পৌষের শুরুতেই রংপুর বিভাগসহ উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে শীত জেঁকে বসেছে। হাসপাতালগুলোতে শীত জনিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে উত্তরাঞ্চল। দিনের বেলায় হেডলাইট জ্বালিয়ে যানবাহন চলাচল করছে সড়ক-মহাসড়ক দিয়ে। ঘন কুয়াশার ফলে সড়ক দুর্ঘটনার শঙ্কাও বেড়ে গেছে। কুয়াশায় দূরে দেখা না যাওয়ায় গত ১৫ ডিসেম্বর ঢাকা টু রংপুর মহাসড়কে একদিনে ১৫টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে ও কুয়াশার ফলে সিএনজি পিকআপের সংঘর্ষে ৪ জন নিহতের ঘটনা ঘটেছে। টাঙ্গাইল মহাসড়কে এক দিনে ৭টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। শুধু তাই নয় ঘন কুয়াশার কারণে ঢাকার হজরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করতে পারেনি কয়েকটি ফ্লাইট। উত্তরাঞ্চলের মতো দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে শীতের তীব্রতা বাড়ছে। গতকাল চুয়াডাঙ্গায় ৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। যা সারাদেশের মধ্যে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা।
ঋতুর পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে পৌষ মাষের শুরুতেই বাংলাদেশের সর্ব উত্তরের হিমালয় পাদদেশীয় সীমান্তবর্তী জেলা রংপুর, লালমনিরহাট, নিলফামারী, কুড়িগ্রামে বাড়তে শুরু করেছে শীতের প্রকোপ। সন্ধ্যা থেকে সকাল, ঝরে পড়ছে শিশির। সেইসঙ্গে কুয়াশার চাদরে ঢেকে থাকছে প্রকৃতি। মধ্যরাত থেকে ঘন কুয়াশা পড়ায় সতর্কতার সঙ্গে যানবাহন চালাচল করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একদিকে ঘন কুয়াশা অন্যদিকে শীত বাড়তে থাকায় বাড়ছে শীতজনিত নানা রোগ। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও জেলা হাসপাতালগুলোতে ডায়রিয়া ও শ্বাসকষ্ট রোগীর ভিড় বাড়ছে। বিশেষ করে শিশুরা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। রংপুর বিভাগীয শহরের ভ্যানগাড়ি চালক মো. মানিক মিয়া জানান, দিনের বেলা ঠান্ডা কম থাকলেও সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভোরবেলা ঠান্ডা বেশি থাকায় দেরিতে কাজে বের হতে হচ্ছে।
কুড়িগ্রাম রাজারহাট আবহাওয়া ও কৃষি পর্যবেক্ষণাগারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তুহিন মিয়া জানান, দিন দিন এই অঞ্চলের তাপমাত্রা হ্রাস পাচ্ছে। শীতের তীব্রতা বাড়ছে। গত কয়েকদিন ধরে এই অঞ্চলে তাপমাত্রা ১২ দশমিক ৫ ডিগ্রি থেকে ১৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে এই অঞ্চলের ওপর দিয়ে মৃদু অথবা মাঝারি আকারের শৈতপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সংবাদদাতা জানান, শীতের তীব্রতা বাড়তে শুরু করেছে উত্তরের জনপদ নীলফামারীতে। সন্ধ্যার পর তাপমাত্রা কমে ১৪ থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। কুয়াশার কারণে দিনেও হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করছে যানবাহন। গত তিন থেকে চার দিন ধরে এ অঞ্চলে সূর্যের দেখা মিললেও ঠান্ডা কমছে না। সন্ধ্যার পর থেকে বইছে ঠান্ডা বাতাস, মাঝারি কুয়াশায় ঢেকে আছে সৈয়দপুরের শহর-গ্রাম। সকাল ৮টা পর্যন্ত যানবাহন চলাচল করছে হেডলাইট জ্বালিয়ে। ঠান্ডা জেঁকে বসতে শুরু করায় বাড়ছে ছিন্নমূল মানুষের দুর্ভোগ। শীতবস্ত্রের অভাবে কোনোমতে পুরোনো কাঁথা-কম্বল জড়িয়ে রাত পার করছে তারা। পাশাপাশি হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে ঠান্ডাজনিত নানা রোগে আক্রান্তের সংখ্যা। এদের মধ্যে শিশুরাই বেশি।
গাইবান্ধা সংবাদদাতা জানান, রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে ও কুয়াশার ফলে ১৫ ডিসেম্বর সিএনজি পিকআপের সংঘর্ষে ৪জন নিহতের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় আহত হয়েছেন আরো ২ জন। গত তিনদিন থেকে উত্তরাঞ্চলে শীত জেঁকে বসেছে। পড়ছে বৃষ্টির মতো কুয়াশা। এর ফলে বাড়ছে ঠাণ্ডাজনিত রোগ। রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের জেলায় জেলায় প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর কুয়াশা থেকে বাঁচতে খড়কুটা জ্বালিয়ে আগুন পোহাচ্ছে মানুষ। এই আগুন পোহাতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ হয়ে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ২৬ জন দগ্ধ রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে বলে জানান চিকিৎসক।
আবহাওয়া দপ্তরের তথ্যমতে, রংপুরে আজকের তাপমাত্রা ১৪ ডিগ্রি থেকে ১৫ ডিগ্রিতে ওঠানামা করছে। তীব্র ঠাণ্ডা আর ঘন কুয়াশায় সবচেয়ে বিপাকে রয়েছেন নিম্নআয়ের খেটে খাওয়া মানুষ। অনেকে ঘন কুয়াশার ফলে ঘর থেকে বের হতে পারছেন না।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ কামরুল হাসান জানান, গত দুদিন ধরে রংপুর জেলায় তাপমাত্রা উঠানামা করছে। আগামী দুই সপ্তাহ আরো ঠাণ্ডা বাড়তে পারে বলে জানান এই কর্মকর্তা। শুক্রবার ভোররাত থেকে সকাল পর্যন্ত ঘন কুয়াশা পড়ছে রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে।
ঘন কুয়াশার কারণে টঙ্গাইলের সড়কে প্রতিদিন দুর্ঘটনা ঘটছে। গত ১৫ ডিসেম্বর একদিনে টাঙ্গাইলের বিভিন্ন এলাকায় ১৮টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ দুর্ঘটনায় কলেজছাত্রসহ ৩ জন নিহত ও ১৫ জন আহত হয়েছেন।
এদিকে ঘন কুয়াশার কারণে ঢাকার হজরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান অবতরণে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। ১৫ ডিসেম্বর ঘন কুয়াশার কারণে আজ বৃহস্পতিবার ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৪টি ফ্লাইট অবতরণ করতে পারেনি। বেশ কয়েক ঘণ্টা আকাশে ঘোরাঘুরি করার পর, একটি ফ্লাইট চট্টগ্রামে এবং ৩টি ফ্লাইট ভারতের কলকাতা বিমানবন্দরে স্থানান্তর করা হয়।
বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, ঘন কুয়াশার কারণে ফ্লাইটের পাইলটরা অবতরণের আগে রানওয়ে দেখতে পাননি। ফলে দোহা ও শারজাহ থেকে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ২টি ফ্লাইট এবং আবুধাবি থেকে ঢাকায় এয়ার এরাবিয়ার একটি ফ্লাইট অবতরণ করতে ব্যর্থ হয় এবং কলকাতা বিমানবন্দরের দিকে ডাইভার্ট করা হয়। পরে ফ্লাইটগুলো নিরাপদে সেখানে অবতরণ করে। দুবাই থেকে ঢাকাগামী ফ্লাই দুবাইয়ের ফ্লাইট ঢাকার পরিবর্তে চট্টগ্রামে ডাইভার্ট করা হয়েছে। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স, ভিস্তারা এয়ারলাইন্স এবং গালফ এয়ারসহ বেশ কয়েকটি ফ্লাইটও শাহজালালে দেরিতে অবতরণ করে। একই কারণে ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে প্রায় ডজনখানেক ফ্লাইট নির্ধারিত সময়ে ছেড়ে যেতে পারেনি।
শাহজালাল বিমান বন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মো. কামরুল ইসলাম জানান, রানওয়ের দৃশ্যমানতা কম থাকায় ৪টি ফ্লাইট ঢাকায় অবতরণ করতে না পেরে চট্টগ্রাম ও কলকাতায় অবতরণ করেছে। কুয়াশার ওপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তবে আমরা জনবল বাড়ানোসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছি যাতে কুয়াশা কেটে যাওয়ার পর অনেকগুলো ফ্লাইট একই সময়ে অবতরণের পর দ্রুত অভিবাসন ও অন্যান্য কাজ করা যায়।
চুয়াডাঙ্গা সংবাদদাতা জানান, গতকাল দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রায় কাঁপছে চুয়াডাঙ্গা। গতকাল চুয়াডাঙ্গায় ৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। যা সারাদেশের মধ্যে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে মৃদু শৈতপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। ছিন্নমূল ও অসহায় মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। শীতজনিত কারণে সদর হাসপাতালে বাড়ছে শিশু রোগীর সংখ্যা।
তীব্র শীতে প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া কেউ ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন না। ফলে সব থেকে বেশি সমস্যায় পড়েছেন দিন এনে দিন খাওয়া মানুষেরা। শুক্রবার ভোরে এলাকার বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে ও চায়ের দোকানে শীত নিবারণের চেষ্টায় আগুন জ্বালিয়ে উত্তাপ নিতে দেখা গেছে নিম্ন আয়ের মানুষদের। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের দেখা মিললেও শৈত্যপ্রবাহের কারণে কমেনি শীতের দাপট।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ সিনিয়র কনস্যাল্টটেন্ট আসাদুর রহমান মালিক খোকন জানান, তীব্র শীতে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে রোটাভাইরাস জনিত কারণে ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়াসহ শীতজনিত বিভিন্ন রোগে হাসপাতালের আউটডোরে তিন শতাধিক বয়োবৃদ্ধরা চিকিৎসা নিচ্ছেন। এছাড়া প্রতিদিন তিন থেকে চারশ শিশু আউটডোরে চিকিৎসা নিয়েছে। শীতজনিত কারণে নিউমোনিয়া রোগী সংখ্যা বাড়ছে। ##
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন