অনির্বাচিত কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার বিপরীতে ‘রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা’ দিতে যাচ্ছে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। আগামীকাল সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে এই রূপরেখা ঘোষণা করবেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। আগামীতে রাষ্ট্র ক্ষমতায় গেলে সব মত ও পথের সমন্বয়ে রংধনু জাতি প্রতিষ্ঠান করতে চায় দলটি। সেই লক্ষ্যে রাষ্ট্রকাঠামো ও সংবিধানের সার্বিক সংস্কারে ২৭ দফা রূপরেখা তৈরি করেছে বিএনপি। রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা নিয়ে ইতোমধ্যে সমমনা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মতামতের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংযোজন-বিয়োজনের পর রাষ্ট্রের সার্বিক সংস্কারের এই রূপরেখা চূড়ান্ত করা হয়েছে।
বিএনপি সূত্র জানায়, অনির্বাচিত কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার বিপরীতে ‘রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা’ ঘোষণা করা হবে। প্রস্তাবিত রূপরেখা অনুযায়ী বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে মূল ভিত্তি রেখেই প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে সব মত ও পথের সমন্বয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক জাতি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেবে বিএনপি। রূপরেখায় এ ধারণাকে ‘রেইনবো নেশন’ (রংধনু জাতি) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ জন্য গণতান্ত্রিক রূপান্তরের লক্ষ্যে রাষ্ট্রের সার্বিক সংস্কারের পদক্ষেপ নেওয়া হবে। জনকল্যাণে সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে সংবিধান, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও নির্বাচন ব্যবস্থায় আসবে নানা পরিবর্তন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার দেশের অর্থনীতি, শাসন ব্যবস্থাসহ সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছে। যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছে তাতে যদি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে কেউ নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় দায়িত্ব পায় তাহলেও দেশ চালাতে পারবে না। রাষ্ট্রকে এই ধ্বংসস্তুপ থেকে বের করে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলতে মেরামতের প্রয়োজন। বিএনপি এই প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা তৈরি করেছে। তিনি বলেন, এই রূপরেখা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, পেশাজীবীদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তাদের কিছু প্রস্তাবনা ছিল সেগুলোও এতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, আগামীতে নির্বাচনের মাধ্যমে যেসরকার গঠন করা হবে সেখানে সকল দল মিলে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। সেই সরকারই রাষ্ট্র সংস্কার করে রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে রূপান্তর করে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে।
রূপরেখার সূচনায় বলা হয়েছে, দেশের জনগণ গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল, সে রাষ্ট্রের মালিকানা আজ তাদের হাতে নেই। বর্তমান কর্তৃত্ববাদী সরকার দেশের রাষ্ট্র কাঠামোকে ভেঙে চুরমার করে ফেলেছে। এ রাষ্ট্রকে মেরামত ও পুনর্গঠন করতে হবে। দেশের জনগণের হাতেই দেশের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে জয়লাভের পর বর্তমান ফ্যাসিস্ট সরকার হটানোর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে একটি ‘জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ ‘জাতীয় সরকার’ সংস্কারমূলক ব্যবস্থাদি গ্রহণ করবে।
বিএনপি নেতারা জানান, আগামীতে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিজয়ী হলে বর্তমান সরকারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে একটি ‘জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ তথা ‘জাতীয় সরকার’ গঠনের মাধ্যমে এই রূপরেখা বাস্তবায়ন করা হবে। দলের হাইকমান্ড থেকে ইতোমধ্যে এ বিষয়টি ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
বিএনপির প্রস্তাবিত রূপরেখার বিষয়ে ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, রূপরেখা প্রণয়নের বিষয়ে বিএনপি আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেছে। আমরা যেখানে প্রয়োজন করেছি সেখানে মতামত দিয়েছি।
রাষ্ট্র সংস্কার রূপরেখার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তিনি বলেন, রাষ্ট্র যে পর্যায়ে গেছে, সকল কাঠামো ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। দেশ, বিচার বিভাগ, অর্থনীতি, প্রশাসন, পুলিশ, শিক্ষা ব্যবস্থাসহ সবকিছু ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। এগুলোসহ সংবিধানকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সংস্কার অত্যাবশকীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংস্কার না হলে যারাই রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসুক দেশ চালাতে পারবে না।
তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সকল দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। যারা রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংস্কার করবে।
বিএনপির ২৭ দফা রূপরেখায় যা আছে:
১. ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন’ গঠন করে সব বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক সাংবিধানিক সংশোধনী ও পরিবর্তনগুলো পর্যালোচনা করে এসব রহিত/সংশোধন করা হবে এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় সাংবিধানিক সংস্কার করা হবে। সংবিধানে গণভোট ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃস্থাপন করা হবে।
২. প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে সব মত ও পথের সমন্বয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক ‘রেইনবো-নেশন’ প্রতিষ্ঠা করা হবে। ভবিষ্যৎমুখী এক নতুন ধারার সামাজিক চুক্তিতে পৌঁছতে হবে। এজন্য একটি ‘জাতীয় সমঝোতা কমিশন’ গঠন করা হবে।
৩. ‘নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে।
৪. অর্থবিল, আস্থা ভোট, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন এবং সংবিধান সংশোধনী বিল ব্যতীত অন্যসব বিষয়ে সংসদ সদস্যদের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হবে।
৫. প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট ও সরকারের প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা হবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্যের সুসমন্বয় করা হবে।
৬. ‘দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা’ প্রবর্তন করা হবে।
৭. কার্যকর নির্বাচন কমিশন গঠন করার লক্ষ্যে বর্তমান ‘নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন’ সংশোধন করা হবে।
৮. সাংবিধানিক সব প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন করা হবে। শুনানির মাধ্যমে সংসদীয় কমিটির ভেটিং সাপেক্ষে এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ প্রদান করা হবে।
৯. বিচারব্যবস্থা সংস্কারের জন্য একটি ‘জুডিশিয়াল কমিশন’ গঠন করা হবে। ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন করা হবে। সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা ও মানদণ্ড সংবলিত ‘বিচারপতি নিয়োগ আইন’ প্রণয়ন করা হবে।
১০. ‘প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন’ গঠন করে প্রশাসন পুনর্গঠন করা হবে।
১১. সুপ্রিম কোর্টের একজন সাবেক বিচারপতির নেতৃত্বে সার্বিক সংস্কারের লক্ষ্যে একটি ‘মিডিয়া কমিশন’ গঠন করা হবে।
১২. দুর্নীতি দমন কমিশন ও দুর্নীতি দমন আইন সংস্কারের পাশাপাশি পদ্ধতিগত সংস্কারের মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা হবে। সংবিধান অনুযায়ী ‘ন্যায়পাল’ নিয়োগ করা হবে।
১৩. সর্বস্তরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধ ও মানুষের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং অমানবিক, নিষ্ঠুর, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অবসান ঘটানো হবে।
১৪. অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ, অভিজ্ঞ ব্যাংকার, করপোরেট নেতা, প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি সমন্বয়ে একটি ‘অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন’ গঠন করা হবে।
১৫. ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’-এই মূলনীতির ভিত্তিতে প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী নিজ নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ অধিকার ভোগ করবেন।
১৬. শ্রমজীবী মানুষ এবং চা-বাগান, বস্তি, চরাঞ্চল, হাওর-বাঁওড়, মঙ্গাপীড়িত, উপকূলীয় অঞ্চলের বৈষম্য দূরীকরণ এবং সুষম উন্নয়নে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে।
১৭. বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ খাতে দায়মুক্তি আইনসহ সব কালাকানুন বাতিল করা হবে এবং অপ্রয়োজনীয় কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় বন্ধ করা হবে।
১৮. বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া হবে।
১৯. দেশের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সুসংগঠিত, যুগোপযোগী এবং সর্বোচ্চ দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত করে গড়ে তোলা হবে।
২১. রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নিবিড় জরিপের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের একটি তালিকা প্রণয়ন করা হবে এবং তাদের যথাযথ মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করা হবে।
২২. যুব সমাজের ভিশন ও চিন্তা-চেতনাকে ধারণ করে আধুনিক ও যুগোপযোগী যুব উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে।
২৩. নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। জাতীয় সংসদে মনোনয়নের ক্ষেত্রে নারীদের গুরুত্ব প্রদান এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
২৪. বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান নৈরাজ্য দূর করে নিম্ন ও মধ্যপর্যায়ে চাহিদাভিত্তিক শিক্ষা এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা-ক্যারিকুলামকে প্রাধান্য দেওয়া হবে।
২৫. ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’-এই নীতির ভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করার নিমিত্তে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রবর্তন করা হবে।
২৬. শ্রমিকদের মূল্যসূচক ভিত্তিক ন্যায্যমজুরি নিশ্চিত করা হবে।
২৭. কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা হবে। কৃষি জমির অকৃষি ব্যবহার বন্ধ করা হবে।##
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন