু হয়েছে। গত সোমবার গভীর রাতে উপজেলার গোপীনাথপুর ইউনিয়নের ধ্বজনগর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। সে ওই গ্রামের মৃত সিরাজ মিয়ার ছেলে। এছাড়া গাছপালা ও ফসলের আংশিক ক্ষতি হয়েছে। এতে জেলার বিভিন্নস্থানে বৈদ্যুতিক খুঁটি ও বিভিন্ন সড়কে গাছ পড়ে চলাচলে বিঘ্ন ঘটে।
বরগুনা জেলা সংবাদদাতা জানান, বরগুনা সদর উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং-এর তাণ্ডবে গাছচাপা পড়ে আমেনা খাতুন নামের এক শতবর্ষী বৃদ্ধা নিহত হয়েছেন। গত সোমবার রাত সাড় ৮টার দিকে বরগুনা সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের সোনাখালী গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
জানা গেছে, সন্ধার আগেই স্থানীয় ইউপি সদস্য আমেনা খাতুনকে নিয়ে আশ্রয়ন কেন্দ্রে যেতে বলেন। কিন্তু তিনি যেতে রাজি হননি। পরে ঝড়ের সময় গাছ উল্টে ঘরের চালার ওপর পড়লে ঘটনাস্থলেই নিহত হন তিনি।
রাজশাহী ব্যুরো জানায়, রাজশাহী-ঢাকা রুটে চলাচলকারী ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় ঘটেছে। গত সোমবারের টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে পদ্মা এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিনের ওপর গাছ ভেঙে পড়া এবং সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেন ঢাকা বিমানবন্দর স্টেশনে লাইনচ্যুত হওয়ায় পশ্চিমাঞ্চল রেলে চলাচলকারি অধিকাংশ দূরপাল্লার ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় হয়েছে। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, প্রতিটি ট্রেন ৫ থেকে ৭ ঘণ্টা বিলম্বে চলাচল করছে।
এছাড়া মঙ্গলবার সকালের চাঁপাইনবাবগঞ্জ-ঢাকা আন্তঃনগর বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেনটির যাত্রা বাতিল করা হয়েছে। রেল কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে যাত্রীদের টিকিটের টাকা ফেরত দিয়েছে। এছাড়াও সকালের রাজশাহী-ঢাকা সিল্কসিটি ৫ ঘণ্টা বিলম্বে রাজশাহী ছেড়েছে। পশ্চিম রেলের জেনারেল ম্যানেজার অসীম কুমার তালুকদার বলেন, ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা চলছে।
তিনি বলেন, গত সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকার বিমানবন্ধ স্টেশনের আউটারে সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেসের একটি বগি লাইনচ্যুত হয়। একইদিন রাতে ১১টার দিকে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে ঢাকা থেকে রাজশাহী অভিমুখে ছেড়ে আসা আন্তঃনগর ট্রেন পদ্মা এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনের সামনের বাম্পারে তেঁতুল গাছ ভেঙে পড়ে।
নোয়াখালী ব্যুরো জানায়, সিত্রাংয়ে নোয়াখালীর উপকূলীয় এলাকাসহ মোট ৫টি উপজেলায় অন্তত দেড় হাজার বাড়ি-ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। ঝড়ে সুবর্ণচর উপজেলার চরবাটা ইউনিয়নের পূর্ব চরবাটা গ্রামের হাবিবিয়া এলাকায় বসত ঘরের ওপর গাছ পড়ে এক শিশু নিহত ও তার মাসহ আরও দুইজন আহত হয়েছে। শিশু সানজিদা আফ্রিদী ওই এলাকার অ্যাডভোকেট আবদুল্যার ছেলে।
জানা গেছে, গত রোববার গভীর রাত থেকে জেলার বিভিন্ন স্থানে থেমে থেমে বৃষ্টি শুরু হয়। গত সোমবার ভোর থেকে বৃষ্টি বাড়তে থাকে, বিকাল থেকে বৃষ্টির সাথে শুরু হয় ঝড়ো বাতাস। প্রবল বাতাসে জেলার হাতিয়া, সুবর্ণচর, কোম্পানীগঞ্জ, কবিরহাট ও সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় কাঁচা গাছ-পালা ও বসত ঘর বিধ্বস্ত হয়। ভেঙে পড়ে বিদ্যুতের খুঁটি, এতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ, গতকাল বিকাল ৪টা পর্যন্ত জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি। এতে মোবাইলসহ বিভিন্ন ডিভাইস বন্ধ হয়ে যায়। বিপর্যয় দেখা দিয়েছে মোবাইল নেটওয়ার্কে।
গত দুই দিনে উপকূলের নিম্নাঞ্চল প্লাবিতসহ দুর্ভোগে পড়েছেন প্রায় ৩ লাখ ৯৬ হাজার মানুষ। তবে গতকাল মঙ্গলবার বিকেল থেকে প্লাবিত এলাকা থেকে পানি নামতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এদিকে গত সোমবার রাতের প্রচণ্ড জোয়ারে ভেঙে হেলে পড়েছে হরনী ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের মুক্তি সমাজ আশ্রয়ণ কেন্দ্রটি।
খুলনা ব্যুরো জানায়, জেলার ১৬০০টি ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে জলোচ্ছ্বাস না হওয়ায় এ জেলার মৎস্য খাতে তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। ভারি বৃষ্টি ও দমকা হাওয়ার কারণে কিছু এলাকার আমন ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খুলনা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা রনজিৎ কুমার সরকার জানান, প্রাথমিকভাবে জেলার ক্ষয়ক্ষতি নির্ণয় করা হয়েছে। জেলায় মোট এক হাজার ৬০০টি ঘর ভেঙেছে। এসব ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করতে ২ থেকে ৩ দিন সময় লেগে যাবে।
বরিশাল ব্যুরো জানায়, ঝড়ো হাওয়ায় ঘরের দেয়াল ও গাছচাপা পড়ে ভোলা ও বরগুনায় ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে ভোলার দৌলতখান ও চরফ্যাশনে দু’জন এবং বরগুনায় আরো একজনের মৃত্যু হয়েছে। গত দুদিনের প্রবল বর্ষণে দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় সাড়ে ৭ লাখ হেক্টর জমির আমন ধান এখন পানির তলায়। প্লাবিত হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ হেক্টর পুকুর, দীঘি ও ঘেরের মাছ। বরিশাল মহানগরীর ৭৫ ভাগ এলাকাসহ দক্ষিণাঞ্চলের অধিকাংশ জনপদই এখনো পানির তলায়। দক্ষিণাঞ্চলের ৬টি জেলার প্রায় ৩ হাজার আশ্রয় কেন্দ্রের প্রায় ৫ লাখ মানুষ আশ্রয় গ্রহণ করলেও মঙ্গলবার সকাল থেকে তারা ঘরে ফিরেছেন।
এদিকে গত সোমবার দিনভরই বরিশাল মহানগরীসহ দক্ষিণাঞ্চলের অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সরবারহ বন্ধ থাকলেও সন্ধ্যার পরে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে। রাতভর চেষ্টা করেও অনেক এলাকায় আলো দিতে পারেনি বিদ্যুৎ বিভাগ।
স্টাফ রির্পোটার, মাদারীপুর থেকে জানান, মাদারীপুরে ৫০০ হেক্টর জমির আমন ধান তলিয়ে গেছে। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছে কৃষকেরা। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সরকারিভাবে প্রণোদনা দেওয়ার দাবিীকৃষকদের। মাদারীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক দ্বিগবিজয় হাজরা বলেন, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে যে সকল কৃষকরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। পরে সরকারিভাবে প্রণোদনা পেলে আমরা তা তালিকাভুক্ত কৃষকদের প্রদান করবো।
স্টাফ রিপোর্টার, নারায়ণগঞ্জ থেকে জানান, ঝড়ে নারায়ণগঞ্জ বন্দর উপজেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন এলাকার ঘরবাড়ী, বড় গাছ, বৈদুতিক খুঁটিসহ বিভিন্ন স্থাপনা ওপরে পড়েছে। বন্দর উপজেলার অধিকাংশ এলাকায় আবারও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
বাগেরহাট জেলা সংবাদদাতা জানান, বাগেররহাটে গতকাল মঙ্গলবার সকালে রোদ্যউজ্জল আকাশের দেখা মিলেছে। স্বাভাবিক হয়েছে মোংলা বন্দরের কার্যক্রম। তবে ঘূণীঝড় সিত্রাং এর প্রভাবে আক্রান্ত হয়েছে ১ হাজার ৩৮৫ হেক্টর কৃষি জমির। ক্ষতি হয়েছে প্রায় কোটি টাকার মৎস্য খাত। মোংলা বন্দরের হারবার মাস্টার ক্যাপ্টেন মোহাম্মাদ শাহীন মজিদ জানান, ঘূণীঝড় সিত্রাং এর প্রভাব কেটে যাওয়ায় সকাল থেকে মোংলা বন্দরের কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়েছে।
ফরিদপুর জেলা সংবাদদাতা জানান, ফরিদপুর ৯ উপজেলায় গাছপালাসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়েছে। টানা বর্ষণে শহরের নিম্নাঞ্চল ডুবে গেছে। কমপক্ষে ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ছে। এছাড়া চড় এলাকায় কয়েক শত বিঘা জমিতে রোপন করা পিয়াজের ক্ষেত কমপক্ষে ১ হাত পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ফলে চড় এলাকার কৃষককুল চরম ক্ষতির মধ্যে পড়ে গেছে।
ঝালকাঠি জেলা সংবাদদাতা জানান, ঝালকাঠির বিভিন্ন স্থানে গাছপালা ও বসতঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। এতে অভ্যন্তরীণ সড়কে যানচলাচল বন্ধ রয়েছে। গত সোমবার রাত থেকে জেলার সর্বত্র বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। মোবাইল ফোন ও ওয়াইফাই সংযোগও বন্ধ রয়েছে।
আনোয়ারা (চট্টগ্রাম) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, চট্টগ্রামের আনোয়ারায় নদী ও সাগরের বেড়িবাঁধ ভেঙে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। টানা বৃষ্টি, দমকা হাওয়া, নদী ও সাগরে অস্বাভাবিকভাবে জোয়ারের পানি বাড়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকেছে। এতে ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ও মাছের ঘের তলিয়ে যায়। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড জরুরী বরাদ্ধে ভাঙন এলাকা মেরামত কাজ শুরু করেছে। এদিকে গত সোমবার সকাল থেকে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় বিচ্ছিন্ন আছে বিদ্যুৎ সংযোগ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন