শীর্ষ নেতৃত্বসহ শত শত নেতাকর্মী আটক, হামলা, মামলা, পরিবহন বন্ধ, মোড়ে মোড়ে তল্লাশি, কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে লণ্ডভণ্ড অবস্থা, সমাবেশ স্থল নিয়ে নানা নাটকীয়তার পরও ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশে বিপুল মানুষের উপস্থিতি আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে বিএনপিকে। দলটির নেতারা বলছেন, সরকার মনে করেছিল শীর্ষ নেতৃত্বকে গ্রেফতার করলে এবং রাজধানীজুড়ে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করলে বিএনপির গণসমাবেশে মানুষের উপস্থিতি কমে যাবে, ব্যর্থ হবে সমাবেশটি। কিন্তু সকল প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে গত ১০ ডিসেম্বর গোলাপবাগের সফল গণসমাবেশ নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করেছে। অনুপ্রেরণা যুগোচ্ছে আগামী দিনের কর্মসূচি নির্ধারণে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, পুলিশ বাহিনী আমাদের অফিসকে লণ্ডভণ্ড করেছে। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীল ও মির্জা আব্বাসকে রাতের অন্ধকারে তুলে নিয়ে গেছে। কোনো কাজ হয়নি। এই সরকার নিজেরাই রাস্তাঘাট ও যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। লাখ লাখ মানুষ ঢাকার সমাবেশে অংশগ্রহণ করে শান্তিপূর্ণভাবে তা সফল করেছে।
জ্বালানি তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, নেতাকর্মীদের হত্যার প্রতিবাদ, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ আটক নেতাকর্মীদের মুক্তি এবং মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে গত ২২ আগস্ট থেকে ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, পৌরসভা, থানা, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে বিক্ষোভ সমাবেশ শুরু করে দলটি। পরবর্তীতে একই কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় ১২ অক্টোবর থেকে বিভাগীয় শহরে গণসমাবেশ শুরু হয়। পরিবহন, নৌপথ ধর্মঘট, নেতাকর্মীদের সমাবেশে আসতে বাধা প্রদান, বিভিন্ন স্থানে হামলা, মামলা, গ্রেফতারের পরও ৯টি বিভাগীয় শহরেই বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী-সমর্থক-মানুষের অংশগ্রহণ করে। সবশেষ ঢাকার সমাবেশ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তুমুল উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমানের ঘোষণা ‘১০ ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়ার কথায়’, পরবর্তীতে প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীও একই ধরণের বক্তব্য দিলে ১০ ডিসেম্বরের ঢাকার গণসমাবেশ নিয়ে শুরু হয় নানা আলোচনা-সমালোচনা। বিএনপি নেতাকর্মী ও অনেক সাধারণ মানুষও মনে করেছিলেন সেদিন কিছু ঘটতে যাচ্ছে। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে বার বার পরিষ্কার করে বলা হয়, অন্যান্য বিভাগীয় গণসমাবেশের ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবেই ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় গণসমাবেশ হবে এবং সেখান থেকে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
পরবর্তীতে সমাবেশের স্থান নিয়ে নানা নাটকীয়তা, সমাবেশের আগে গত ৭ ডিসেম্বর পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ, নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পুলিশের তল্লাশি, বিএনপির শীর্ষ নেতা মির্জা ফখরুল, মির্জা আব্বাস, আব্দুস সালাম, রুহুল কবির রিজভী, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, ফজলুল হক মিলনসহ সাড়ে ৪শ’ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। মামলা দেয়া হয় একাধিক নেতার বিরুদ্ধে। ওইদিন থেকেই বন্ধ ছিল বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং নয়াপল্টন সড়ক ছিল পুলিশের নিয়ন্ত্রণে। ৯ ডিসেম্বর পুলিশ গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশের অনুমতি দিলে ১০ ডিসেম্বর সেখানে লাখো মানুষের জমায়েত করে বিএনপি।
শীর্ষ নেতাদের আটক, ঢাকায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারি, মোড়ে মোড়ে তল্লাশি, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের পাহারার পরও বিএনপির সমাবেশ সফল করাকেই অর্জন হিসেবে মনে করছেন দলটির নেতারা। ছাত্রদলের সাবেক সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমিনুর রহমান আমিন বলেন, বিএনপির সভা-সমাবেশগুলো সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বেড়েছে। তারা কাউকে দেখতে কিংবা কারো বক্তব্য শোনার জন্য আসে না। মানুষ বর্তমান সরকারের দুঃশাসন, নির্যাতন, নিপীড়নে অতিষ্ট, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি কারণে সংসার চালাতে পারছে না। তারা মনে করে এই সরকারের বিদায় হওয়া প্রয়োজন, যেটি বিএনপির নেতৃত্বেই সম্ভব। এজন্যই তারা প্রতিবাদ জানাতে উপস্থিত হচ্ছেন। এটি বিএনপি নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করে তুলেছে। বিএনপি গণমানুষের দল, মানুষের দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করছে, মানুষও এর প্রতি সমর্থন দিয়েছে। তাই এই সরকার আর বেশিদিন ক্ষমতায় টিকতে পারবে না।
যুবদল কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি মাহবুবুল হক ভূইয়া পিংকু বলেন, মানুষ এখন কষ্টে আছে, তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা চিন্তিত। তারা এই সরকারের কাছ থেকে মুক্তি চায়। বিএনপির সমাবেশগুলোতে মানুষ যেভাবে উপস্থিত হয়েছে সেটাতে এটিই প্রমাণিত হয়।
শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতারের পরও বিএনপির সমাবেশে লাখো মানুষের সমাগম কিভাবে সম্ভব হল? জানতে চাইলে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ বলেন, বিএনপির অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় এখন সাংগঠনিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা থেকে শুরু করে দলের মহাসচিব পর্যন্ত সকলেই ঐক্যবদ্ধ, সকলকে তিনি এক সুতোয় গেঁথেছেন। ফলে এখন সব নেতাকেও যদি সরকার কারাবন্দী করে নেয় তারপরও প্রয়োজনে ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিবেন।
তিনি বলেন, আমাদের নেতা ঢাকার সমাবেশের আগে নির্দেশনায় দিয়েছিলেন গ্রেফতার হতে হতে যে কর্মী অবশিষ্ট থাকবে সেই ঢাকার সমাবেশের নেতৃত্ব দিবে।
বিএনপির সমাবেশে যারা আসেন তারা দেশের জন্য মানুষের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত জানিয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আমাদের সভা সমাবেশে কাউকে টাকা দিয়ে আনা হয় না। আমাদের সমাবেশে যারা আসেন তারা দেশের জন্য ও মানুষের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। আর অন্য দলের সভায় যারা যান তাদের বিরিয়ানি খাওয়া থেকে শুরু করে টাকা-পয়সা ও টি-শার্ট দিয়ে সমাবেশে নিয়ে আসেন।
স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আমরা ৯টি বিভাগীয় সমাবেশ করেছি। প্রতিটি সমাবেশে ধর্মঘট ডেকে বাধা দিয়েছে। আওয়ামী লীগ পেটোয়া বাহিনী বাধা দেওয়ার পরও সমাবেশ সফল হয়েছে। ৯টি বিভাগীয় সমাবেশে সব বাধাবিপত্তি জয় করেছে জনগণ। তারা সাতরিয়ে, হেটে, সাইকেল-ভ্যানে করে চিড়া-গুড়-মুড়ি নিয়ে বিএনপির সমাবেশে দুই-তিনদিন আগে উপস্থিত হয়েছে।
তিনি বলেন, সরকার ১০ ডিসেম্বর ঢাকার গণসমাবেশ ব্যর্থ করতে চেয়েছিল। এজন্য বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসহ অনেক নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু পারেনি। সেদিন সরকার পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়েছে। এ সমাবেশে শুধু নেতাকর্মী নন, সাধারণ মানুষও এসেছে। সরকারের ব্যর্থতার পরিষ্কার বার্তা দিতে জনগণ পাশে ছিল এসব সমাবেশে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন