প্রতারণার মাধ্যমে ৫৪ লাখ টাকা হাতিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান হাসিব শেখ (২৪)। গ্রামের বাড়ি, আত্মীয়স্বজনের বাড়ি কোথাও তাকে পাওয়া যাচ্ছিল না। ধরা পড়ার ভয়ে আগের সব মোবাইল নাম্বারও বদলে ফেলেন। ডিলেট করে দেন ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সব ধরনের আইডি। নিজের বাড়ি ছেড়ে মা-বাবাকে নিয়ে উঠেন ভাড়া বাসায়। ভারতীয় টিভি সিরিয়াল ক্রাইম পেট্রোল থেকে টাকা মেরে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার এ অভিজ্ঞতা রপ্ত করেন তিনি।
তার অবস্থান নিশ্চিত এবং তাকে ধরতে সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়। একপর্যায়ে জানা যায়, হাসিবের মোটরসাইকেল চালানোর বড় শখ। মামলার তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই এ সূত্র ধরেই তাকে ধরতে অভিযানে নামে। শুরু হয় সারাদেশে ট্রাফিক আইনে মামলার তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ। হঠাৎ করে রাজশাহী মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের একটি মামলায় চোখ আটকে যায় পিবিআইয়ের।
হাসিব শেখ মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করেন। তার বিরুদ্ধে মামলা করে ট্রাফিক পুলিশ। ওই মামলায় দেয়া মোবাইল ফোন নাম্বারের সূত্র ধরেই তাকে ধরে আনা হয়। হাসিব স্বীকার করেন প্রতারণার কথা। তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ৩৭ লাখ টাকা। তাকে সহযোগিতার অভিযোগে তার বাবা হেদায়েত শেখ এবং মা নুরজাহান বেগমকেও পাকড়াও করা হয়।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) চট্টগ্রাম মেট্রোর বিশেষ পুলিশ সুপার নাঈমা সুলতানা জানিয়েছেন, ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকোর চট্টগ্রামের পরিবেশক এমএস জাওয়াদ এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় প্রতিনিধিদের সুপারভাইজার ছিলেন হাসিব। বিশেষ অফারে সিগারেট বিক্রি করার কথা বলে এক দোকানদারের কাছ থেকে নগদে ও ব্যাংকের মাধ্যমে ৫৩ লাখ ৮৮ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে গত বছরের অক্টোবর মাসে চট্টগ্রাম থেকে পালিয়ে রাজশাহী চলে যান তিনি।
এ ঘটনায় নগরীর ইপিজেড থানায় হওয়া মামলার তদন্তভার পেয়ে পিবিআই কাজ শুরু করে। মোটর সাইকেলের জন্য ট্রাফিক আইনের মামলার সূত্রধরে রোববার রাজশাহী মহানগরীর চন্দ্রিমা এলাকা থেকে হাসিবকে তার বাবা-মাসহ গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তার কাছ থেকে আত্মসাৎ করা ৩৭ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়।
পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো প্রধান নাঈমা সুলতানা জানান, হাসিব শেখ চট্টগ্রামের একটি কলেজের ভ‚গোল বিভাগের স্মাতক সম্মান শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। পাশাপাশ বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করেন। তার এক সহকর্মী একবার টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর ধরা না পরায় সেও আত্মসাতের বিষয়ে উৎসাহী হয়ে ওঠে। পাশাপাশি ক্রাইম পেট্রোল দেখে আত্মসাৎ ও আত্মগোপনে থাকাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ধারণা সংগ্রহ করে বলে জানিয়েছে।
পিবিআই কর্মকর্তারা জানান, হাসিব যে দোকানদারের টাকা আত্মসাৎ করেছিল তাকে একসাথে সব টাকা পরিশোধের জন্য বলেছিলেন। যার কারণে ওই দোকানি তাকে নগদে এবং দুইটি ব্যাংকের চেকের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করেন। ব্যাংক থেকে চেকের টাকা হাসিব নিজে না করে তার অধীনে থাকা অপর দুই বিক্রয় প্রতিনিধির মাধ্যমে উত্তোলন করে।
গত বছরের ১০ অক্টোবর টাকাগুলো একসাথে সংগ্রহ করেই হাসিব তার বাবা-মাকে নিয়ে রাজশাহী চলে যান। যাওয়ার আগে চট্টগ্রামের বাসায় সকল মালামাল রেখে যান। তবে বস্তা ভরে নিয়ে যান টাকা। হাসিব ধরা পড়ার ভয়ে তার বাড়ি পিরোজপুরে যাননি। এমনকি চট্টগ্রামে থাকা তার দুই বোনের সাথেও কোন ধরনের যোগাযোগ রাখেননি। এমনকি তার পরামর্শে তার বাবা-মাও তার বোনদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। রাজশাহীতে গিয়ে তিন মাসে তিন বার বাসা বদল করেন হাসিব।
সিগারেটের বিক্রয় প্রতিনিধির কাজ করার আগে হাসিব একটি মোবাইল কোম্পানিতেও চাকরি করেছিলেন। যার কারণে মোবাইল ট্রেকিংসহ বিভিন্ন বিষয়ে তার ধারণা ছিল। টাকা আত্মসাতের পর তার মোবাইল বন্ধ করে ফেলেন এবং আত্মীয়-স্বজনদের সাথেও যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। এজন্য তার অবস্থান শনাক্ত করাটা দুরূহ হয়ে পড়েছিল। গত ২৮ ডিসেম্বর মামলাটি পিবিআই অধিগ্রহণ করে এবং অনুসন্ধান চালিয়ে হাসিবের অবস্থান শনাক্ত করে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পরিদর্শক ইখতিয়ার উদ্দিন জানান, হাসিব টাকা আত্মসাতের পর তার মোবাইল ফোন বন্ধ করে সেট পাল্টে ফেলেন এবং ফেসবুকে যোগাযোগের সব মাধ্যম বন্ধ করে দেন। আমরা জেনেছিলাম মোটর সাইকেল চালানো তার শখ। সে ধারণা থেকে আমাদের মনে হয়েছিল আত্মসাৎ করা টাকায় হাসিব মোটর সাইকেল কিনতে পারে। সেজন্য আমরা বিভিন্ন জেলা ও মহানগরে ট্রাফিক আইনে মামলার বিষয়টি নজরে রাখছিলাম।
গত ২০ জানুয়ারি অনলাইনে দেখতে পাই রাজশাহী মহানগরীতে হাসিব নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ট্রাফিক আইনে একটি মামলা হয়েছে। সেটা ধরে আমরা রাজশাহী গিয়ে ‘কেইস সিøপে’ একটি মোবাইল নম্বর পাই। সেই মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে হাসিবের সন্ধান পাওয়া যায়। আত্মসাৎ করা টাকায় হাসিব রাজশাহীতে তার ঘরের জন্য কিছু ফার্নিচার, নিজের জন্য একটি মোটর সাইকেল এবং ভাড়ায় চালানোর জন্য দুইটি টমটম কিনেছিলেন।
দোকান মালিক মাসুদ রানা জানান, সিগারেট কোম্পানিগুলো বিভিন্ন সময়ে কিছু বিশেষ অফার দেয়। ওই অফারে কম দামে তারা সিগারেট বিক্রি করে। দীর্ঘদিন ধরে হাসিব দোকানে সিগারেট দেয়ায় তার সাথে সু-সম্পর্ক গড়ে উঠে। গত বছরের এপ্রিল মাসেও তিনি ‘বিশেষ অফারে’ ৩৬ লাখ টাকার সিগারেট কিনেছিল জানিয়ে মাসুদ রানা বলেন, ওই কারণে গত ৯ অক্টোবর হাসিব দোকানে আসায় তাকে বিশেষ অফার থাকলে তাকে জানাতে বলি। ওই দিন রাতেই সে (হাসিব) ফোন করে বিশেষ অফারের কথা জানায়। এ জন্য কিছু টাকা নগদে পরিশোধ করার কথা বলে।
মাসুদ রানা জানান, হাসিবের কথা শুনে তিনি মোট ৫৩ লাখ ৮৮ হাজার টাকার ‘ডারবি, বেনসন, গোল্ডলিফ এবং গোল্ডলিফ সুইসের সিগারেটের অর্ডার করেছিলেন। পরদিন সকালে আরও দুই বিক্রয় প্রতিনিধিসহ হাসিব দোকানে এসে নগদ ২০ লাখ এবং পূবালী ব্যাংকের ১০ লাখ এবং ব্রাক ব্যাংকের ২৩ লাখ ৮৮ হাজার টাকার দুইটি চেক নিয়ে যায়। টাকা নেয়ার পরে হাসিবের কোন সন্ধান না পেয়ে পরিবেশক প্রতিষ্ঠানের সাখে যোগাযোগ করেন মাসুদ রানা সেখানে কোন টাকা পরিশোধ না করার গত ১৭ অক্টোবর হাসিবের বিরুদ্ধে ইপিজেড থানায় মামলা করেন মাসুদ রানা।
এদিকে গতকাল মহানগর হাকিম মেহনাজ রহমানের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন হাসিব শেখ। তিনি জানান, টাকা আত্মসাতের পর মা-বাবাকে মিথ্যা বলে চট্টগ্রাম থেকে রাজশাহী নিয়ে যান। তাদের বলা হয়, রাজশাহীতে তার নতুন চাকরি হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন