’৭৪ সালে আবাহনীর খেলোয়াড়দের মাঝে শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ কামাল (বামে), ’৭৩ সালে ছেলে শেখ রাসেলকে নিয়ে খেলা উপভোগ করছেন বঙ্গবন্ধু (মাঝে), বোন শেখ রেহানার ছেলে ববিকে নিয়ে খেলা দেখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
মোঃ আলতাফ হোসেন : বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। যার সুদক্ষ নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর লাল সবুজের এই বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছিলো। রাজনৈতিক জীবনে প্রতিষ্ঠিত সেই মহান নেতা যে একজন দক্ষ ফুটবলার ছিলেন তা হয়তো অনেকেরই অজানা। চল্লিশের দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকা ওয়ান্ডার্স ক্লাবের যখন রমরমা অবস্থা, তখন বঙ্গবন্ধু এই ক্লাবের হয়েই ফুটবল মাঠ মাতিয়েছেন। জাতির জনক ফুটবল খেলতেন স্ট্রাইকার পজিশনে। দেশ স্বাধীনের সময় তিনি জাতিকে যেমন করে দক্ষতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছেন, ঠিক তেমনি ক্রীড়াঙ্গণে ঢাকা ওয়ান্ডার্স ক্লাবকেও নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত তিনি ফুটবল খেলেছেন ওয়ান্ডার্সের হয়েই। অধিনায়কের দায়িত্বও পালন করেন। তার নেতৃত্বেই তখন ওয়ান্ডার্স ক্লাব বগুড়ায় অনুষ্ঠিত একটি গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টের শিরোপা জয় করে। তবে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ওয়ান্ডার্স ক্লাবের পক্ষ থেকে তেমন কোনো স্বীকৃতি পাননি। যদিও তিনি ধানমন্ডি ক্লাবেরও প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তার মৃত্যুর পর সেই পদ এখন অলংকৃত করছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বঙ্গবন্ধু নিজে যেমন খেলাধুলা পছন্দ করতেন, তেমনি সবাইকে খেলাধুলার প্রতি উৎসাহ যোগাতেন। একটি উদাহরণ দিলে সবাই তা বুঝতে পারবেন। আজকের যে কলাবাগান মাঠ, স্বাধীনতার পূর্বে সেটা ছিলো সিএন্ডবি’র ডিপো। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি পড়েছিলো সেখানে। বঙ্গবন্ধু স্থানীয় ক’জনকে ডেকে বললেন, ‘তোরা এখানে খেলাধুলা করিস না ক্যান?’ সেই সময় ডলফিন কোচের স্বত্বাধিকারী ফজলুর রহমান রাজ, মরহুম রাশেদ মোশারফ, জালাল মেম্বার, হেলালউদ্দিন, বাবু ভাই প্রমুখরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করলেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ডিপো সরিয়ে নেয়ার পর তার আর্থিক অনুদান এবং অনুপ্রেরণায় কলাবাগান মাঠ সংস্কার করা হয়। ১৯৭২ সালে শেখ কামাল ও শেখ জামাল মাঝে মাঝে এই মাঠে ফুটবল খেলতে আসতেন। ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরের কোনো একদিন বঙ্গবন্ধু নিজেই মাঠে নেমে পড়েছিলেন ফুটবল খেলার জন্য। একটি পরিবারের বাবা যদি ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়ানুরাগী হন, তাহলে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও সে পথেই হাঁটবেন, এটাই স্বাভাবিক। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথই অনুসরণ করে গেছেন তাঁর দুই ছেলে শেখ কামাল ও শেখ জামাল। এই দু’ভাইয়ের মধ্যে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন শেখ কামাল। তিনি ফুটবল, ক্রিকেট ও বাস্কেটবল তিনটি খেলাতেই সমান পারদর্শী ছিলেন। তবে ফুটবলে আনুষ্ঠানিকভাবে লিগে না খেললেও আবাহনীর হয়ে তিনি ক্রিকেট খেলেছেন। ক্রিকেটের মাঠে একজন দক্ষ অফ স্পিনার হিসেবে তার যথেষ্ট সুনাম ছিলো। আর বাস্কেটবল খেলেছেন ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের হয়ে। তার অধিনায়কত্বে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে বাস্কেটবল লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়। মহসীন স্মৃতি ট্রফিও ঢাকা ওয়ান্ডারার্স জয় করে তারই অধিনায়কত্বে। আজকের আবাহনী ক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শেখ কামাল। শুরু থেকে এই ক্লাব শুধু আবাহনী ক্লাব নামে পরিচিত ছিলো না। সেই সময় এই ক্লাবের নাম ছিলো আবাহনী সমাজ কল্যাণ সমিতি। অনেক চড়াই উৎড়াইয়ের পর জন্ম নেয় আবাহনী ক্রীড়াচক্র (বর্তমানে যা আবাহনী লিমিটেড নামে পরিচিত)। শেখ কামালের পাশাপাশি শেখ জামালও অবদান রেখেছেন আবাহনী প্রতিষ্ঠায়। তিনি ভালোমানের হকি খেলোয়াড়ও ছিলেন। শুধু তাই নয় বঙ্গবন্ধু পুত্রবধূ শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল খুকি ছিলেন বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ অ্যাথলেটদের একজন। বঙ্গবন্ধুর খুবই প্রিয় ছিলেন তিনি। ১৯৭৩ সালে সুলতানা কামাল খুকি নিখিল ভারতে গ্রামীণ ক্রীড়ায় অংশ নিতে গিয়েছিলেন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদরা যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু সুলতানা কামালকে বলেছিলেন, ‘বাঙালীর মান রাখতে পারবি তো’? খুকি এক কথায় উত্তর দিয়েছিলেন, ‘পারবো’। কথা রাখতে পেরেছিলেন তিনি। ‘জয়বাংলা’ বলে লংজাম্প দিয়েছিলেন খুকি। সেবার দ্বিতীয় হয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে এটাই হয়ে দাঁড়ায় রেকর্ড। পুরো ভারত থেকে আসা সেরা মেয়েদের পেছনে ফেলেন তিনি। পরে কোন এক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু হাসতে হাসতে খুকিকে বলেছিলেন, ‘তুই তো আমার সবচেয়ে প্রিয়’। খুকি তখনো বঙ্গবন্ধুর পুত্রবধূ হননি। তাই জাতির জনকের এই কথা নিয়ে ভাইবোনদের মধ্যে কতো হাসি-ঠাট্টা হতো!
১৯৬৭ সালে মুসলিম গার্লস কলেজ থেকে এসএসসি পাস করেন খুকি। তার এক বছর আগেই জাতীয় অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপের লংজাম্পে রেকর্ড গড়ে স্বর্ণপদক জিতে তাক লাগিয়ে দেন। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান অলিম্পিক গেমসে লংজাম্পে নতুন রেকর্ড গড়েন খুকি। ২ বছর পর অল পাকিস্তান মহিলা অ্যাথলেটিক্সে লংজাম্পে খুকি নতুন রেকর্ড গড়েন। মেয়েদের মধ্যে সেরা হন তিনি। ১৯৭৩ সালে ১০০ মিটার হার্ডলসেও প্রথম জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাথলেটিক্সের প্রথম নারী ব্লু খুকি। বঙ্গবন্ধু খুবই স্নেহ করতেন তার পুত্রবধূকে। আসলে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সবাই খুকিকে খুব পছন্দ করতেন। খুকির বড় ভাই বাবুল ছিলেন শেখ কামালের বন্ধু। ১৯৭৫ সালে মৃত্যুর কিছুদিন আগেও হার্ডলসে স্বর্ণপদক জিতেছিলেন তিনি। সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে ফলাফল আর জানতে পারেননি শেখ কামালের স্ত্রী। মাস্টার্সের ফল বের হওয়ার আগেই ঘাতকদের হাতে প্রাণ দিলেন বাংলাদেশের ক্রীড়াজগতের ‘অনন্যা’ এই তারকা। তবে খুকি শুধু একজন ভালো অ্যাথলেটই নন, ছিলেন দক্ষ সংগঠকও। মেয়েরা খেলাধুলায় নিয়মিতভাবে এগিয়ে আসে, ক্রীড়ার প্রতি নারীরা যেন উৎসাহী থাকে, সে জন্য রীতিমিতো কাউন্সিলিং করাতেন তিনি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে স্মৃতি হয়ে গেছেন শেখ রাসেল। যেমনটা হয়েছেন ৩২ নম্বর রোডের বাড়িটিতে বঙ্গবন্ধু পরিবারের অন্য সাতজন। গোলাগুলির বিভীষিকার মধ্যে দুই ভাবী সুলতানা কামাল ও শেখ জামালের স্ত্রী রোজীর কাছে আশ্রয় খুঁজেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছোট ছেলে শেখ রাসেল। ততোক্ষণে হিং¯্র সাপদের দল হত্যা করেছে বঙ্গবন্ধুকে। শেখ রাসেলের লাশ পাওয়া গেছে দুই ভাবীর লাশের মাঝে। বাঁচতে চেয়েছিলো রাসেল, বাঁচাতে চেয়েছিলেন ভাবীরা। পরবর্তীতে শেখ রাসেলের নামে প্রতিষ্ঠা হয় শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্র। পাইওনিয়র, তৃতীয়, দ্বিতীয়, প্রথম বিভাগ হয়ে বর্তমানে দেশের সর্বোচ্চ আসর বাংলাদেশ প্রিমিয়ার ফুটবল লিগের অন্যতম শক্তিশালী দল এখন শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্র।
বঙ্গবন্ধু পরিবারের মধ্যে বেঁচে থাকা দু’মেয়ে শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানাও দারুণ রকম ক্রীড়ানুরাগী। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তো সব সময়ই দেশের খেলাধুলার খোঁজ রাখেন। তিনি এতোটাই ক্রীড়াপ্রেমী যে যেখানে খেলা, শত ব্যস্ততার মাঝেও সেখানেই ছুটে যান শেখ হাসিনা। উৎসাহ যোগান লাল-সবুজ ক্রীড়াবিদদের।
লেখক- সাবেক ক্রীড়াবিদ ও চেয়ারম্যান মানিকগঞ্জ গ্রীণক্লাব
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন