তিন মাস ধরে আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় দলের কার্যক্রমে অংশ নেওয়া কিংবা বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত আছেন জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জিএম কাদের । তিনি আদালত তার পূর্বের আদেশ বলবৎ রেখেছেন।
মামলার বাদীর ভাষ্য- আপস নিষ্পত্তি না হলে এভাবেই মামলা চলবে। আর জিএম কাদের আইনগত প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যাবেন। এমন অবস্থায় নির্বাচন সামনে রেখে জিএম কাদেরের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তার ধুম্রজাল। ঘটনার শুরু গত ১৪ সেপ্টেম্বর। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে মসিউর রহমান রাঙ্গাকে জাপার গঠনতন্ত্রের ক্ষমতাবলে জিএম কাদের প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ সব পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি দেন। এরপর তিনি দলের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে বিষোদগার করলে গত ৮ অক্টোবর দলের প্রাথমিক সদস্যপদ থেকেও অব্যাহতি পান মসিউর রহমান রাঙ্গা।
এরপর চেয়ারম্যানের বৈধতা ও তার বহিষ্কারাদেশের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আদালতে মামলা করেন রাঙ্গা, যা বিচারাধীন। রাঙ্গাকে অব্যাহতি দেওয়ার তিন দিন পর ১৭ সেপ্টেম্বর দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় জাপার আরেক নেতা সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউল হককে মৃধাকে। এ আদেশের বিরুদ্ধে তিনি ৪ অক্টোবর ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতে মামলা করেন। মামলায় জিএম কাদেরকে জাপার চেয়ারম্যান হিসেবে অবৈধ ঘোষণার আবেদন করেন তিনি। ৩০ অক্টোবর আদালত জাপার চেয়ারম্যান হিসেবে জিএম কাদেরকে দলীয় কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখতে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ দেন। সেটি এখনও বহাল আছে।
সবশেষ গেল ১৯ জানুয়ারি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এএইচএম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া শুনানি শেষে জিএম কাদেরের ওপর নিষেধাজ্ঞা বহালের আদেশ দেন। জিয়াউল হক মৃধার দাবি, ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই জাপার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর ছয় মাস আগে ১ জানুয়ারি জিএম কাদের তার বড় ভাই এরশাদকে ভুল বুঝিয়ে ‘জাতীয় পার্টির জন্য ভবিষ্যৎ নির্দেশনা’ শিরোনামে একটি চিঠিতে স্বাক্ষর করান। এরপর জিএম কাদের প্রথমে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, পরে চেয়ারম্যান হন; যা ছিল গঠনতন্ত্রের পরিপন্থি। এ নিয়ে দলের ভেতরে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে এরশাদ ২০১৯ সালের ২২ মার্চ জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যানের পদ থেকে অব্যাহতি দেন। ৪ মে পুনরায় তাকে জাপার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করেন। তখন এরশাদ গুরুতর অসুস্থ থাকায় তিনি স্বাভাবিক বিবেচনা প্রয়োগে সক্ষম ছিলেন না। এরশাদের মৃত্যুর পর ২০১৯ সালের ১৮ জুলাই সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন জিএম কাদের। দলের গঠনতন্ত্রে এভাবে চেয়ারম্যান ঘোষণার কোনো বিধান নেই। এ অভিযোগে জিএম কাদেরসহ চারজনের বিরুদ্ধে জিয়াউল হক মৃধা ও মসিউর রহমান রাঙ্গা পৃথক দুটি মামলা করেন।
দলীয় কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বিরোধীদলীয় উপনেতা হিসেবে সংসদীয় কার্যক্রম পালন করছেন জিএম কাদের। সম্প্রতি বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের সভাপতিত্বে জাপার সংসদীয় দলের সভায় অংশ নেন উপনেতা জিএম কাদের। এরপর জাপার এই শীর্ষ দুই নেতা ঐক্যের কথা জানান। এর আগে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নিজেদের মধ্যে ঐক্য অটুট আছে বলে দাবি করেন দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ ও চেয়ারম্যান জিএম কাদের। যদিও এই বিবৃতি নিয়ে তৈরি হয় ধূম্রজাল। রওশনপন্থি নেতারা এই বিবৃতির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
জাপায় রওশন ও কাদেরকে ঘিরে যে বিভেদ, তাতে আলোচনার অগ্রভাগে জিয়াউল হক মৃধা। তিনি রওশন এরশাদের ডাকা জাপার কেন্দ্রীয় সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। এর জেরে জিয়াউল হক মৃধাকে বহিষ্কার করা হয়। এরপরই চরম তিক্ততার সৃষ্টি হয় রওশন ও কাদেরপন্থিদের মধ্যে। জাপার সূত্র বলছে, রওশন ও কাদেরের মধ্যে প্রকাশ্যে ঐক্য দেখা গেলেও অন্য নেতাদের মধ্যে অনৈক্য প্রকটভাবে জিইয়ে আছে। রওশনপন্থি ও কাদের অনুসারী নেতারা কেউ কাউকে দেখতে পারছেন না। দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাবেশে একমঞ্চে রওশন এরশাদ ও জিএম কাদেরকে দেখা গেলেও নেতারা তা ভালোভাবে নিতে পারেননি। প্রধান অতিথির বক্তব্যে সেদিন বিরোধীদলীয় নেতা স্পষ্ট ঘোষণা দেন দলে কোনো বিরোধ না থাকার। কিন্তু নেতাদের বিভেদ ঘোচানোর উদ্যোগও নেননি রওশন এরশাদ। যৌথ ঐক্যের ঘোষণার পরও দলীয় কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হচ্ছেন জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের। এর ফলে দলীয় কার্যক্রম কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। জেলা-উপজেলা সম্মেলন থেকে শুরু করে জাতীয় সম্মেলনের গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্ত থমকে আছে। পার্টির পক্ষ থেকে রাজনৈতিক কর্মসূচিও নেই। নেই নেতাকর্মীদের প্রতি কোনো নির্দেশনা। রওশনপন্থিরা দল পরিচালনার নাটাই নিজেদের হাতে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
এ প্রসঙ্গে রওশন এরশাদের মুখপাত্র কাজী মামুনুর রশীদ বলেন, মামলা আরও আসতে পারে। চুন্নু সাহেবের বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। তাদের আদালতে ঘুরতে ঘুরতেই জাতীয় নির্বাচনের সময় শেষ হয়ে যাবে। নিয়ম অনুয়ায়ী দলের সব ক্ষমতা প্রধান পৃষ্ঠপোষকের হাতে আসতে হবে। অপেক্ষা করেন। সময় সব বলে দেবে। এ বিষয়ে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য এটিইউ তাজ রহমান বলেন, আদালতের মাধ্যমে রাজনীতিকে ঘরবন্দি করা হচ্ছে। এখানে তৃতীয় শক্তিও কাজ করছে বলে মনে হয়। এটি রাজনীতির জন্য শুভ লক্ষণ নয়। চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞার বিষেয়ে জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, আমরা এখন হাইকোর্টে যাব। আশা করেছিলাম, এমনিতেই আদালত মামলাটি খারিজ করে দেবেন। কিন্তু হয়নি। এখন জানি না কী হবে। ঐক্যের পরও এমনটা কেন হচ্ছে, আল্লাহ সব ভালো জানেন। আদালতের বাইরে তো কিছু করা যাবে না। দলের ভেতরে কে কি করছে তা সাংবাদিকরা খোঁজখবর নিতে পারেন।
জিএম কাদেরের আইনজীবী শেখ সিরাজুল ইসলাম বলেন, নকল পাওয়ার পর আমরা হাইকোর্টে যাব। আদালতকে বলেছি এ নিষেধাজ্ঞার ফলে দলের কার্যক্রম স্থবির হয়ে যাচ্ছে। দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর মৃধার মামলা করার অধিকার নেই। তিনি কোর্টকে ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তবে মামলার বাদী জিয়াউল হক মৃধা বলেন, আমি মামলার বাদী। আমার সঙ্গে জিএম কাদেরের পক্ষ থেকে আলাপ করতে হবে। আপস নিষ্পত্তি না হলে মামলা চলবে। একবার রায় ওনার পক্ষে যাবে হয়তো, আবার বিপক্ষে যাবে। এভাবে চলতেই থাকবে। আমি আইনি লড়াই চালিয়ে যাব। ভয়ে সরে যাব না। কেন আমাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তবে আমি শান্তি চাই। সমাধান হতে হবে ভিন্ন পন্থায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন