শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রভাষক হতে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা ঘুষ : টিআইবি

পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা প্রণয়ন ও কার্যকর বাস্তবায়নের দাবি : ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শরা নিয়োগ পান না

| প্রকাশের সময় : ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : উচ্চ শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে দেশের সরকারি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রভাষকসহ শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত কার্যক্রমে অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় উন্নত বিশে^র ন্যায় একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা বা নির্দেশিকা প্রণয়নের দাবি জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
রাজনৈতিক মতাদর্শ, আঞ্চলিকতা, স্বজনপ্রীতি, ধর্মীয় পরিচয় ও আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে প্রভাষক নিয়োগকে প্রভাবিত করে এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সমর্থনকারী সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার কারণে অভিপ্রায় মোতাবেক নিয়োগ কমিটিতে বিশেষজ্ঞ নির্বাচনের সুযোগ অন্যতম। ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করে দেখা গেছে যে আটটি বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রভাষক নিয়োগে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। এ পদে নিয়োগে ৩ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত  লেনদেন করা হয়েছে।
গতকাল রবিবার দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়। ‘সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক নিয়োগ : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এই গবেষণা প্রতিবেদনের বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন টিআইবির দুই গবেষক দিপু রায় ও রেযাউল করিম।
গবেষণায় আরো সম্পৃক্ত ছিলেন একই বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. মোস্তফা কামাল এবং তত্ত্বাবধান করেন সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার আবু সাঈদ মো. জুয়েল মিয়া। সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ড-এর সদস্য অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপ-নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান।
বিশ^বিদ্যালয়ে প্রভাষক নিয়োগে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করার পাশাপাশি নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে অনিয়ম ও দুর্নীতির ধরন চিহ্নিত করাসহ প্রতিরোধে সুপারিশ প্রদানের লক্ষ্যে গুণগত গবেষণাটি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ তথ্যের বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে ২০১৬ সালের জানুয়ারি  থেকে নভেম্বর সময়কালের মধ্যে পরিচালিত হয়েছে। এই গবেষণায় ২০০১ সাল থেকে ২০১৬ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে অনুষ্ঠিত প্রভাষক নিয়োগ সংক্রান্ত তথ্য সংগৃহীত হয়। বিশ^বিদ্যালয়ের ধরন, ভৌগলিক অবস্থান ও প্রতিষ্ঠাকাল বিবেচনা করে সাধারণ আটটি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দু’টি, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি দু’টি এবং একটি কৃষিসহ মোট ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয় এ গবেষণার জন্য নির্বাচন করা হয়। তবে প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত তথ্য, পর্যবেক্ষণ ও মন্তব্য সকল বিশ^বিদ্যালয়ের সকল বিভাগের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য নয়।
নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানত ছয়টি ধাপ অনুসরণ ও প্রতিটি ধাপে বিশ^বিদ্যালয় এবং নিয়োগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও কমিটি জড়িত থাকা সত্ত্বেও গবেষণায় বেশ কিছু আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করা হয়েছে। যার মধ্যে বেশিরভাগ বিশ^বিদ্যালয়ে প্রভাষক নিয়োগের জন্য পূর্ণাঙ্গ বিধিমালা না থাকা, চাহিদা যাচাই ও সময় অনুযায়ী উপস্থাপন করার ব্যাপারে জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থার অনুপস্থিতি এবং সিন্ডিকেটে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সমর্থনকারী সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার কারণে অভিপ্রায় মোতাবেক নিয়োগ কমিটিতে বিশেষজ্ঞ নির্বাচনের সুযোগ অন্যতম। এছাড়া, নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি ও সিন্ডিকেটের প্রধান হিসেবে ভিসি ও প্রো-ভিসি নিয়োগ কার্যক্রম প্রভাবিত করার সুযোগ, পরীক্ষার ফলাফল যাচাই ও অভিযোগ দায়ের এবং জমাকৃত নথির বিপরীতে প্রাপ্তি স্বীকারের ব্যবস্থা ও পরীক্ষা সংক্রান্ত তথ্য জানার সুযোগ না থাকায় প্রভাষক নিয়োগে অনিয়ম ঘটছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, বেশিরভাগ বিশ^বিদ্যালয়ে নির্দিষ্ট প্রার্থী বা প্রার্থীদের নিয়োগের উদ্দেশ্যে বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃক সুবিধা অনুযায়ী প্রার্থিতার যোগ্যতা পরিবর্তন এবং বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীর জন্য যে কোনো শর্ত শিথিলযোগ্য বলে উল্লেখ করা হয়। অন্যদিকে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী বা অপছন্দের প্রার্থীদেরকে কম যোগ্যতাসম্পন্ন দেখানোর জন্য তথ্য গোপন করা, নিয়োগ পরীক্ষার পূর্বেই কোন প্রার্থী বা প্রার্থীদেরকে নিয়োগের সুপারিশ করা হবে তা নিয়োগ কমিটির সদস্যদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ এবং পূর্ব নির্ধারিত প্রার্থী না হলে তাকে অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন বা মন্তব্য করে বিব্রত করার মতো দৃষ্টান্ত রয়েছে। বিজ্ঞপ্তির অতিরিক্ত দ্বিগুণ এবং ক্ষেত্র বিশেষে তিনগুণ পর্যন্ত শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ এবং নোট অব ডিসেন্ট-কে গুরুত্ব না দেওয়ার তথ্য উ˜্ঘাটিত হয়েছে গবেষণায়। এছাড়া কোনো রকম যাচাই ছাড়াই সিন্ডিকেট কর্তৃক নিয়োগ অনুমোদন, ভোট বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নিয়োগ প্রদান, রাজনৈতিক মতাদর্শ, আঞ্চলিকতা, স্বজনপ্রীতি, ধর্মীয় পরিচয় ও আর্থিক লেনদেনের (আটটি বিশ^বিদ্যালয়ে বিধি-বহির্ভূতভাবে তিন  থেকে ২০ লক্ষ টাকা) অভিযোগ প্রভাষক নিয়োগকে প্রভাবিত করছে বলে এ প্রতিবেদনে বলা হয়। স্বায়ত্তশাসিত হওয়ায় নিজেদের মতো নিয়োগের নিয়ম-কানুন তৈরি ও বোর্ড গঠনের মাধ্যমে মেধাবীদের বঞ্চিত করে তুলনামূলক কম মেধাবীদের নিয়োগ দেওয়ায় ঘটনা ঘটছে। যার ফলে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ হিসেবে সরকারি বিশ^বিদ্যালয়গুলো শিক্ষাদানসহ শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জনের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি ব্যাহত হচ্ছে এবং শিক্ষার্থীরা মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তাঁর অভিজ্ঞতার আলোকে টিআইবি’র গবেষণা প্রতিবেদনের ফলকে বাস্তব আখ্যায়িত করে বলেন, একজন শিক্ষকও যদি নিয়ম বহির্ভূতভাবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন, তাহলে তিনি একটি বিশ^বিদ্যালয়ের চল্লিশ বছরের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ান। কিছু ভালো বিশ^বিদ্যালয়ের উদাহরণের উল্লেখ করে তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, সরকার উচ্চশিক্ষা কমিশন ও এক্রেডিয়েশন কাউন্সিল গঠনের সময় অত্র প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো বিবেচনা করবে।
সরকারি বিশ^বিদ্যালয়গুলোর প্রভাষক নিয়োগের সার্বিক চিত্রকে হতাশাজনক ও উদ্বেগজনক আখ্যায়িত করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিশ^বিদ্যালয়গুলো রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। জাতীয় রাজনৈতিক বিভাজন এখন দেশের শিক্ষকদের মধ্যকার দ্বিধা-বিভাজনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালীর সাথে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রভাবশালীর একাংশের সমঝোতার ফলে বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে নানা ধরনের অনিয়মের ঘটনা ঘটছে। এক্ষেত্রে বিদ্যমান পরিস্থিতির উন্নয়নে সুশাসন নিশ্চিত করতে পারলে উচ্চ শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা সম্ভব।
গবেষণায় উত্থাপিত প্রধান কয়েকটি সুপারিশ হলো- পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা বা নির্দেশিকা প্রণয়ন, নিয়োগ প্রক্রিয়াকে শিক্ষক সমিতির প্রভাবমুক্ত রাখা, ভিসি ও প্রো-ভিসি নিয়োগ বিধিমালা প্রণয়ন, শিক্ষক সমিতির কার্যক্রম সীমিতকরণ এবং ফলাফল ইঞ্জিনিয়ারিং বন্ধকরণ। এছাড়া, শিক্ষকদের কর্মভার বিবেচনা করে শিক্ষক নিয়োগের চাহিদা যাচাই ও উপস্থাপন, প্রভাষক পদে আবেদন করার যোগ্যতা বা নিয়ম পূর্ব থেকে সুনির্দিষ্ট করা, নিয়োগ কমিটি গঠনের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন, আবেদনের জন্য পর্যাপ্ত সময় প্রদান, স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় প্রার্থীতা মূল্যায়ন নিশ্চিতকরণ, নিয়োগ পরীক্ষার নম্বর প্রদানের সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি থাকা, নোট অব ডিসেন্ট’কে গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নেওয়া, নিয়োগ সংক্রান্ত অভিযোগ দায়ের ও নিষ্পত্তির ব্যবস্থা, প্রার্থীদের আবেদন সাপেক্ষে নিয়োগ সংক্রান্ত তথ্য জানার ব্যবস্থা এবং নিয়োগ-বিধি লঙ্ঘনের কার্যকর জবাবদিহিতা ও শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিতের সুপারিশ করা হয়েছে।
২০০১ সাল থেকে ২০১৬ সালের ঘটনা নিয়ে গবেষণাটি করা হয়েছে। তবে গবেষণাটি করা হয়েছে এ বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। দেশের ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গবেষণাটি পরিচালিত হয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন