পল্টনে সংঘর্ষের মামলায় জামিন মেলেনি বিএনপির সিনিয়র নেতাদের। এর ফলে আইনের শাসন ভূলুণ্ঠিত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন দলটির নেতা, আইনজীবী ও বিশ্লেষকরা। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসসহ ২২৪ নেতা-কর্মীর জামিন আবেদন নাকচ হওয়ার পর তারা এ মন্তব্য করেন।
গতকাল সোমবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শফিউদ্দিনের আদালত বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসসহ ২২৪ নেতা-কর্র্মীর জামিন আবেদন নাকচ করে দেন। জামিনের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট সৈয়দ জয়নুল আবেদীন মেজবাহ, সুপ্রিম কোর্টের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মো: জয়নুল আবেদীন, ঢাকা বারের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মাসুদ আহম্মেদ তালুকদার। তাদের সহযোগিতা করেন অ্যাডভোকেট মহিউদ্দিন চৌধুরী, জাকির হোসেন জুয়েল ও শেখ শাকিল আহম্মেদ রিপন।
জামিন শুনানিতে আইনজীবীরা বলেন, তারা একটি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতা। মির্জা ফখরুল ইসলাম এবং মির্জা আব্বাসের বয়স সত্তরোর্ধ্ব। বয়সজনিত নানা রোগে আক্রান্ত। তাছাড়া দু’জনেই সাবেক মন্ত্রী। যে মামলায় তাদের আসামি করা হয়েছে সেটির এজাহারে তাদের নাম নেই। এ মামলারই এজাহারভুক্ত বিএনপি নেতা আমানউল্লাহ আমান, আব্দুল কাদের ভুইয়া জুয়েলকে জামিন দেয়া হয়েছে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং মির্জা আব্বানের নাম এজাহারে নেই। জামিন লাভ তাদের আইনি অধিকার।
তাদের জামিন আবেদনের বিরোধিতা করেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আবু। তিনি বলেন, তাদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া একাধিক মামলার তদন্ত চলছে। এজাহারে পুলিশের ওপর ককটেল হামলা চালিয়ে অর্ধশত পুলিশ সদস্যকে আহত করার অভিযোগ রয়েছে। মামলাটির তদন্ত চলছে। আসামিরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই তাদের জামিন দেয়া হলে তদন্ত প্রক্রিয়ায় তারা প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেন। তাই তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আসামিদের করাগারে রাখা প্রয়োজন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে বিএনপি নেতাদের জামিন আবেদনটি নাকচ করে দেন। এর আগে গত রোববার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) রেজাউল করিম চৌধুরীর আদালতে জামিন প্রার্থনা করেন বিএনপি নেতাদের আইনজীবীরা। আদালত শুনানির জন্য সোমবার তারিখ ধার্য করেন।
গত ৮ ডিসেম্বর ভোরে বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে উত্তরার নিজ বাসা থেকে এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে শাজাহানপুরস্থ বাসা থেকে আটক করে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সদস্যরা। তাদের সঙ্গে ‘কথা আছে’ বলে সাদা পোশাকের গোয়েন্দা সদস্যরা তুলে নিয়ে আসে। কথা শেষে বাসায় পৌঁছে দেয়া হবেÑ মর্মে জানানো হয় পরিবারের সদস্যদের। কিন্তু পরের দিনও তাদের বাসায় পৌঁছানো হয়নি। পরে দুই নেতাকে নয়াপল্টন বিএনপি কার্যালয়ের সামনে ককটেল বিস্ফোরণ ও পুলিশের ওপর হামলার মামলায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে মর্মে জানায় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। বেলা ২টার দিকে এ মামলায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও মির্জা আব্বাসকে গ্রেফতার করার কথা স্বীকার করে ডিবি। সংস্থার প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ বলেন, ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা হয়েছিল। ঘটনার ‘নির্দেশদাতা’ হিসেবে গ্রেফতার করা হয়েছে।
পরদিন ৯ ডিসেম্বর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও মির্জা আব্বাসকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। এ সময়ও মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের কারাগারে আটকে রাখার আবেদন জানান মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর তরিকুল ইসলাম। বিএনপি নেতাদের পক্ষে জামিন চাওয়া হলেও ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জসিম জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠিয়ে দেন।
গত ৭ ডিসেম্বর বিকেলে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এতে পুলিশের গুলিতে বিএনপিকর্মী মকবুল হোসেন নিহত হন। আহত হন অনেকে। এ সময় বিএনপি কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে চাল-ডাল, পানি, নগদ টাকা ও বিস্ফোরক দ্রব্য পাওয়া গেছে বলে দাবি করে পুলিশ। সংঘর্ষের পর ৪৭৩ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় দেড় থেকে দুই হাজার বিএনপি নেতাকর্মীকে আসামি করে মামলা করা হয়। পুলিশ বাদী হয়ে রাজধানীর পল্টন মডেল থানায় এ মামলা করে।
এজাহারভুক্ত আসামিদের মধ্যে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রূহুল কবির রিজভি, ঢাকা দক্ষিণের আহ্বায়ক আব্দুস সালাম, ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান, বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সেলিমুজ্জামান সেলিম, কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী, সাবেক এমপি সেলিম রেজা হাবিব, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আব্দুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল অন্যতম। পুলিশের ওপর হামলা-মামলায় তাদের ৭ ডিসেম্বর গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃত বিএনপি নেতাদের ৮ ডিসেম্বর ঢাকার সিএমএম কোর্টে হাজির করা হলে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন আমানউল্লাহ আমান এবং বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আব্দুল কাদের ভুঁইয়া জুয়েলের জামিন মঞ্জুর করেন। যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভিসহ ৪৩৪ জনকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। সরকারপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে বিএনপির ১৪ কেন্দ্রীয় নেতার ২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
গতকালের শুনানি অনুষ্ঠিত হয় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মির্জা আব্বাসসহ অন্য এজাহারভুক্ত আসামিদের অনুপস্থিতিতেই। শুনানিকালে বিএনপিপন্থী অন্তত অর্ধশত আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। জামিন আবেদনের শুনানি উপলক্ষে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ।
এদিকে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত প্রধান বিরোধী দলের সিনিয়র নেতাদের জামিন আবেদন নাকচ হয়ে যাওয়াকে আইনের শাসন ভূলুণ্ঠিত হয়েছে বলে মন্তব্য করছেন আইনজীবীরা। বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, বিএনপির সিনিয়র নেতাদের গ্রেফতারটাই ছিল বেআইনি। সম্পূর্ণ মিথ্যা মামলায় তাদের আসামি করা হয়েছে। বিষয়টি আমরা আইনগতভাবেই মোকাবেলা করব। তিনি বলেন, সিএমএম কোর্ট জামিন আবেদন নাকচ করে দিয়েছেন। আলাপ-আলোচনা করে আমরা পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেবো।
জামিন নাকচ হওয়ার পর সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি সিনিয়র অ্যাডভোকেট মো: জয়নুল আবেদীন বলেন, দেশে আইনের শাসন নেই। থাকলে তারা নিশ্চয়ই জামিন পেতেন। জামিন লাভের জন্য যেসব ‘গ্রাউন্ড’ দরকার সবগুলোই জামিন প্রার্থীদের রয়েছে। বিএনপির মহাসচিব অত্যন্ত অসুস্থ। ডায়াবেটিসসহ নানা জটিল রোগ রয়েছে। মির্জা আব্বাসও অসুস্থ। তাকেও অনেক ওষুধ খেতে হয়। উভয়েরই বয়স হয়েছে। সমাবেশের স্থান নিয়ে সারারাত পুলিশের সঙ্গে দেন-দরবার করে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে তারা ভোরের দিকে মাত্র বাসায় ফিরেছেন। তখনই তাদের অমানবিকভাবে বাসা থেকে তুলে এনেছে পুলিশ। অসুস্থতাসহ জামিনের সবগুলো কারণই আদালতে তুলে ধরা হয়েছে। তারপরও তাদের জামিন দেয়া হয়নি। অথচ এ ধরনের মামলায় মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জামিন হওয়ার বহু নজির রয়েছে।
এদিকে পরিবেশ ও মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’-এইচআরপিবির প্রেসিডেন্ট সিনিয়র অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, জামিন দেয়া কিংবা না দেয়ার বিষয়ে আদালতের এখতিয়ার রয়েছে। কিন্তু বিবেচনায় রাখতে হবে যে, মামলাটি রাজনৈতিক। রাজনৈতিক কারণে সংঘর্ষ হয়েছে। পুলিশ হামলা করেছে। বিএনপির কর্মীরা হয়তো পাল্টা হামলা করেছেন। মামলা হওয়ার পর রাজনৈতিক বিষয়টিই আইনগত বিষয় হয়ে গেছে। এ ধরনের মামলার ক্ষেত্রে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।
এর আগে গত রোববার বিএনপি কার্যালয়ে পুলিশি তাণ্ডব, গুলিতে বিএনপি কর্মী নিহত হওয়ার ঘটনাকে ‘মানবাধিকার পরিপন্থী’ উল্লেখ করে বিবৃতি দেন ২৪ বিশিষ্ট নাগরিক। সভা-সমাবেশকে সংবিধানসম্মত মৌলিক অধিকার উল্লেখ করে তা লঙ্ঘন থেকে বিরত থাকতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তারা। বিবৃতিতে রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘিরে খবরদারি, নাগরিকদের দেহ ও মোবাইল ফোন তল্লাশিসহ পুলিশের বিভিন্ন ধরনের তৎপরতাকে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার পরিপন্থী বলে উল্লেখ করে এমন ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান। বিবৃতিতে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান, মানবাধিকারকর্মী ড. হামিদা হোসেন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী, শিক্ষাবিদ আনু মুহাম্মদ, আইনজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক, অ্যাডভোকেট সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, অ্যাডভোকেট সালমা আলী প্রমুখ স্বাক্ষর করেন।
উল্লেখ্য, বিএনপির পূর্বঘোষিত ১০ ডিসেম্বরের ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশকে সামনে রেখে ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এতে মকবুল হোসেন নামে এক বিএনপিকর্মী নিহত হন। আহত হন অনেকে। এ ঘটনায় পল্টন মডেল থানা, মতিঝিল এবং শাহজাহানপুর থানায় পৃথক ৩টি মামলা করে পুলিশ। এসব মামলায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের নাম উল্লেখসহ কয়েক হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন