স্টালিন সরকার : ‘পথহারা পাখি কেঁদে ফিরি একা/আমার জীবনে শুধু আঁধারে লেখা’ (কাজী নজরুল ইসলাম)। জাতীয় কবির কবিতার পাখির মতোই কী বিএনপি পথ হারিয়েছে? ১৯ দফা কর্মসূচিতে জন্ম নেয়া দলের আদর্শে রাষ্ট্রনীতিতে গণতন্ত্র, সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা-বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ এবং অর্থনৈতিক-সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। ১৯৭৮ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর এই ৪ মূলনীতির ওপর ভর করে যাত্রা শুরু করা দলটি কী চলার পথে হোঁচট খাচ্ছে? সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ হির রাহমানির রাহিম’ সংযোজন করা বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক জিয়াউর রহমানের এই দল আদর্শিক দিক দিয়ে ভোটের রাজনীতিতে বর্তমানে নিজ কক্ষপথে রয়েছে; নাকি ‘দুষ্ট লোকের মিষ্টি কথায়’ তথাকথিত প্রগতিশীলতার ¯্রােতে গা ভাসিয়ে দিয়ে ‘স্বাতন্ত্র্যতা’, ‘ভোট ব্যাংক’ হারাতে বসেছে?
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচনের আগে দেশী- বিদেশী কয়েকটি সংস্থা জরিপ করেছে। জরিপগুলোতে দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৭০ থেকে ৮০ ভাগ ভোটার নির্বাচনে ধানের শীষে ভোট দেয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে। গত দুই বছর দেশের ৩০টি জেলা ঘুরে সে চিত্রই পাওয়া গেছে। মফস্বল শহর ও গ্রামের মানুষ বিএনপির ‘দুরবস্থায়’ নীরবে চোখের পানি ফেলছে। ‘দিন যায় কথা থাকে’র মতো ৫ জানুয়ারি নির্বাচন প্রতিহত এবং ২০১৫ সালের লাগাতার অবরোধ আন্দোলনের স্মৃতি ভুলতে পারছে না মানুষ। গ্রামের মানুষ মনে করে ঢাকার কিছু নেতার ‘লক্ষণ সেনের’ মতো ভীরু-কাপুরুষতায় আন্দোলন সফল হয়নি। বিএনপিকে নিয়ে তাদের প্রত্যাশা একচুলও কমেনি। যে দলের এত জনসমর্থন সেই দলকে সাংগঠনিকভাবে এত বেহাল অবস্থায় পড়তে হলো কেন? বিপুল জনসমর্থক অথচ তৃর্ণমূল থেকে শুরু করে কেব্দ্রের বেখেয়ালি এবং আত্মকেন্দ্রিক রাজনীতি কী দলটিকে জনগণ থেকে ক্রমান্বয়ে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে? আর দলের কর্মকৌশলে প্রগতিশীলতার নামে বিদেশমুখিতা, হঠাৎ ভারতপ্রীতি এবং ইসলামী মূল্যবোধে যাপিত জীবনে অভ্যস্ত নাগরিকদের উপেক্ষা করায় দলের জনসমর্থনের এই হাল! দেশের রাজনীতির শক্তির বিচারে যেহেতু আওয়ামী লীগের একমাত্র প্রতিপক্ষ বিএনপি সেহেতু দেশের আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ, মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক এবং ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী তৌহিদী জনতা ‘ধানের শীষে ভোট না দিয়ে যাবে কোথায়’ এ মানসিকতা কী পেয়ে বসেছে দলটির নীতিনির্ধারকদের?
ক্ষমতায় থাকাবস্থায় জন্ম হলেও বিএনপির শক্তির প্রধান উৎস জনগণ। বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক জিয়াউর রহমান বিএনপিকে গণমুখী দলে পরিণত করেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের সাহসী ভূমিকা বিএনপিকে দেয় নতুন লাইফ টাইম। গড়ে ওঠে ব্যাপক গণভিত্তি। তৃণমূলে ছড়িয়ে পড়ে দলের সাংগঠনিক কাঠামো। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সেই জনগণের ওপর ভর করেই দলকে সরকারে যেতে হয়। কিন্তু বিএনপি কী জনগণের কাছে গেছে? জনগণের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে গত ৯ বছরে কোনো কর্মসূচি দিয়েছে? সাদা চোখে ভোটের হিসাব দেখলে প্রতিপক্ষ ক্ষমতাসীন দলের ‘ভোট ব্যাংক’ হিসেবে চিহ্নিত দেশের সংখ্যালঘু ভোট। পরিস্থিতি যা-ই হোক সংখ্যালঘুরা নৌকায় ভোট দেবেই। তেমনি জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী বিএনপিকে ভোট দেয় নানা ধারায় বিভক্ত আলেম সমাজ, ওলামা-মাশায়েখ, ইসলামী ধারার অরাজনৈতিক সংগঠন, মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্ররা। হিন্দুয়ানি সংস্কৃতির বিপক্ষের ওরাই বিএনপির ভোট ব্যাংক। প্রশ্ন হলো আওয়ামী লীগ নিজের ভোট ব্যাংক দখলে রাখতে যা করছে বিএনপি কী নিজেদের ভোট ব্যাংক ধরে রাখতে তার সিকি ভাগ চেষ্টা করছে? বরং আওয়ামী লীগ নিজেদের ভোট ঠিক রেখে প্রতিপক্ষের আলেম-ওলামাদের ভোটে ভাগ বসাতে নানা কৌশল করছে; সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। সুবিধাবাদী কিছু আলেমকে দিয়ে বিকল্প ইসলামী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করছে। ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’ তথাকথিত এই আদর্শিক কারণে হেফাজতের মতো অরাজনৈতিক সংগঠনের প্রকাশ্যে সমালোচনা করলেও আওয়ামী লীগ পর্দার আড়ালে ওই সংগঠনের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে মাঠের নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করছে। প্রকাশ্যে এবং জনসম্মুখে জামায়াতকে গালিগালাজ করলেও তৃণমূলের অনেক জামায়াত নেতাকে আওয়ামী লীগের ‘নৌকায় উঠানো’ হয়েছে। জামায়াত ইস্যুতে আওয়ামী লীগের কৌশল হলো ‘প্রকাশ্যে গালি পর্দার আড়ালে তালি’ নীতি। উদ্দেশ্য ভোট। অথচ বিএনপি নিজেদের ভোট ধরে রাখার জন্য কিছুই করছে না। শাপলা চত্বরে ঘটনার পর হেফাজতের কতজন নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে বিএনপি? মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের বিরুদ্ধে জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেছে? বিএনপির নীতিনির্ধারকদের ভাবখানা হলো আওয়ামী লীগ সরকারের জুলুম-নির্যাতনের কারণে মৌলভী-মাওলানারা ধানের শীষে ভোট না দিয়ে যাবে কোথায়? শুধু তাই নয়, তথাকথিত প্রগতিশীলতার ¯্রােতে গা ভাসিয়ে বিএনপির একশ্রেণীর নেতা নির্যাতিত, সুবিধাবঞ্চিত আলেমদের ক্ষেপিয়ে তুলছে। আলেম-ওলামাদের বিরুদ্ধে সরকার জুলুম-নির্যাতন করলেও বিএনপি প্রতিবাদের বদলে নীরবতা পালন করছে। এতে আলেমদের অনেকেই ক্রমান্বয়ে বিএনপি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। দিল্লির আগ্রাসী নীতির বিরোধিতা বা প্রতিবাদ অর্থ ভারত বিরোধিতা নয়। এক সময় সীমান্তে হত্যা হলেই গর্জে উঠত বিএনপি। ভারতের সঙ্গে পানি চুক্তি, দেশের ওপর দিয়ে বিপজ্জনক ট্রানজিটের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলত। টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে মিছিল-মিটিং করত। দেশের জাতীয় স্বার্থের ইস্যুতে কোনো ছাড় নয় নীতিতে অটল ছিল। দিল্লির সাউথ ব্লক গোসসা করবে সেই ভয়ে সীমান্তে হত্যা হলে এখন দলের নেতারা নীরবতা পালন করেন। দিল্লির অনুগ্রহ পেতে মোদিকে খুশি করতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামেন। বিজেপির পাতি নেতা ঢাকায় এলে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে লাইনে দাঁড়ান। কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএসের ভাবশিষ্য বিজেপি সভাপতি অমিত শাহর ফোনালাপ সত্য প্রমাণে কোমর বেঁধে মাঠে নামেন। কংগ্রেসকে হারিয়ে দিল্লির মসনদে বিজেপি আসায় মিষ্টি বিতরণ করেন। এ কেমন জাতীয়তাবাদের রাজনীতি? হিন্দুত্ববাদীদের খুশি করার প্রতিযোগিতা কী জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধের রাজনীতির সঙ্গে যায়?
২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত ৫ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি ভোটের রাজনীতিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। জনগণের মাঝে দলটির ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণিত হয়। দেশব্যাপী করা দেশী-বিদেশী জরিপগুলোতে জনসমর্থনের সে চিত্র ফুটে উঠে। ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে এমন কী ঘটনা ঘটল যে হঠাৎ করে বিএনপির মতো দলকে ‘কেবলা’ পরিবর্তন করতে হবে? আর বিতর্কিত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়। লালমনিরহাটের একটি আসনের ৪০টি কেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। তারপরও আন্দোলন ব্যর্থ হয় কী করে? দলটির সুবিধাবাদী কিছু নেতার পালায়নপর মানসিকতার কারণে জনগণের ভোট দিতে না পারার বদলে উল্টো ভোটে অংশ না নেয়ার জন্য বিএনপিকে দায়ী করছে মহলবিশেষ।
নারায়ণগঞ্জের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের কথাই ধরা যাক। সেখানে যাকে প্রার্থী করা হয়েছে দলের কতজন তাকে চেনেন? জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী ভোটারদের সঙ্গে ওই প্রার্থীর কী কোনো দিন সম্পর্ক ছিল? পরাজিত হওয়ার পর যতই ‘ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে বিএনপি দীর্ঘ সংগ্রামের আংশিক জয় হয়েছে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে’ বলে আত্মতুষ্টির চেষ্টা কী বাস্তবতা? তৃণমূলের মনোনয়ন না পাওয়া এবং দলের ভেতরে দুই ধারা স্পষ্ট থাকার পরও ধানের শীষের প্রার্থীর দ্বিগুণ ভোট পেয়ে আইভীর বিজয়ী হওয়া কী বিএনপির জন্য রাজনৈতিক বিপর্যয় নয়? জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসীদের বৃহৎ অংশ নারায়ণগঞ্জে ভোট দিতে না যাওয়ায় স্থানীয় নির্বাচনে ভোটের হার হয়েছে তুলনামূলক কম। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যারা ধানের শীষের বাইরে ভোট দিতে অভ্যস্ত নন তাদের বড় একটা অংশ প্রার্থী পছন্দ না হওয়ায় ভোট দিতে যাননি। তাদের ভাষায় ধানের শীষের প্রার্থী তথাকথিত প্রগতিশীলদের লোক। আবার আরেকটি অংশ ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আইভী যেহেতু ‘আইডল’ সে কারণে ধানের শীষ মার্কার প্রগতিশীল প্রার্থীর বদলে নৌকা মার্কার প্রগতিশীল প্রার্থীকে ভোট দেয়। প্রশ্ন হলো নারায়ণগঞ্জে দলের নেতৃত্ব দেয়া অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার, সাবেক এমপি আবুল কালাম, সাবেক এমপি গিয়াসউদ্দিন, জেলার সাধারণ সম্পাদক কাজী মনিরুজ্জামান মনির, যুগ্ম সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন খান, নগর বিএনপির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম, সাধারণ সম্পাদক এ টি এম কামালরা কী প্রার্থী দেয়ার আগে স্থানীয় ভোটারদের নার্ভ বোঝার চেষ্টা করেননি? একটি দলের যতই জনপ্রিয়তা থাকুক না কেন দলের স্থানীয় নেতাকর্মী ও দলের ভোট ব্যাংক হিসেবে পরিচিত আমজনতার মনন বুঝে প্রার্থী দেয়া না হলে সফলতা পাওয়া কঠিন। প্রশ্ন হলো এ অবস্থায় কী করতে পারে বিএনপি? ভোট ধরে রাখার কৌশলে ফিরে যাওয়া নাকি তথাকথিত প্রগতিশীলতার পথে গিয়ে নিজ কক্ষপথের বাইরে চলে যাওয়া? বিএনপিকে ‘মডারেট’ করে সাফল্যের লোভ দেখিয়ে দেশের বুদ্ধিজীবী, সুশীলসমাজ ও সুবিধাবাদী ব্যাক্তিত্ব ও দলের ভেতরের তথাকথিত প্রগতিশীলরা যতই আলেম-ওলামা-মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্র তথা ইসলামপ্রিয় তৌহিদী জনতা থেকে দলটিকে সরে আসার পরামর্শ দিক না কেন; বাস্তবতা ভিন্ন। রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণেই বিএনপি মডারেট হয়ে ভোটের রাজনীতিতে সুবিধা করতে পারবে না। দিল্লি তোয়াজনীতি দলটিকে ভোটের সুবিধা দিতে পারবে এমন প্রত্যাশাও দুরাশা। ভোটে জিতে ক্ষমতায় যেতে চাইলে বিএনপিকে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধের মূলে ফিরতে হবে। ভোট ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিতদের কাছে যেতে হবে। বুঝতে হবে বিএনপির প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ যতই গণবিচ্ছিন্ন হোক তাতে দিল্লির ছায়া দেয়া ব্যাহত হবে না। দর্শনগত কারণেই আওয়ামী লীগকে ফেলে দিয়ে বিএনপিকে কোলে তুলে নেবে না। আর দলটি এখন রাষ্ট্রক্ষমতায়। আওয়ামী লীগের পক্ষে রাষ্ট্রের সকল শক্তি; বিএনপির পক্ষে শুধু নীরব জনমত। নীরব জনমতকে সরব করতে হলে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধের ভোটারদের মনন-মানসিকতার প্রতি ঝুঁকতে হবেই। নিজেদের ভোট ব্যাংক রক্ষা করার কৌশলে ব্যর্থ হলে যতই নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হোক বিএনপিকে নারায়ণগঞ্জের ভাগ্য বরণ করতে হবে। এতে হয়তো ভোটের রাজনীতিতে ফিরে আসার আত্মতুষ্টি করা যাবে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন থেকে যাবে স্বপ্নই। এতএব দলটিকে আপন পথ খুঁজে নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন