ব্রাজিলের কট্টর ডানপন্থী সাবেক প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারোর সমর্থকরা দেশটির সুপ্রিম কোর্ট, কংগ্রেস এবং প্রেসিডেন্টের বাসভবনে হামলা চালিয়েছে। রোববার এ হামলার পর বর্তমানে কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ আবার প্রতিষ্ঠিত করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। এ ঘটনায় পুলিশ ৪ শতাধিক আন্দোলনকারীকে গ্রেফতার করেছে।
বিবিসি জানিয়েছে, রাজধানী ব্রাসিলিয়ায় সুপ্রিম কোর্টেও হামলা চালায় কট্টর ডানপন্থী সমর্থকরা। তারা প্রেসিডেনশিয়াল প্যালেসও ঘিরে রাখে। সেসময় তারা ব্রাজিলের গায়ে পতাকা জড়িয়ে ছিল। বিক্ষোভকারীদের হঠাতে কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে পুলিশ। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট বলসোনারো গত অক্টোবরে বামপন্থী প্রার্থী লুইজ ইনাসিও লুলা ডা সিলভার কাছে নির্বাচনে হেরে যান। তবে তার সমর্থকরা তার এই হার মেনে নিতে অসম্মতি জানায় এবং তারা সামরিক উত্থানের আহ্বান জানিয়ে লুলার পদত্যাগ দাবি করে।
লুলা বর্তমানে ব্রাজিলের আরেক প্রদেশ সাও পাওলোতে দাপ্তরিক ভ্রমণে রয়েছেন। তিনি বিক্ষোভকারীদের ‘ধর্মান্ধ ফ্যাসিস্ট’ বলে উল্লেখ করেন এবং তাদের শাস্তি দেবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন। এদিকে ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অ্যালেহান্দ্রে ডি মোরেস ব্রাজিলিয়ার গভর্নর ইবানিস রোচাকে তার পদ থেকে ৯০ দিনের জন্য সরিয়ে নিয়েছেন বলে সিএনএন ব্রাজিল তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারোর হাজার হাজার সমর্থক দেশটির কংগ্রেস, প্লানাল্তো প্যালেস এবং সুপ্রিম কোর্টে হামলা চালানোর পর বিচারপতি অ্যালেহান্দ্রে ডি মোরেসের এই সিদ্ধান্ত এলো।
আদালতের এই সিদ্ধান্ত আসে দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তর এবং সিনেটর র্যানডলফ রদ্রিগেজের অনুরোধের প্রেক্ষিতে। মোরেস বলেন যে, রোববারের ঘটনার সময় ইবানিসের ভূমিকা ছিল ‘বেদনাদায়ক নীরব’। এর আগে রোচা সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভিডিও শেয়ার করেন যেখানে তিনি দাঙ্গা রুখতে না পারার কারণে ক্ষমা চান। তিনি বলেন, ‘আজ শহরে যা ঘটেছে তার জন্য আমি প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা ডা সিলভার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আজ এই শহরে যা হয়েছে তা অগ্রহনযোগ্য।’
বিবিসির ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয় অঞ্চলের এডিটর ভেনেসা বুশলুটার বলেন, লুইজ ইনাসিও লুলা ডা সিলভা যিনি লুলা নামেই বেশি পরিচিত তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার সপ্তাহখানেক পরই ব্রাসিলিয়ায় এই বিক্ষোভ হলো। ব্রাজিল গভীরভাগে বিভক্ত একটি দেশ এবং কংগ্রেসে হামলার ঘটনা একটি নাটকীয় প্রতীক যা দিয়ে বোঝা যায় যে, কিছু ব্রাজিলিয়ান কতটা মরিয়া হয়ে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলোতে হামলা চালাতে পারে। যেগুলো তাদের মতে আর তাদের প্রতিনিধিত্ব করে না।
লুলা এই হামলার ঘটনাকে ‘নজীরবিহীন’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারোর বিরুদ্ধে সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে দাঙ্গাকারীদের উস্কানি দেয়ার অভিযোগ তুলেছেন। বিদ্বেষপূর্ণ এবং তিক্ত প্রচারণার মাধ্যমে গত ৩০শে অক্টোবরের নির্বাচনে তিনি কট্টর ডানপন্থী প্রার্থী বলসোনারোকে খুব কম ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছেন লুলা। নির্বাচনের আগে বলসোনারো বারবারই অভিযোগ করেছেন যে ভোট দেয়ার ইলেক্ট্রনিক ব্যবস্থায় জালিয়াতির সুযোগ রয়েছে- যা দেশটির নির্বাচনী কর্তৃপক্ষ নাকচ করে দিয়েছে।
এদিকে, হামলার ঘটনায় চার শতাধিক বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ব্রাসিলিয়ার গভর্নর ইবানেস রোচা এক ট্যুইটে লেখেন, ইতিমধ্যে হামলার সঙ্গে জড়িত চার শতাধিক জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এমন অপরাধের জন্য তারা শাস্তি পাবে। আমরা এ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণকারী অন্যদের চিহ্নিত করছি। একই সঙ্গে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।
ব্রাজিলে সহিংসতার ঘটনায় বিশ্ব নেতাদের নিন্দা, বলসোনারোকে প্রত্যর্পণের আহ্বান : সাবেক প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারোর সমর্থকরা রোববার ব্রাজিলের কংগ্রেস, প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ এবং সুপ্রিম কোর্টে আক্রমণ করার পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন যে, ব্রাজিলের পরিস্থিতি ‘আক্রোশজনক’। কিছু জ্যেষ্ঠ মার্কিন আইন প্রণেতা ডানপন্থী বলসোনারোকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রত্যর্পণের আহ্বান জানিয়েছেন।
বাইডেনের নিন্দা ব্রাজিলের নিকটতম প্রতিবেশী সহ বিশ্বজুড়ে বিশ্ব নেতাদের দ্বারা প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা, যিনি গত বছর নির্বাচনে বলসোনারোকে পরাজিত করেছিলেন, আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত রাজধানীতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন। ‘আমি গণতন্ত্রের উপর হামলার এবং ব্রাজিলে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধা দেয়ার নিন্দা জানাই। ব্রাজিলের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে এবং ব্রাজিলের জনগণের ইচ্ছাকে ক্ষুণ্ন করা উচিত নয়,’ বাইডেন টুইটারে বলেছেন।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন টুইট করেছেন যে, ‘গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে আক্রমণ করার জন্য সহিংসতা ব্যবহার করা সর্বদা অগ্রহণযোগ্য।’ তিনি ব্রাজিলের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির উপর অবিলম্বে আক্রমণ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা, জেক সুলিভান বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ব্রাজিলে গণতন্ত্রকে ক্ষুণ্ন করার যেকোনো প্রচেষ্টার নিন্দা করেছে। ‘প্রেসিডেন্ট বাইডেন পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে অনুসরণ করছেন এবং ব্রাজিলের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আমাদের সমর্থন অটুট। ব্রাজিলের গণতন্ত্র সহিংসতায় নড়ে যাবে না,’ সুলিভান বলেছিলেন।
লুলা ক্ষমতায় আসার প্রাক্কালে বলসোনারো ব্রাজিল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় চলে যান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সারা বিশ্ব বোলসোনারোর সমর্থকদের ক্রিয়াকলাপে ২০২১ সালের ইউএস ক্যাপিটল আক্রমণের প্রতিধ্বনি দেখেছেন এবং সাবেক প্রেসিডেন্টকে প্রত্যর্পণ করার আহ্বান জানিয়েছেন। ইউএস হাউসের বৈদেশিক বিষয়ক কমিটির সদস্য জোয়াকিন কাস্ত্রো সিএনএনকে বলেছেন যে, বোলসোনারো ‘ট্রাম্প প্লেবুক ব্যবহার করে দেশীয় সন্ত্রাসীদের সরকারকে দখল করার চেষ্টা করতে অনুপ্রাণিত করতে’। ‘এ মুহুর্তে বলসোনারো ফ্লোরিডায় আছেন... তাকে ব্রাজিলের কাছে হস্তান্তর করা উচিত ... মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই স্বৈরাচারীর আশ্রয় হওয়া উচিত নয় যে ব্রাজিলে ঘরোয়া সন্ত্রাসবাদকে অনুপ্রাণিত করেছে’, তিনি বলেছিলেন।
ইউএস হাউস ডেমোক্র্যাট আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্টেজ বলেছেন, ‘যেদিন ইউএস ক্যাপিটল ফ্যাসিস্টদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল তার প্রায় দুই বছর, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে বিদেশে ফ্যাসিবাদী আন্দোলনগুলি ব্রাজিলে একই কাজ করার চেষ্টা করছে।’ তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ‘ফ্লোরিডায় বলসোনারোকে আশ্রয় দেয়া বন্ধ করার’ আহ্বান জানিয়েছেন।
চিলির প্রেসিডেন্ট গ্যাব্রিয়েল বোরিক ব্রাজিলের প্রতিষ্ঠানে হামলাকে ‘গণতন্ত্রের উপর কাপুরুষ ও জঘন্য আক্রমণ’ বলে অভিহিত করেছেন। কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেট্রো বলেছেন, ‘ফ্যাসিবাদ একটি অভ্যুত্থান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ... এটি একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে বেঁচে থাকতে চাইলে ওএএস (অর্গানাইজেশন অফ আমেরিকান স্টেটস) এর সাথে দেখা করা জরুরি।’ আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফার্নান্দেজ টুইট করে বলেছেন যে, তিনি তার দেশের ‘এ অভ্যুত্থানের চেষ্টার মুখে হ্যাশট্যাগ লুলাঅফিশিয়ালের জন্য নিঃশর্ত সমর্থ ‘ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করেছেন।
ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো বলেছেন যে তিনি ‘বলসোনারোর নব্য-ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠীগুলির দ্বারা সৃষ্ট সহিংসতাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন যা ব্রাজিলের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে আক্রমণ করেছে। হ্যাশট্যাগ লুলাঅফিশিয়াল এবং ব্রাজিলের জনগণের জন্য আমাদের সমর্থন যারা অবশ্যই শান্তি ও তাদের প্রেসিডেন্টের সুরক্ষায় একত্রিত হবে।’
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ব্রাজিলকে ‘একটি মহান গণতান্ত্রিক দেশ’ বলে অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন যে, তিনি আত্মবিশ্বাসী ‘ব্রাজিলের জনগণ এবং দেশের প্রতিষ্ঠানের ইচ্ছাকে’ সম্মান করা হবে। ইউরোপীয় কাউন্সিলের সভাপতি চার্লস মিশেল বলেছেন, লুলা ‘গণতান্ত্রিকভাবে লাখ লাখ ব্রাজিলিয়ানদের দ্বারা সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছেন’ এবং ‘ব্রাজিলের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের উপর হামলার’ নিন্দা করেছেন।
ফ্রান্সের ইমানুয়েল ম্যাখোঁ বলেছেন যে, লুলা তার দেশের ‘অটল সমর্থন’ এর উপর নির্ভর করতে পারেন এবং ‘ব্রাজিলের জনগণ এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ইচ্ছাকে অবশ্যই সম্মান করতে হবে’। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজও লুলাকে তার পূর্ণ সমর্থনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যোগ করেছেন, ‘আমরা ব্রাজিলের কংগ্রেসে হামলার নিন্দা জানাই এবং অবিলম্বে গণতান্ত্রিক স্বাভাবিকতায় ফিরে আসার আহ্বান জানাই।’
ইতালির ডানপন্থী প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির কাছ থেকে অনুরূপ একটি কল এসেছিল, যিনি বলেছিলেন যে ব্রাজিলের দৃশ্যগুলি ‘কোনও ধরণের গণতান্ত্রিক ভিন্নমতের সাথে বেমানান’। পর্তুগালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোয়াও গোমেস ক্রাভিনহো বলসোনারোকে এ ঘটনার জন্য দায়ি করেছেন করেছেন এবং বলেছেন ‘বর্তমানে ব্রাসিলিয়ায় যে ব্যাধি ঘটছে তার মুখে তার নিন্দার বার্তা থাকলে এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ হবে’। অস্ট্রেলিয়ান সরকার বলেছে যে, তারা ‘ব্রাজিলের কংগ্রেস, সুপ্রিম কোর্ট এবং প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে হামলার নিন্দা করে’।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এই হামলার জন্য ‘প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারো এবং তার মিত্রদের দ্বারা গণতান্ত্রিক নীতিগুলিকেক্ষুণ্ন করার জন্য এবং নির্বাচনী জালিয়াতির ভিত্তিহীন দাবি ছড়িয়ে দেয়ার জন্য বছরব্যাপী প্রচারণা’কে দায়ি করেছে। সংগঠনটি একটি বিবৃতি প্রকাশ করে এ ঘটনাকে ‘উগ্রবাদীদের দ্বারা ব্রাজিলের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের উপর একটি ঘৃণ্য আক্রমণ যারা সামরিক হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়ে ব্রাজিলিয়ানদের ভোট দেয়ার এবং তাদের পছন্দের নেতাদের নির্বাচন করার অধিকার অস্বীকার করতে চাইছে’। সূত্র : দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি নিউজ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন