ইংরেজি নতুন বছরের শুরুতেই লালমনিহাটের বুড়িমারী সীমান্তে বিএসএফ গুলি করে হত্যা করেছে মোহাম্মদ বিপুল হোসেন (২০) নামে এক বাংলাদেশি যুবককে। গত শনিবার গভীর রাতে তাকে হত্যা করা হয়। নিহত বিপুল পাটগ্রাম উপজেলার রহমতপুর গ্রামের রশিদুল ইসলামের পুত্র। বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায় এবং সরকারের একাধিক বৈঠক ও আলোচনার পরেও বন্ধ হয়নি সীমান্ত হত্যা। আর সবক্ষেত্রে ভিকটিম বাংলাদেশি নাগরিক। গত শনিবার আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, বিদায়ী বছর ২০২২ সালে সীমান্তে হত্যার শিকার হয়েছেন ২১ জন।
অথচ বাংলাদেশ ছাড়া ভারতের সঙ্গে চীন, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান ও মিয়ানমারের সীমান্ত থাকলেও গত ১৫ বছরে কোনো বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে। সর্বশেষ গত বছর বিজিবি ও বিএসএফ প্রধানের মধ্যে বৈঠকেও সীমান্ত হত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেয় বিএসএফ প্রধান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফেলানীর মতো হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পরেও বিএসএফ দায়মুক্তির সুযোগ পেয়েছে। বিচার এমনভাবে হয়েছে যে, দায়মুক্তি প্রতিষ্ঠিত করেছে। এধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধের জন্য যে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া দরকার, তা নেয়া হচ্ছে না। বাংলাদেশের কিশোরী ফেলানী খাতুনকে সীমান্তে হত্যার ঘটনাটি ছিল বিশ্বজুড়ে আলোচনার বিষয়। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া পার হওয়ার সময় বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষের গুলিতে নিহত হয় কিশোরী ফেলানী। তার লাশ দীর্ঘ সময় ঝুলে থাকে কাঁটাতারের বেড়ায়। এই হত্যাকাণ্ডের ছবি দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হলে বিভিন্ন মহলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় বিএসএফের বিশেষ আদালত ২০১৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর অমিয় ঘোষকে বেকসুর খালাস দেন।
গতকাল সোমবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক অনুষ্ঠানে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সাকিল আহমেদ বলেন, সীমান্ত হত্যা বন্ধে আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। আমরা ডিজি পর্যায়ে যখন আলোচনা করি, তখন বিস্তারিত আলোচনা হয়। সীমান্তে যে মৃত্যুর ঘটনাগুলো ঘটছে সেগুলো অনাকাক্সিক্ষত। আমরা সম্মিলিতভাবে এটা বন্ধ করবো। আমাদের বাহিনীর মধ্যে আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। আমি আশা করি, এই বিষয়ে সামনে আরও ভালো ফলাফল আসবে।
বিজিবির একটি দায়িত্বশীল সূত্র ইনকিলাবকে জানায়, ২০০৮ সালে ভারত সরকার ও বিএসএফ বাংলাদেশের জনগণকে আশ্বস্ত করেছিল যে, সীমান্তে প্রাণঘাতী কোনো অস্ত্র ব্যবহার করা হবে না। পরবর্তী সময়ে ২০১১ সালে বিএসএফ-বিজিবি পাচারকারী ও অবৈধপথে সীমান্ত পার হওয়া নাগরিকদের ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার চুক্তিও করে। ভারত সরকারের উচ্চপর্যায় থেকেও সীমান্ত হত্যাশূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার কথা বলা হয় বারবার। অন্যদিকে বিএসএফ বারবার নিরীহ বাংলাদেশিদের হত্যা করলেও বিজিবির পক্ষ থেকে পতাকা বৈঠক বা প্রতিবাদ লিপি দেয়া ছাড়া আর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায় না।
গত রোববার বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম (বীর প্রতীক) ইনকিলাবকে বলেন, বিএসএফ সীমান্তে যেভাবে বাংলাদেশি নিরস্ত্র নাগরিকদের গুলি করে হত্যা করছে, তা এ দেশের মানুষ সমর্থন করে না। আমাদের দুর্বল পররাষ্ট্রনীতির কারণেই ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী এ ধরনের হত্যাকাণ্ড করছে। তারা (ভারত) আমাদের অবহেলার দৃষ্টিতে দেখে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান ইনকিলাবকে বলেন, সীমান্ত হত্যা বন্ধে বার বার প্রতিশ্রুতি দিয়েও রাখছে না ভারত। দু’দেশের সরকারের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সর্বোচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের পরও ভারত বারবার বাংলাদেশি নাগরিকদের নির্মমভাবে হত্যা করছে। তারা (ভারত) বলেছিল, সীমান্তে মারণাস্ত্র ব্যবহার করবে না। কিন্তু আমরা দেখলাম, সেটি মুখের বুলি হলো। এখনও প্রতিনিয়ত সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক নিহতের ঘটনা ঘটছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের দ্বারস্থ হওয়া উচিত।
গত ২৯ ডিসেম্বর লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার দোলাপাড়া সীমান্তে বিএসএফ গুলি করে দুজন বাংলাদেশিকে হত্যা করে। তারা হলেনÑ সাদিক হোসেন উপজেলার বড়খাতা ইউনিয়নের দোলাপাড়া গ্রামের হাফিজারের ছেলে ও একই ইউনিয়নের ফকিরপাড়া গ্রামের সামাদ আলীর ছেলে মংলু মিয়া।
স্থানীয়রা জানান, ঘটনার দিন ভোরে বড় খাতা দোলাপাড়া সীমান্ত গরু আনতে একটি দল সীমান্তের দিকে যায়। এ সময় বিএসএফ তাদের লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এতেই ২ জন নিহত হন। পরে তাদের সঙ্গে থাকা সঙ্গীরা তাদের দু’জনের লাশ উদ্ধার করে পরিবারের সদস্যদের দেন।
নিহত সাদিকের চাচাতো ভাই হুমায়ুন কবির বলেন, বিএসএফ বাংলাদেশিকে প্রায় সময় হত্যা করে। আমাদের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিবাদ জানানো হয় না এটি দুঃখজনক।
হাতীবান্ধা থানার ওসি শাহ আলম সাংবাদিকদের জানান, ভারত থেকে গরু আনতে সীমান্ত এলাকায় গেলে বিএসএফের একটি দল বাংলাদেশিদের ওপর গুলি চালায়। এতে দুজনের মৃত্যু হয়।
ঘটনার পর বিজিবি ৬১ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মীর হাসান শাহরিয়ার মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, সীমান্তের কাছে দু’টি লাশ পাওয়া গেছে। আমরা বিএসএফকে এ বিষয়ে জানিয়েছি, এ ব্যাপারে তাদের বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়েছে।
এলাকাবাসী ও বিপ্লবের পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ১ জানুয়ারি শনিবার দিবাগত রাতে মাস্টারপাড়া গ্রাম সীমান্তের ৮৪৩ নম্বর মেইন পিলারের কাছ দিয়ে বিপুলসহ কয়েকজন গরু আনার চেষ্টা করেন। তারা ভারতের কোচবিহারের চ্যাংরাবান্ধা গ্রামের এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে গরু নিয়ে ফিরছিলেন। এ সময় ৯৮ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের চ্যাংরাবান্ধা ক্যাম্পের টহলরত সদস্যদের কাছে তারা ধরা পড়েন। পরে বিএসএফের সদস্যরা তাদের ধাওয়া করে ও গুলি ছোড়ে। দলের অন্য সদস্যরা পালিয়ে এলেও গুলিবিদ্ধ হয়ে বিপুল আহত হন। তিনি কাঁটাতারের ওপারে কিছুক্ষণ পড়ে ছিলেন। পরে ভোরের দিকে তার সঙ্গীরা আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করেন। পথে তিনি মারা যান।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন