কুমিল্লায় বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে নগরীতে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যার আগেই সমাবেশস্থল নগরীর টাউন হল মাঠ নেতা কর্মীদের উপস্থিতিতে পূর্ণ হয়ে গেছে। বিভিন্ন উপজেলা থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল সহকারে নেতাকর্মীরা আসছে। এছাড়া কুমিল্লার আশপাশের জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর থেকে নেতাকর্মীরা গতকালই সমাবেশস্থলে অবস্থান নিয়েছে। পুরো কুমিল্লা নগরী ব্যানার ফেস্টুন পোস্টারে ছেয়ে গেছে। স্থানীয় নেতারা বলছেন, আজকের সমাবেশ হবে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ সমাবেশ। এ সমাবেশের মাধ্যমে আবারো প্রমাণ হবে যে মানুষ এখন জেগে উঠেছে। জনগণ আর এই ভোট চোর অবৈধ সরকারকে দেখতে চায় না। যে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে তার মাধ্যমেই এ সরকারের পতন হবে।
কুমিল্লায় বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হচ্ছে আজ শনিবার। প্রায় আট বছর পর এধরণের সমাবেশের দৃশ্যপট ভেসে উঠবে কুমিল্লার ঐতিহাসিক টাউনহল মাঠে। ২০১৪ সালের ২৯ নভেম্বর বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া টাউনহল মাঠে সমাবেশ করেন। এরপর আর কুমিল্লায় বড় কোন সমাবেশের আয়োজন করতে পারেনি দলটি। আজকের গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে কুমিল্লায় বিএনপি বিশাল শোডাউনের প্রস্তুতি নিয়েছে। সমাবেশ সফল করতে সব প্রস্তুতি গতকাল শুক্রবার রাতের মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। সমাবেশের বক্তব্য শোনার জন্য নগরীর প্রতিটি পয়েন্টে মাইক থাকবে। এ ছাড়া অন্তত আটটি স্থানে বড় পর্দায় সরাসরি সমাবেশের কার্যক্রম দেখা ও বক্তব্য শোনার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
গণসমাবেশ সফল করতে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে বিএনপি। সমাবেশ শুরুর একদিন আগেই পার্শ্ববর্তী চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা-উপজেলা থেকে বিএনপির বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী ও সমর্থক কুমিল্লা নগরীতে প্রবেশ করছে। তারা নগরী ও আশপাশের হোটেল, বিএনপি নেতাদের নির্মাণাধীন খালি ফ্ল্যাটে ও নেতাকর্মীদের বাসাবাড়িতে অবস্থান নেন। সেখানেই তারা উৎসবমুখর পরিবেশে খাওয়া-দাওয়া ও রাতযাপন করেন। সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের যাতে অসুবিধা না হয়, তার জন্য ১০টি উপ-কমিটি নিরলসভাবে কাজ করছে। প্রতিটি ইউনিটের বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের সমাবেশে থাকার পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও সমাবেশে উপস্থিত করতে বলা হয়। পাশের জেলা চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সমাবেশে আগতদের একটি বড় অংশ সমাবেশস্থল টাউনহলে রাত যাপন করবে। গত বৃহস্পতিবারও দলের অনেক কর্মী টাউনহল মাঠে সামিয়ানা টানিয়ে রাত যাপন করেছে।
গতকাল শুক্রবার নগরীর সকল জামে মসজিদে জুমার নামাজে অতিরিক্ত মুসল্লীতে ছিল উপছে পড়া ভিড়। বিভিন্ন স্থান থেকে আসা স্থানীয় বিএনপির নেতকর্মীরা সমাবেশস্থল টাউনহল মাঠে জুমার নামজ আদায় করেন। এছাড়া কেন্দ্রীয় নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও বরকত উল্লাহ বুলুসহ অনেকেই টাউনহল মাঠে জুমার নামাজের জামাতে অংশ নেন।
কুমিল্লাসহ নিকটের চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা-উপজেলা থেকে প্রতিটি এলাকার বিএনপি ও বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের দায়িত্বশীল নেতাদের বিপুল সংখ্যক কর্মী-সমর্থক নিয়ে সমাবেশে উপস্থিত থাকতে কেন্দ্র থেকে আগেই নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। সে কারণে গতকাল শুক্রবার বেলা ১২টা থেকে বিকেল ৪টার মধ্যে চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লার সকল উপজেলা থেকে নেতাকর্মীরা পিকআপভ্যানে করে মিছিল নিয়ে নগরীতে প্রবেশ করে। আগে যেকটি বিভাগীয় সমাবেশ করেছে বিএনপি, সেই তুলনায় কুমিল্লার গণসমাবেশে নেতা, কর্মী,সমর্থকদের সমাবেশস্থলে তথা কুমিল্লায় আসাটা ছিল অনেকটা সহজতর। আওয়ামী লীগ বা পুলিশি কোন বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি তাদের। তবে বিএনপির স্থানীয় নেতারা জানিয়েছেন, বিভিন্ন বিভাগে অনুষ্ঠিত বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে যেভাবে বাধা দেয়া হয়েছে কুমিল্লায়ও তার ব্যতিক্রম হবে না এমনটি মাথায় রেখেই সকল প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে আটটায় টাউনহল মাঠের চারদিন ব্যাপী বইমেলার আয়োজন শেষ হওয়ার পরপরই কুমিল্লা নগরীতে বিএনপি নেতাকর্মীদের মিছিলের ঢল নামে। এসব মিছিল টাউনহল মাঠে জড়ো হতে থাকে এবং মঞ্চের কাজ চলা সময়ে তারা মাঠেই অবস্থান করে। অপরদিকে গতকাল দিনভর বিভিন্ন এলাকা থেকে সমাবেশ স্থলে আসেন বিএনপির অনেক নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। সেখানে তারা স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করে তোলেন। রাতে তাদের একটি অংশ সমাবেশস্থলে থাকলেও বাকিরা বিএনপির স্থানীয় নেতাদের ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন হোটেল, বাসা-বাড়িতে অবস্থান করেন।
অপরদিকে নগরীর প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ডিজিটাল ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার ও বিলবোর্ড সাঁটিয়েছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। কান্দিরপাড় এলাকায় সমাবেশস্থলের পাশে বিলবোর্ড, ফেস্টুন ও ব্যানারে সয়লাব। এ ছাড়া নগরী ও ইউনিয়ন পরিষদের প্রায় সবকটি ওয়ার্ডেই পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন সাঁটানো আছে। দলের শীর্ষ নেতাদের স্বাগত জানিয়ে এসব ব্যানার-ফেস্টুন টানানো হয়েছে। গোটা কুমিল্লাজুড়ে বিরাজ করছে সাজ সাজ রব। গতকাল বিকেল থেকে কুমিল্লা মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়। এদিকে গতকাল বেলা ১১টায় নগরীর একটি টাওয়ারের হলরুমে গণসমাবেশ সফল করার লক্ষ্যে সংবাদ সম্মেলন করেছে বিএনপি। সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক মন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ দাবি করেন, সমাবেশে লোক সমাগম ঠেকাতে চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিভিন্ন উপজেলায় নেতা কর্মীরা হামলা-মামলার শিকার হচ্ছেন। গত আট দশদিন ধরে চাঁদপুরের অ্যাডভোকেট সলিমুল্লাহ বাড়িতে হামলা হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় নাসিরের বাড়িতে হামলা হয়েছে। লাকসাম, মনোহরগঞ্জে হামলা, গ্রেফতার হচ্ছে নেতাকর্মীরা। তিনি বলেন, এ সরকার দিনের ভোট রাতে নিয়েছে। গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে, ব্যাংক লুট করেছে, ব্যাংকে ডলার নাই, এলসি খোলা যাচ্ছে না, এ সরকারের বিদায় ঘণ্টা বেজে গেছে। কুমিল্লার সমাবেশ থেকে এ অবৈধ সরকারকে লাল কার্ড দেখানো হবে। সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আমিন উর রশিদ ইয়াছিন, কুমিল্লা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক মিয়া।
সংবাদ সম্মেলন শেষে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা সমাবেশস্থল টাউনহল মাঠ পরিদর্শন করেন। এসময় খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, কোনো অপশক্তি আমাদের নেতাকর্মীদের দমিয়ে রাখতে পারবে না। সকাল থেকে সারা শহরে মিছিল হচ্ছে। নেতাকর্মীতে ভরে গেছে শহর। সুতরাং কুমিল্লা নগরী জনগণের মহানগরীতে পরিণত হয়েছে। তারাই আজকের সমাবেশ সফল করবেন।
বিএনপির সমাবেশ আয়োজক সূত্রে জানা গেছে, আজকের সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখবেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, বিএনপি ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল প্রমুখ। সভাপতিত্ব করবেন কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহবায়ক আমিন উর রশিদ ইয়াছিন।
এদিকে বিএনপির সমাবেশ নিয়ে আইনশৃংখলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে জেলা পুলিশ সর্তক রয়েছে বলে জানান কুমিল্লা পুলিশ সুপার আবদুল মান্নান। পুলিশ সুপার বলেন, যে কোন সমাবেশ আয়োজন হলে পুলিশ সর্তক থাকে। এটা স্বাভাবিক। আমরাও সর্তক থাকবো যেন কোন প্রকার অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে সাধারণ মানুষের কোন সমস্যা না হয়। এছাড়াও আমাদের বাড়তি নজরদারী থাকবে সড়কগুলোতে। যেন যানজট সৃষ্টি না হয়।
উল্লেখ্য, জ্বালানি তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, পুলিশের গুলিতে দলের ৫ কর্মী নিহত হওয়ার অভিযোগ করে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার প্রতিবাদে ও খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে ১২ অক্টোবর থেকে বিভাগীয় গণসমাবেশ কর্মসূচি শুরু করে বিএনপি। প্রথম গণসমাবেশ হয় চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ডে। এরপর ১৫ অক্টোবর ময়মনসিংহ, ২২ অক্টোবর খুলনা, ২৯ অক্টোবর রংপুর, ৫ নভেম্বর বরিশাল, ১২ নভেম্বর ফরিদপুর, ১৯ নভেম্বর সিলেটে গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় আজ কুমিল্লায় বিভাগীয় গণসমাবেশ।
কুমিল্লার সমাবেশে মুরাদনগরের ২৫ হাজার নেতাকর্মী:
বিএনপির কুমিল্লা বিভাগীয় গণসমাবেশে মুরাদনগর উপজেলা থেকে ২৫ হাজার নেতাকর্মী মিছিল নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। গতকাল শুক্রবার রাতে এসব নেতাকর্মী বিশাল মিছিল নিয়ে কুমিল্লার টাউন হল মাঠে প্রবেশ করেন। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদের তত্ত্বাবধানে উপজেলা বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ছাত্রদলসহ সকল অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে শনিবারের গণসমাবেশ সফল করতে উপস্থিত হয়েছেন। এ সময় উপস্থিত নেতারা দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, সমাবেশের উদ্দেশ্যে ঢাকা থেকে গেঞ্জি, ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে আসার পথে পুলিশ বিএনপি একজন নেতা ও দুইজন কর্মীকে গ্রেফতার করে। মিছিলে উপস্থিত ছিলেন- মুরাদনগর উপজেলা বিএনপির সভাপতি মহিউদ্দিন অঞ্জন, সাধারণ সম্পাদক মোল্লা মজিবুল হক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মোস্তাক আহমেদ, সাংগঠনিক সম্পাদক শাহআলম চেয়ারম্যান, উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক সোহেল আহমেদ, উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক এ্যাডভোকেট নাছির উদ্দিন, আন্দিকোট ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মুজিব। তারা বলেন, কুমিল্লা মুরাদনগর উপজেলা থেকে কাজী শাহ্ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদের নেতৃত্বে বিএনপির অঙ্গ সংগঠনের প্রায় ২৫ হাজার নেতাকর্মীদের বিশাল মিছিল নিয়ে শুক্রবার রাতে কুমিল্লা টাউন হল মাঠে বিএনপির গণসমাবেশ সফল করতে শত বাধা পেরিয়ে তারা অংশগ্রহণ করেন নেতাকর্মীরা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন