শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আন্তর্জাতিক সংবাদ

বাংলাদেশের বিরোধী দল এখন দমন-পীড়নের শিকার, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অকল্পনীয়

অনলাইন ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২৩ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:৩৬ পিএম

২০২০ সালের মে মাসের একটি বিকেল বেলা। বাংলাদেশের ঢাকায় তার নিজের অ্যাপার্টমেন্টে অলসভাবে ঘুমিয়ে ছিলেন আহমেদ কবির কিশোর। সেই সময়ে তার দরজা ভেঙ্গে ২০ জন পুরুষ ভেতরে ঢোকে । মুখে বন্দুক ঠেকিয়ে তাকে টেনে বাইরে বের করে এনে একটি ভ্যানে উঠিয়ে নিয়ে চলে যায়। যাবার সময় উৎসুক জনতার দিকে তারা বলতে বলতে যায় “দূরে সরে যাও, আমরা একজন সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করেছি''।

কিশোর সন্ত্রাসী ছিলেন না। তিনি একজন কার্টুনিস্ট ছিলেন যার রাজনৈতিক আঁকা, বাংলাদেশের বিশিষ্ট সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হতো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং কোভিড মহামারীর ভুল ব্যবস্থাপনার মতো একাধিক বিষয়কে তিনি তার সমালোচনামূলক আঁকার বিষয়বস্তু করে তোলেন। সেই অপরাধে তিনদিন ধরে তাকে চোখ বেঁধে এবং একটি ছোট ঘরে হাতকড়া পরিয়ে রাখা হয়েছিল। এরপর শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতন। কিশোর বলেন, “ওরা আমার সারা শরীরে লাঠি দিয়ে পিটিয়েছে।

আমাকে শুইয়ে দিয়ে আমার পায়ে লাঠি দিয়ে মেরেছে "। সাদা পোশাকের অফিসাররা বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের সাথে তার সংযোগ সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিল, শুধু তাই নয় তাকে এত জোরে আঘাত করেছিল যে, কিশোরের কানের পর্দা ফেটে যায়। পায়ে আঘাতের জেরে তাঁর চলাফেরার ক্ষমতাও প্রায় চলে যায়।

চোখ খোলার পর কিশোর বুঝতে পেরেছিলেন তিনি র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ফোর্স অর্থাৎ বাংলাদেশ পুলিশের অভিজাত অ্যান্টি-টেররিজম ইউনিটের হাতে এসে পড়েছেন। আন্তর্জাতিকভাবে বিচারবহির্ভূত অপহরণ এবং হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার জন্য র‌্যাব এখন একটি "ডেথ স্কোয়াড" হিসাবে কুখ্যাত হয়ে উঠেছে এবং তাকে সেই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

২০২০ সালের ৫মে কিশোর, তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু ততদিনে তার ক্ষতস্থানে সেপটিক হতে শুরু করেছে। সাংবাদিক ও কর্মীসহ আরও ১১ জনের পাশাপাশি তাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে অভিযুক্ত করা হয়েছিল, স্পষ্টতই কোভিড সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়ানোর জন্য।

মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলি দাবি করেছে যে, আইনটি সরকারের সমালোচকদের নীরব করার এবং ভিন্নমতকে দাবিয়ে রাখার একটি নির্লজ্জ প্রচেষ্টা। প্রায় এক বছর ধরে কারাগারে থাকার কারণে আহত কিশোর ক্রমেই দুর্বল হতে থাকেন। কিন্তু তার একজনসহ বন্দী, সাংবাদিক মুস্তাক আহমেদ কারাগারে মারা যাওয়ার পরে - বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ এবং তার আঘাতের কারণে কিশোরকে ২০২১ সালের মার্চ মাসে জামিন দেয়া হয়েছিল। তাকে আবার আটক করার চেষ্টা করা হলে কিশোর প্রথমে নেপাল এবং পরে সুইডেনে পালিয়ে যান। তখন থেকে সেখানেই তিনি নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন ।

তিনি বলেছিলেন-'আমার আঘাতের কারণে আমি এখনও ঠিকভাবে হাঁটতে পারি না এবং ডান কানের শ্রবণশক্তিও হারিয়ে ফেলেছি।'

২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকে কিশোর, আহমেদ এবং অগণিত সমাজকর্মী, লেখক, শিল্পী, বিরোধী রাজনীতিবিদ এবং আইনজীবীরা বাংলাদেশের বড় শহরগুলিতে সরকারবিরোধী প্রতিবাদ আন্দোলনের ভিত্তি তৈরি করেছে। কোভিড মহামারী, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক দুর্দশা, জ্বালানি ও খাদ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নির্বাচনে কারচুপির কারণে সৃষ্ট হতাশার জেরে বিরোধীদল বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি বা বিএনপি কর্তৃক আয়োজিত বিক্ষোভে সাড়া দিয়ে কয়েক হাজার মানুষ রাস্তায় নেমেছেন।

হাসিনা এবং তার আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচকরা আশঙ্কা করছেন যে, বছরের শেষের দিকে হওয়া নির্বাচন অবাধ বা সুষ্ঠু নাও হতে পারে। এর আগে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনগুলি বিরোধীদের বয়কট এবং কারচুপির জেরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বিরোধীরা হাসিনা সরকারের পদত্যাগ দাবি করছেন।

বিএনপি বলছে, হাসিনার অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। প্রতিক্রিয়ায় শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা বেশ কঠোর মনোভাব দেখিয়েছেন ।

আওয়ামী লীগ বিশাল সমাবেশ করার ছাড়পত্র পেলেও বিএনপির সমাবেশের অনুমতি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে এবং জনগণের উপস্থিতি বন্ধ করতে পরিবহন ধর্মঘট জারি করা হয়েছে। বিরোধীদের বিরুদ্ধে সহিংস অভিযান চালানোর অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে।শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে অফিসাররা গুলি চালিয়েছে, গত পাঁচ মাসে আট বিএনপি কর্মীকে হত্যা করেছে এবং ২০০ জনেরও বেশি বিক্ষোভকারী আহত হয়েছেন।

বিএনপি সমর্থকদের বিরুদ্ধে অন্তত ২০ হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছে, গত মাসে এক হাজারেরও বেশি নেতাসহ বিএনপির ৭ হাজারেরও বেশি সদস্য ও কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। '' অতীতে তারা রাতের বেলায় বন্দুক নিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালাত; এখন তারা দিবালোকে হত্যা করছে। এই সরকারের অধীনে কেউ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আশা করতে পারে না। '' বলেছেন বিএনপি নেতা একেএম ওয়াহিদুজ্জামান।

মসনদে থাকাকালীন হাসিনার ১৩ বছরের সময়কালে বাংলাদেশ পশ্চিমি দেশগুলিতে পোশাকের প্রধান সরবরাহকারী হয়ে এশিয়ার অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি হিসাবে উন্নতি করেছে। তবে এই সময়কালে রাষ্ট্রের হাতে, বিশেষ করে র‌্যাবের হাতে কর্তৃত্ববাদ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও দেখা গেছে।

গত বছর, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং জোরপূর্বক গুমের অভিযোগে ছয় র‌্যাব কমান্ডারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে আমেরিকা । ২০১১ সালের ডিসেম্বরে র‌্যাবের হাতে নিখোঁজদের মধ্যে একজন ছিলেন সাবেক সেনাকর্তা মেজর জাকির হোসেন (৩৭) । ৫০ জনেরও বেশি কর্মকর্তা তাকে তার বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, নির্যাতন করা হয় এবং হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়।

নিজের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে জাকির বলেছিলেন- ''আটকের সময় আমার সাথে যে অমানবিক আচরণ করা হয়েছে তা শুধুমাত্র গুয়ানতানামো বে- এর বন্দীদের ভয়ঙ্কর গল্পের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। '' তাকে প্রায় তিন বছর নির্জন কারাবাসে রাখা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, কথিত অপরাধের জন্য তাকে কখনও আদালতে হাজির করা হয়নি । ২০২১ সালে, তিনি যুক্তরাজ্যে পালিয়ে গিয়ে বলেন -"আমি ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞ যে আমি এখনও বেঁচে আছি। "

এক বছর আগে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও, মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলি বলছে যে র‌্যাব এখনও এই ধরনের অপব্যবহারের সাথে জড়িত এবং বাংলাদেশে অন্তত ১৬ জনকে বলপূর্বক গুম করা হয়েছে।

ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি ভয়াবহ। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং বলপূর্বক গুমের সংখ্যা এর স্পষ্ট প্রমাণ।" হাসিনা সরকারের ওপর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অন্যান্যদের আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দমন-পীড়নের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। সরকারপক্ষ সমর্থন করে তিনি বলেন -'' আমাদের সরকার সবসময় সুষ্ঠু নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে। আসন্ন নির্বাচন একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে , যা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। '' যদিও হংকংয়ের এশিয়ান লিগ্যাল রিসোর্স সেন্টারের কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান মনে করেন বর্তমান পরিস্থিতিতে “একটি সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অকল্পনীয়”।

তার মতে, বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দলকে জবাবদিহি করার মতো কোনো স্বাধীন প্রতিষ্ঠান নেই। আশরাফুজ্জামান বলেছেন -''বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, গোয়েন্দা সংস্থা এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সবাই ক্ষমতাসীন দলের হয়ে নির্বাচনে কারচুপি করতে এবং শাসকের অপরাধ আড়াল করার জন্য একে অপরের সাথে সংঘবদ্ধ হয়ে কাজ করছে ''। সূত্র : দ্য গার্ডিয়ান

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
hassan ২৩ জানুয়ারি, ২০২৩, ৪:৪৯ পিএম says : 0
স্বাধীনতার পরে বুঝতে পেরেছিলাম যে আমরা কেন দেশ স্বাধীন করলাম হাজার 1972 থেকে 1975 পর্যন্ত যে জঘন্যতম অত্যাচার করা হয়েছে বাঙ্গালী হয়ে বাঙ্গালী দের উপর আর সেই দল এখন 13 বছর ধরে আমাদের পারে জঘন্যতম অত্যাচার করছে যেটা কিনা পাকিস্তানিরা কখনোই করে নাই শুধু19 71 সালে করেছিল আল্লাহ এরা তোমাকে ভুলে গেছে এদেরকে তুমি তোমার আইন দিয়ে এই দুনিয়াতেও সাজা দাও এবং মরে গেলে ওদেরকে জাহান্নামে ভরে দাও আমিন
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন