সড়ক পথে বাস, মিনিবাস, মাইক্রোবাস চলাচল বন্ধ, নৌ পথেও ডাকা হয়েছে ধর্মঘট। বিএনপির অন্যান্য বিভাগীয় সমাবেশের সময় যে কারণ উল্লেখ করে পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল, বরিশালেও একই। পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে চলছে না ৩ চাকার কোনো যান, অন্যান্য জেলার সাথে বন্ধ নৌ যোগাযোগ। তা সত্ত্বেও বরিশালের আজকের বিভাগীয় গণসমাবেশকে সামনে রেখে ২ দিন আগেই শহরে পৌঁছান বিএনপি নেতা-কর্মীরা। তাদের পদচারণা ও স্লোগানে, স্লোগানে মুখর হয়ে উঠে সমাবেশের জন্য নির্ধারিত বঙ্গবন্ধু উদ্যান। ২দিন ধরেই বিভাগের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা আগত বিএনপি নেতা-কর্মীরা বঙ্গবন্ধু উদ্যান ও এর আশপাশের এলাকায় অবস্থান নিয়ে মিছিলে-স্লোগানে মাতিয়ে রাখেন চারপাশ। উদ্যানসংলগ্ন লেকে গোসল করে জুমার নামাজ আদায় করে তাদের অনেকে সেখানেই রান্না করা খাবার খান। রাতে মাদুর, পাটি, বস্তা, পেপার বিছিয়ে, কেউবা ত্রিপল বিছিয়ে ঘুমিয়েছেন মাঠেই। গতকাল শুক্রবার রাতেই নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে পরিপূর্ণ ওঠে সমাবেশের মাঠ। কেন্দ্রীয় নেতারাও পৌঁছে গেছেন বরিশালে। এই রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্তও খণ্ড খণ্ড মিছিল আর স্লোগানে সমাবেশস্থলে প্রবেশ করছিলেন নেতাকর্মীরা।
এদিকে সমাবেশকে ঘিরে গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলই সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ১০ দিন আগে ৪ ও ৫ নভেম্বর বরিশালে পরিবহন ধর্মঘট আহ্বান করা হলেও গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে একে একে পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুরেও সড়ক পরিরবহন ধর্মঘটে ডাক দেয় পরিবহন মালিকÑশ্রমিকরা। গতকাল সকাল থেকে ঝালকাঠীতেও একইভাবে ধর্মঘট কার্যকর হয়েছে।
মহাসড়কে তিন চাকা যান চলাচল বন্ধের দাবিতে ১০ দিন আগে এ পরিবহন ধর্মঘট আহ্বান করা হলেও বিষয়টি নিয়ে প্রশাসন ও পুলিশ সমস্যা সমাধানে মালিক সমিতিগুলোর সাথে আলাপ আলোচনা দুরের কথা, কোনো ধরনের যোগাযোগ পর্যন্ত করেনি। অথচ শুক্রবার সকাল থেকে সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল অনেকটাই অবরুদ্ধ হয়ে আছে। বাস টার্মিনালগুলোতে শুনশান নিরবতা। অনেক এলাকার মুমূর্ষ রোগী পর্যন্ত হাসপাতালে যেতে পারছে না। সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে সরকারি স্বাস্থ্য পরিসেবার প্রায় পুরোটাই বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওপর নির্ভরশীল। শুক্রবার দুপুরে ও বিকেলে দুটি উড়ান পুর্ণ লোড নিয়ে বরিশাল বিমান বন্দরে অবতরণ করার পরে তার যাত্রীরা চরম বিড়ম্বনার শিকার হন যানবাহনের অভাবে। বিমান বন্দর থেকে রিকশাভ্যানেও অনেক নারী ও শিশু যাত্রী ১৫ কিলোমিটার দুরে শহরে পৌছেন।
সড়কের পাশাপাশি এ অঞ্চলের নৌ যোগাযোগও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তবে এসব কিছুর পরেও গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বরিশালের বঙ্গবন্ধু উদ্যানÑবেলপার্কে প্রায় ৩৫ হাজার নেতা-কর্মী সমবেত হয়েছেন।
সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন বরিশাল গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে অনেকটা করোনাকালের লকডাউনের রূপ নিয়েছে। পরিবহন মালিকদের আগাম ঘোষিত সড়ক পরিবহন ধর্মঘটের সাথে অঘোষিতভাবে নৌ যোগাযোগও বন্ধ করে দেয়ায় সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলই যোগাযোগ শূন্য। বরিশাল মহানগরী সারা দেশ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। সড়ক ও নৌপরিবহন ধর্মঘটের পাশাপাশি সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় মহানগরীতে এখন শুনশান নিরবতা। নৌ পরিবহন ধর্মঘটের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না থাকলেও গত বুধবার রাত থেকে ভোলা ও বরিশালের মধ্যে স্পীডবোটসহ গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে যাত্রীবাহী নৌযান চলাচলও বন্ধ করে দেয়া হয়। আর শুক্রবার সকালে বরিশালের ১২টি সহ দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ২৫টি রুটেই নৌযান চলাচল অঘোষিতভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ভোলাতে বরিশালমুুখী একটি লঞ্চে হামলা চালিয়ে ভাঙচুরও করা হয়েছে।
তবে বৃহস্পতিবার দুপুর থেকেই বরিশাল মহানগরীতে বিপুল সংখ্যক বিএনপি নেতা-কর্মী ও সমর্থক পৌঁছতে শুরু করে। গতকাল শুক্রবারও দিনরাত শত শত ট্রলারে সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল থেকে বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মী এ নগরীতে পৌঁছেছেন। নগরীর যে বঙ্গবন্ধু উদ্যান-বেলপার্কে শনিবার গণসমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে, সেখানে গত বৃহস্পতিবার দিনভর প্রায় ৩ হাজার নেতা-কর্মীর অবস্থান লক্ষ্য করা গেলেও রাত বাড়ার সাথে সে সংখ্যা বেড়ে ১০ হাজারে উন্নীত হয়। শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রায় ৩৫ হাজারে পৌছেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি। দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে আগত এসব নেতা-কর্মী ও সমর্থকগণ বেলপার্কের খোলা আকাশের নিচে রাতযাপন করেন। এদের অনেকেই চুলা ও তৈজসপত্র নিয়ে সভাস্থলে অবস্থান করে রান্না করে খাবার তৈরি করে খাচ্ছেন।
এদিকে গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে সারা দেশের সাথে বিচ্ছিন্ন বরিশাল মহানগরীতে ইজিবাইক ও গ্যাসচালিত থ্রী-হুইলারসহ সব ধরনের যানবাহনও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এমনকি নগরী জুড়ে হাতে গোনা কিছু রিকশা চললেও চালকদের মধ্যে যথেষ্ঠ ভয়ভীতি কাজ করছে। ফলে নিত্য যানজটের এ নগরীতে শুক্রবার সকাল থেকে বেশিরভাগ রাস্তাঘাটই প্রায় ফাঁকা। নিত্যকার যানজটে নাকাল হবার কোনো বিড়ম্বনা নেই। থেমে গেছে ট্রাফিক পুলিশের বাঁশিও।
এদিকে বিএনপির মিডিয়া সেলের প্রধান সাবেক এমপি জহিরউদ্দিন স্বপন জানান, কোনো বাধা বিঘ্ন বরিশালের গণসমাবেশকে রুদ্ধ করতে পারবে না। এ গণসমাবেশ মহাসমাবেশর রূপ নেবে বলেও দাবি করেন তিনি। কেন্দ্রীয় নেতা ও যুবদলের সাবেক সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল গতকাল শুক্রবারেই নিজের শহরে পৌছে শনিবারের গণসমাবেশ সফল করতে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সাথে সমন্বয় করে জনসংযোগসহ নানা তৎপড়তায় অংশ নিচ্ছেন। কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এবিএম জাহিদ হোসেন পুরো গণসমাবেশ বাস্তবায়নে সমন্বয়কের দায়িত্বে রয়েছেন।
এদিকে ১০ নভেম্বর বরিশালে যুবলীগের কর্মসূচিকে সামনে রেখে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতেও আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডের অলিগলিতে মিছিল করেছে। তবে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে মিছিল নিয়ে শনিবারের গণসমাবেশের পক্ষে প্রচারণা চালায়। শুক্রবারও দিনভর বিএনপির স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বরিশাল মহানগরীতে লিফলেট বিতরণসহ নানামুখী প্রচারণায় ছিলেন।
নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে শনিবার বরিশালে বিভাগীয় গণসমাবেশ চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা ও রংপুরের মতো কতটা সফল হয় তা দেখার অপেক্ষায় আছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল। কারণ বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো অনেকটাই নৌপথ নির্ভর। সড়ক ও নৌযোগাযোগ বন্ধ করে দেয়ায় দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকগণ কোন পথে কিভাবে সমাবেশস্থলে পৌঁছবেন তার ওপরই নির্ভর করছে এ গণসমাবেশে লোক সমাগমসহ পরিপূর্ণ সফলতা। এ মন্তব্য করে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল নিবিড়ভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণসহ সময়ের অপেক্ষা করছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন