শত বাধা, বিপত্তি উপেক্ষা করে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনার গণসমাবেশ সফল করেছে বিএনপি। তিনটি সমাবেশেই হামলা, গ্রেফতার, পরিবহন বন্ধসহ নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে রাজনৈতিক অঙ্গনে সরকারের ব্যাপক বিতর্ক হয়েছে। অন্যদিকে তিনটি বিভাগীয় গণসমাবেশে সফলতার পর এরশাদের বাহের দেশ খ্যাত রংপুরে আগামী ২৯ অক্টোবর সমাবেশ করবে বিএনপি। সমাবেশ ঘিরে বিএনপির ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলও বসে নেই। ইতোমধ্যে সমাবেশে অংশগ্রহণের জন্য ভাড়া করা বাসের অগ্রীম ফেরত দেয়ার অভিযোগ করেছেন বিএনপি নেতারা। এই অবস্থায় খুলনার পর দেশবাসী উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে আছে রংপুরের দিকে। সমাবেশে মানুষের উপস্থিতি কেমন হবে? সবার নজর থাকবে সেই দিকে।
উপজেলা, ওয়ার্ড পর্যায়ে বিক্ষোভের পর এখন বিভাগীয় গণসমাবেশে করছে বিএনপি। ১০ বিভাগীয় সমাবেশের মধ্যে ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও খুলনায় বিপুল সংখ্যক মানুষের জমায়েত ঘটিয়ে সারা ফেলেছে দলটি। পথে পথে বাধা, হামলা, ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে এসব সমাবেশ উজ্জীবিত করে তুলেছে সারাদেশের নেতাকর্মীদের। বিশেষ করে ময়মনসিংহে পরিবহন বন্ধ এবং খুলনায় সমাবেশের দুইদিন আগে থেকে সকল ধরণের পরিবহন বন্ধ, পথে পথে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি, হামলা, গ্রেফতারসহ বহুমুখী প্রতিবন্ধকতার পরও তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়া সমাবেশ তাদের মধ্যে আন্দোলন-সংগ্রামের নতুন আশার সঞ্চার করেছে।
জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ৫ নেতাকর্মীকে হত্যার প্রতিবাদে এবং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ বিরোধী মতের সকল নেতাকর্মীদের উপর হামলা-মামলার প্রতিবাদে গত ১২ অক্টোবর থেকে গণসমাবেশ করছে বিএনপি। ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশের মধ্য দিয়ে এই কর্মসূচি শেষ হবে। এরই ধারাবাহিকতায় আগামী ২৯ অক্টোবর শনিবার রংপুরে গণসমাবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছেন দলটির নেতাকর্মীরা। ইতোমধ্যে সমাবেশ সফল করতে প্রতিদিনই রংপুর বিভাগের ৮টি জেলা ও সকল উপজেলা পর্যায়ে নেতাকর্মীদের নিয়ে প্রস্তুতি সভা করেছে বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, শ্রমিক দল, ছাত্রদলসহ সকল অঙ্গসংগঠনগুলো পৃথকভাবে কর্মীসভা ও প্রস্তুতি সভা করেছে। সমাবেশে উপস্থিতি বাড়াতে প্রচারপত্র বিতরণ, জনসংযোগ, পথসভা করছেন নেতাকর্মীরা। রংপুর জিলা স্কুল মাঠ এবং বিকল্প হিসেবে রংপুর কালেক্টরেট ঈদগাহ মাঠে সমাবেশের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছিল বিএনপি। এর মধ্যে কালেক্টরেট ঈদগাহ মাঠে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছে। গতকাল বুধবার থেকে সেখানে মঞ্চ তৈরির কাজও চলছে বলে জানিয়েছে রংপুর মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব মাহফুজ উন নবী ডন।
রংপুরের বিএনপি নেতারা বলেন, রংপুরের গণসমাবেশে ইতিহাসের সর্বোচ্চ জনসমাগম ঘটানোর পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে নেতাকর্মীরা। এজন্য এক মাস থেকে রংপুরের প্রতিটি ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলায় প্রচার-প্রচারণা, কর্মীসভা, প্রস্তুতি সভা করেছে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনগুলো। সরকার বাধা, হামলা, গ্রেফতার ও ভীতির সঞ্চার যদি না করে তাহলে ২৯ অক্টোবর রংপুরের গণসমাবেশে ১০ লাখ লোক জমায়েত করা হবে বলে জানিয়েছেন তারা। তবে বিভিন্ন জেলার নেতারা অভিযোগ করে বলেন, সরকার কিংবা পরিবহন মালিক সমিতি পরিবহন বন্ধের ঘোষণা না দিলেও বাস ভাড়ার জন্য দেয়া অগ্রিম টাকা ফেরত দিয়ে দেয়া হচ্ছে। উপরের চাপের কারণে গাড়ী ভাড়া দেয়া যাবে না বলে বিএনপি নেতাদের জানিয়েছেন পরিবহন শ্রমিকরা।
এ বিষয়ে পঞ্চগড় জেলা বিএনপির সদস্য সচিব মো. ফরহাদ হোসেন আজাদ বলেন, বুধবার থেকেই পরিবহন শ্রমিকরা আমাদের গাড়ী ভাড়ার অগ্রিম ফেরত দিচ্ছেন। আমরা ২০০ বাস রিজার্ভ করেছিলাম, ইতোমধ্যে ১০০ গাড়ীর ভাড়া ফেরত দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, তারা বলছেন, মালিক সমিতি, উপরের চাপের কারণে তারা গাড়ী ভাড়া দিতে পারবেন না।
তবে কোন বাধা তাদের ঠেকাতে পারবে না জানিয়ে আজাদ বলেন, বৃহস্পতিবার থেকেই পঞ্চগড় থেকে নেতাকর্মীরা রংপুরে যাওয়া শুরু হবে। ২৮ অক্টোবর রাতের মধ্যেই জেলার ২০ হাজারের বেশি নেতাকর্মী সমাবেশস্থলে উপস্থিত হবেন।
প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে রংপুর মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব মাহফুজ উন নবী ডন বলেন, ১০ সাংগঠনিক জেলায় প্রচারণা চালাতে গিয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে আমরা স্বত:স্ফূর্ততা লক্ষ্য করেছি। সকলে বিএনপির যে, অবৈধ সরকারবিরোধী গণদাবিতে আন্দোলন করছে তার প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করতে প্রস্তুত। সরকার যদি বাধা-প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করে তাহলে ১০ লাখ লোকের জমায়েত হবে।
খুলনার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে কি করবেন? জানতে চাইলে মাহফুজ উন নবী বলেন, ক্ষমতাসীন সরকার জনগণকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। এজন্য তারা বিএনপির জনসভা বাধাগ্রস্ত করতে নানারকম কৌশল গ্রহণ করে। যেমন- ময়মনসিংহে সমাবেশের দিনে পরিবহন বন্ধ করে দিয়েছে, খুলনায় দুই দিন আগেই সকল পরিবহন বন্ধ করে দেয়। রংপুরেও এমনটি করতে পারে এমনটি ধরে নিয়েই আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি। আমাদের নেতাকর্মীরাও সেভাবে প্রস্তুত।
তিনি বলেন, শত বাধা উপেক্ষা করে মানুষ সমাবেশে উপস্থিত হবে। কারফিউ জারি করলেও প্রয়োজনে পায়ে হেটে হলেও রংপুরে সেদিন লাখ লাখ মানুষ অংশগ্রহণ করবে।
রংপুর মহানগরের এই নেতা জানান, বৃহস্পতিবারের মধ্যেই কেন্দ্রীয় নেতারা রংপুরে উপস্থিত হবে। অন্যান্য বিভাগীয় সমাবেশের মতো রংপুরেও প্রধান অতিথি থাকবেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিশেষ অতিথি স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, যুগ্ম মহাসচিব হারুন উর রশিদ, সভাপতিত্ব করবেন মহানগরের আহ্বায়ক সামসুজ্জামান সামু। এছাড়া বিএনপির বিভাগীয় নেতৃবৃন্দ, জেলা ও অঙ্গসংগঠনের নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখবেন।
জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মঞ্জুরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, শ্রমিক দলের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ১০টি সাংগঠনিক জেলাতেই কর্মীসভা ও প্রস্তুতি সভা করেছেন। এসময় তিনি মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ্য করেছেন। মঞ্জু বলেন, তারা মানুষকে বোঝাতে চেয়েছেন শ্রমজীবী মানুষ কষ্টে আছে, তাদের দাবি নিয়েই বিএনপি মাঠে নেমেছে, এতে তারাও সাড়া দিচ্ছেন। দলের নেতাকর্মী ছাড়াও সাধারণ মানুষ বলেছেন, যত বাধা দেয়া হোক, কোন বাধা তাদেরকে আটকাতে পারবে না। সকলে জাতীয় পতাকা, লাঠি হাতে রংপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে। যদি পরিবহন বন্ধ করে দেয়া হয় তাহলে বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল, নসিমন, পাগলু, অটো যেভাবে পারবেন তারা আসবেন। প্রয়োজনে চিড়া-মুড়ি সাথে নিয়ে পায়ে হেটে হলেও যাবেন।
রংপুর বিভাগীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব দুলু বলেন, গণসমাবেশকে সফল করতে আমরা ইতোমধ্যে বিভাগীয়, ১০টি জেলা ইউনিট, উপজেলা ও ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে প্রস্তুতিমূলক সভা করেছি। প্রতিটি সভাতেই আমরা সাধারণ মানুষ, তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মাঝে এতো উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখেছি যা অতীতে দেখা যায়নি। সকলেই বিএনপি যে দাবিগুলো নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করছে তার প্রতি তারা একাত্মতা প্রকাশ করেছে এবং ২৯ তারিখের সমাবেশে অংশগ্রহণ করে সরকারের প্রতি অনাস্থা জানাবে।
ঈদগাহ মাঠে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সমাবেশের দিনে বিএনপির নেতাকর্মী-সমর্থক ও সাধারণ মানুষের পদভারে সেদিন রংপুর শহর প্রকম্পিত হবে।
খুলনা কিংবা ময়মনসিংহের মতো পরিবহন বন্ধ করে দিলে কিভাবে জনসমাগম হবে জানতে চাইলে দুলু বলেন, যদিও সরকার বলেছে যে, পরিবহন তারা বন্ধ করবে না, কিন্তু আমরা সরকারের মুখের কথায় বিশ্বাস করি না। কারণ তারা মুখে এক কথা বলে, আর কাজ করে উল্টো। এছাড়া পরিবহন সংশ্লিষ্টরা সরকারপন্থী। তাই আমরা বিকল্প চিন্তা করে রেখেছি। যদি সরকার খুলনার মতো পরিবহন বন্ধ করে দেয়, সেক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ পায়ে হেটে, বাইসাইকেল, রিক্সা, অটোতে করে সমাবেশে আসবে। সবার মাঝে যে উদ্দীপনা লক্ষ্য করেছি কোন বাধা, প্রতিবন্ধকতাই তাদেরকে আটকাতে পারবে না। আসাদুল হাবিব দুলু বলেন, জনস্রোতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করবে রংপুরের গণসমাবেশ। ###
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন