বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে চার জেলায় পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়েছে। কোনো যানবাহন চলছে না এবং চলতে দেয়া হচ্ছে না। উপরোন্ত ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা হুন্ডা দিয়ে সিলেট শহরের প্রবেশ মুখে টহল দিচ্ছে; হুমকি ধমকি দিচ্ছে। তারপরও পুণ্যভূমি সিলেটের মানুষকে আটকানো যাচ্ছে না। কোনো বাঁধাই আটকানো যাচ্ছে না বিএনপির কর্মী সমর্থকদের। পায়ে হেঁটে, ভ্যানে, সাইকেলসহ নানাভাবে ছুটছেন; সবার গন্তব্য আলিয়া মাদরাসা মাঠ। রাতেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে সিলেট আলিয়া মাদরাসার মাঠ। খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে মাঠে ঢুকছে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা নেতাকর্মীরা। প্রস্তুত সমাবেশ মঞ্চ। সমাবেশে আসা নেতাকর্মীরা উৎসবে মেতেছে। রাত্রিযাপনের জন্য তৈরি করা ক্যাম্প থেকে ভেসে আসছে দলীয় গান। গানের তালে তালে নাচছে কেউ কেউ। এদিকে স্থানীয় নেতাকর্মীরা মাঠের মধ্যে দলবদ্ধ হয়ে মিছিল করছে। মানুষের চাপ সামলাতে না পেরে অনেকেই সমাবেশস্থলের পাশে সড়কের উপর অবস্থান নিয়েছে। কেউ কেউ আড্ডা আর খোশগল্পে মেতে উঠেছে।
নৌপথে, সড়ক পথে বাঁধার সকল প্রাচীর দুমড়ে মুচড়ে তারা পৌছে যাচ্ছে সমাবেশ গন্তব্যে। সমাবেশে প্রতিধ্বনিতে একাকার হয়ে পড়েছে গোটা সিলেট বিভাগ। মুখে মুখে এক সুর সমাবেশ-সমাবেশ। সমাবেশের সকল প্রস্তুতি ঝাঁকজমক পূর্ণভাবে করেছে বিএনপি। আজ এ গণসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখবেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ইতোমধ্যে সমাবেশের মূল মঞ্চ প্রস্তুত করা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় মঞ্চে টানিয়ে দেয়া হয় মূল ব্যানার। এছাড়াও সমাবেশস্থলে শতাধিক মাইক বসানো হয়েছে। এবং মঞ্চ থেকে দূরে থাকা নেতাকর্মীদের সমাবেশ স্পষ্টভাবে দেখানোর জন্য দুটি ‘বড় পর্দা’ স্থাপন করা হয়েছে। এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী। তিনি বলেন, আমাদের গণসমাবেশ সফল করতে সকল ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে মঞ্চ প্রস্তুত করা হয়েছে। তাছাড়া সমাবেশস্থল ও আশপাশে নেতৃবৃন্দের বক্তব্য প্রচার করতে শতাধিক মাইক লাগানো হয়েছে। এছাড়াও দুটি ‘বড় পর্দা’ স্থাপন করা হয়েছে। তিনি হয়রানির অভিযোগ করে বলেন, সরকার আমাদের সমাবেশকে ভয় পাচ্ছে। ইতোমধ্যে আমাদের নেতাকর্মীদের সমাবেশে যাতে না আসতে পারে সেজন্য যানচলাচল বন্ধ করে দিয়ে বাঁধাগ্রস্থ করছে। যারা আসছে তারা পথে পথে ভোগান্তির শিকার হয়েছে। সরকারের এমন বাঁধা আমাদের থামিয়ে রাখতে পারবে না। সিলেটের গণসমাবেশে জনসমুদ্র সৃষ্টি হবে। একই সুর তুলেছেন সমাবেশর অন্যতম মেকার, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেছেন, প্রতিটা জায়গায় চুলকানি দেওয়া হচ্ছে তারপরও রাতেই জনসমুদ্রে পরিণত হবে মাঠ। গতকাল দুপুরে সমাবেশস্থল আলিয়া মাদরাসা মাঠ পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের কাছে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
মেয়র আরো বলেন, আমরা বাধা-বিপত্তি মাথায় নিয়েই সকল কাজ গত ১৩ বছর ধরে করছি। আজকে (শুক্রবার) রাতের মধ্যেই দেখবেন যে সমস্ত শহর লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়বে। বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে জনতা আসছে। বাধা-বিপত্তি যে হচ্ছে না, সেটা কেউ বলতে পারবে না।
এদিকে, গতকাল থেকেই বিভিন্নস্থান থেকে উপস্থিত হয়েছেন হাজার হাজার বিএনপির নেতাকর্মী। সমাবেশ ময়দানে বেশকিছু নেতাকর্মী একেকজন একেক দায়িত্ব পালন করছেন। প্রত্যেকেই আছেন ফুরফুরে মেজাজে, উৎসব-উৎসবভাবে। মঞ্চের তিন পাশে নির্মাণ করা হয়েছে বিভাগের বিভিন্ন এলাকা নেতাদের উদ্যোগে ক্যাম্প। ক্যাম্পে ক্যাম্পে আয়োজন করা হয় খাবারের। ক্যাম্পগুলোতে মজুদ করে রাখা হয় চালের বস্তা, তেল ও রান্নার সামগ্রী। কয়েকজন নারীকে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, মরিচ কাটতে দেখা যায়। প্রতিটি ক্যাম্পেই বড় বড় ডেকচিতে হচ্ছে রান্নাবান্না। গতকাল জুম্মার নামাজের পর প্রতিটি ক্যাম্পে খাবার পরিবেশন করা হয়। প্রত্যেক ক্যাম্পেই নিজেদের মানুষ ছাড়া অন্যান্য নেতাকর্মীদেরও খাবার দেওয়া হয়। এছাড়াও মাঠের প্রবেশমুখে ডা. জোবায়দা রহমান ফ্রি ফুড ক্যাম্প। এ ক্যাম্প থেকে সমাবেশস্থলে আসা নেতাকর্মীদের পানি ও শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।
অপরদিকে, সুনামগঞ্জের তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, মধ্যনগর, ধর্মপাশা ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার হাওর এলাকা থেকে শতাধিক ইঞ্জিন নৌকা দিয়ে সিলেটের আলিয়া মাদরাসা মাঠে বিএনপির গণসমাবেশে গতকাল বিকেলে পৌঁছেন বিএনপির হাজারো নেতাকর্মী এবং সমর্থক। পরিবহন ধর্মঘট ঘোষণা করায় সমাবেশের দুইদিন আগেই নৌকাযোগে রওনা দেন নেতাকর্মীরা। শুক্রবার ও শনিবার সুনামগঞ্জসহ সিলেট বিভাগের বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে পরিবহন ধর্মঘট ডাক দেয়ায় বিকল্প পথে গতকাল বৃহস্পতিবার মাইলের পর মাইল নদীপথ পাড়ি দিয়ে শতাধিক ইঞ্জিন নৌকা চড়ে নেতাকর্মীরা পৌঁছেন নগরীর সুরমা নদীর কাজিরবাজার এলাকায়। তারপর মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত করে পৌছে যান সমাবেশ ময়দানে। তাহিরপুর উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি, উত্তর বড়দল ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কাসেম বলেন, লক্ষ্য একটাই গণসমাবেশ সফল করা। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা। ধর্মঘট ডাকায় বিকল্প পথ হিসেবে নৌকা পথেই নেতাকর্মী ও সমর্থকরা রওয়ানা দিয়েছেন। নৌকাতেই রান্নাবান্না করে খাচ্ছেন এবং শীত উপেক্ষা করে নৌকাতেই ঘুমাচ্ছেন।
সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির সহসভাপতি, তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আনিসুল হক বলেন, বিএনপির সিলেট বিভাগীয় গণসমাবেশ বাধাগ্রস্ত করতে সরকারের ইশারায় সমাবেশের দিন ও আগের দিন বিভাগ জুড়ে অন্যায়ভাবে পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়েছে। জেলা বিএনপির নেতৃত্বে প্রায় ৮ হাজার মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে নেতাকর্মীরা সড়ক পথে গতকাল সমাবেশস্থলে ও উদ্দেশে রওনা হয়েছেন।
সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক এমপি কলিম উদ্দিন আহমদ বলেন, সরকার বিএনপির গণজোয়ার দেখে দিশেহারা হয়ে পরিবহন মালিকদের উপর চাপ সৃষ্টি করে পরিববহন বন্ধ করেছে। তিনি আরো বলেন, বিএনপি হচ্ছে সাধারণ মানুষের দল। পরিবহন বন্ধ করেও বিএনপির গণসমাবেশ বানচাল করতে পারবেনা সরকার।
এদিকে, বিপুল সংখ্যক বিএনপি নেতাকর্মীদের উপস্থিতির সুযোগে মোবাইল চুরির হিড়িক পড়েছে আলীয় ময়দানে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে মোবাইল ও মানিব্যাগ চুরির কোনো তথ্য নেই বলে গতকাল সন্ধ্যায় মহানগর পুলিশের ডিসি আজবাহার আলী শেখ জানিয়েছেন। তিনি জানান, মোবাইল বা মানিব্যাগ চুরির তথ্য আমাদের কাছে নেই। কেউ অভিযোগ করলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব। এছাড়া বিএনপির গণসমাবেশে বিভাগের বাইরের জেলাগুলো থেকেও দলটির নেতাকর্মীরা যোগ দিচ্ছেন। সমাবেশস্থল আলিয়া মাদরাসা মাঠে নেত্রকোণা থেকে আসা বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে দেখা গেছে। এসব নেতাকর্মীর দাবি হচ্ছে, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরকে মুক্তি দিতে হবে। বাবরের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোণা জেলার মদন উপজেলার বারি ভাদারায়। তিনি ছিলেন নেত্রকোণা-৪ আসনের সংসদ সদস্য।
অপরদিকে, সমাবেশের সকল প্রস্তুতিতে নিজের একান্ত কার্যক্রম দিয়ে নজর কেড়েছেন দলটির সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। বিএনপি নেতাকর্মীরা বলছেন, দক্ষ হাতে সব সামলে এখন প্রশংসা কুড়িয়েছেন আরিফ। সিসিকের কাজে গত ৩১ অক্টোবর আমেরিকা সফরে যান মেয়র আরিফ। আমেরিকা সফরে যাওয়ার আগে সিলেটের গণসমাবেশকে ঘিরে দায়িত্বশীল নেতাদের সাথে বৈঠক করেন। গণসমাবেশের প্রচারণায় নগরীজুড়ে বড় বড় বিলবোর্ড টানিয়েছেন তিনি। সেসব বিলবোর্ডে জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া, তারেক রহমান ছাড়াও প্রয়াত সাইফুর রহমান ও নিখোঁজ ইলিয়াস আলীর ছবি রয়েছে। বিএনপি অন্য নেতাদের বিলবোর্ডে সাইফুর রহমান ও ইলিয়াস আলীর ছবি দেখা যায়নি। তাদের ছবি বিলবোর্ডে দিয়ে আরিফুল হক চৌধুরী নিজেকে ব্যতিক্রম হিসেবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। সবার নজর কাড়ছেন তিনি। এবারের গণসমাবেশে আরিফের কার্যক্রম দেখে মনে হয়েছে, দল ও নেতাকর্মীদের প্রতি তার মনোযোগ অনেক বেড়ে গেছে। ##
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন