বিএনপির ছেড়ে দেওয়া জাতীয় সংসদের শূন্য ৬ আসনের উপনির্বাচন আজ। শূন্য এ আসনগুলো হচ্ছে ঠাকুরগাঁও-৩, বগুড়া-৪ ও ৬, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ ও ৩ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় এসব আসনের উপনির্বাচন অনেকটাই গুরুত্বহীন বলে সাধারণ ভোটারা মনে করেন। ভোটারদের ধারণা যে এ নির্বাচনে এমনিতেই সরকার দলের প্রার্থী জয়ী হবে। তবে ভোটারদের এ ধারণার বাইরে আওয়ামী লীগের কাছে এ নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ তারা ভাবছে বিএনপির কর্মী সমর্থকরা যদি ভোট কেন্দ্রে যায় এবং ভোট প্রদান করে তাহলে তাদের প্রার্থী পরাজিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই ভয়ে এই গুরুত্বহীন নির্বাচনেও সরকারি দল জয়ী হতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। আর তাতে এসব নির্বাচনী এলাকা উত্তপ্ত হয়ে পড়েছে। কোথাও প্রতিদ্ব›িদ্ব প্রার্থী নিখোঁজ হয়ে পড়েছে, আবার কোথাও বিএনপির কর্মী সমর্থকদের ভোট কেন্দ্র না যাওয়ার জন্য হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এতে আওয়ামী লীগের দলীয় ও তাদের সমর্থিত প্রার্থী ছাড়া অন্যদের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক কাজ করছে। সাধারণ ভোটারাও বেশ শঙ্কিত।
৬টি আসনের উপনির্বাচনের মধ্যে এরই মধ্যে ব্রাহ্মনবাড়িয়া-২ আসন ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে। এ আসনের উপনির্বাচনে বিএনপির দলছুট নেতা উকিল আবদুস সাত্তার ভ‚ঁইয়াকে আওয়ামী লীগ সমর্থন দিয়েছে। তাকে সমর্থন করে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। তাকে জেতাতে মরিয়া আওয়ামী লীগ। নিজ দলের প্রার্থীদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করিয়েই তারা ক্ষান্ত হয়নি। উকিল সাত্তারের নির্বাচনী এজেন্টও হচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। সাত্তারের একতরফা জয় নিশ্চিতে নির্বাচনে থাকা অন্য তিন প্রার্থীকে একরকম নির্বাচন থেকে ‘সরিয়ে দেওয়া’ হয়েছে। সাত্তার ভ‚ঁইয়ার প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী আবু আসিফ আহমেদ গত শুক্রবার থেকে নিখোঁজ রয়েছেন। গতকাল মঙ্গবার রাত পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ মেলেনি।
তবে নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মো. আনিছুর রহমান গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রার্থী নিখোঁজ। নিখোঁজ এবং আত্মগোপন তো সমার্থকই বলা যায়। পারিপার্শিক যে কথা-বার্তা আসছে, যেগুলো ভাইরাল হয়েছে তাতে মনে হচ্ছে আত্মগোপন করেছে।
উকিল আবদুস সাত্তার বাদে বাকি তিনজন প্রার্থীর সমর্থকদের অভিযোগ, পুলিশের পক্ষ থেকে তিন চার দিন ধরে তাঁদের কর্মী-সমর্থক ও এজেন্টদের তালিকা করা হচ্ছে এবং দেখানো হচ্ছে ভয়-ভীতি। উকিল আবদুস সাত্তারকে নির্বাচনে জিতিয়ে আনতে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে নানা তৎপরতা চালানো হচ্ছে বলে স্থানীয় বিভিন্ন দলের নেতারা বলছেন।
স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও ভোটাররা বলছেন, উকিল সাত্তারকে বিনা বাধায় জিতিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয় আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে। ১৪ জানুয়ারি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকারের নেতৃত্বে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়ে আওয়ামী লীগের তিন স্বতন্ত্র প্রার্থী নিজেদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। এরপর থেকে দলের নেতা-কর্মীরা আবদুস সাত্তারের পক্ষে একত্র হওয়া শুরু করেন। প্রচারের বিভিন্ন পর্যায়ে উকিল সাত্তার সমর্থক গোষ্ঠীর ব্যানারে কর্মিসভা, পরামর্শ সভা করা হয়। এসব সভায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও জেলা-উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। আওয়ামী লীগের যে তিনজন নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার পর দলীয় সিদ্ধান্তে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছিলেন, তারাও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সভাগুলোতে উপস্থিত ছিলেন। কর্মিসভায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এবং সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ও সরাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক উম্মে ফাতেমা নাজমা বেগম অংশ নেন। গত ৩০ জানুয়ারি আশুগঞ্জে আবদুস সাত্তারের কর্মিসভায় প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আহমেদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার রাজনীতি বোঝেন না। আওয়ামী লীগ যেকোনো জিরোকে হিরো করতে পারে, হিরোকে জিরো করতে পারে। ১ তারিখ সন্ধ্যার পরে খবর হবে, এখানে কলার ছড়ি জিতেছে। নৌকা জিতেছে। কলার ছড়ির অপর নাম নৌকা।
আমাদের আশুগঞ্জ (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) আসনের শেষ মূহুর্তের প্রচারণাও ছিল অনেকটা নিরুত্তাপ। নির্বাচনী আমেজ বলতে যা বুঝায়, এর কিছুই উপস্থিত নেই। এলাকায় নির্বাচন চলছে সাধারণ মানুষের অনেকেই তা জানেননা। জানলেও ভোটারদের মাঝে তেমন কোনো আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিত নিশ্চিত করতে কাজ করছে আওয়ামী লীগ। এদিকে নিঁেখাজের অভিযোগের চারদিন পার হলেও এখনো পর্যন্ত স্বতন্ত্র প্রার্থী আবু আসিফ আহমেদের খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি। আসিফের সন্ধান চেয়ে তার স্ত্রী মেহেরুন্নেছা জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা বরাবর আবেদন করেছেন। আবেদনে তিনি নির্বাচনে কোন প্রকার লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড পাননি বলে অভিযোগ করেন এবং দ্রæত তার স্বামীকে উদ্ধারের আহবান জানান। এদিকে ভোটের দিন প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সংগঠনের তৃণমূল নেতাকর্মীদের ছাড়াও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারদেরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তারপরও আশানুরূপ ভোটার উপস্থিতি নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। নিরুত্তাপ এই ভোট সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে করতে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে প্রশাসন।
অন্যদিকে বগুড়ার শূন্য দুটি আসনও হিরো আলম প্রার্থী হওয়ার পর বেশ আলোচনা শুরু হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে ভাইরাল হওয়া আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম প্রার্থী হয়ে এ দুই আসনে দিন রাত প্রচারকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। চলচ্চিত্রের নায়িকাও তার প্রাচরনায় অংশ নিচ্ছেন। তবে সুষ্ঠু ভোট নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীরা। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর লোকজনের বিরুদ্ধে প্রচারণায় বাধা, ভয়ভীতি দেখানো ও হামলার অভিযোগ দেওয়া হলেও রিটার্নিং কর্মকর্তা প্রতিকারের উদ্যোগ নেননি বলে অভিযোগ তাঁদের। এখন ‘কেন্দ্র দখল করে ভোট ডাকাতির’ আশঙ্কা করছেন তারা। নির্বাচনের প্রচারণার শেষ দিন রাতে ফেসবুক লাইভে আসেন আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হিসেবে পরিচিত আবদুল মান্নান। তিনি অভিযোগ করেন, কেন্দ্র দখল ও ভোট ডাকাতি করে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে বিজয়ী করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। জেলার কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে অন্য নির্বাচনী এলাকা থেকে ভাড়াটে মাস্তান নিয়ে এসে ভোট ডাকাতির ওই প্রস্তুতির অভিযোগ তোলেন তিনি। ভোট ডাকাতি ঠেকাতে নির্বাচনী এলাকায় বহিরাগতদের আনাগোনা বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তিনি প্রশাসনের কাছে দাবি জানান।
এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শূন্য ২ ও ৩ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পাওয়া দুই প্রার্থী প্রচারনা চালালেও অন্যরা নানান বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন বলে অভিযোগ করছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ (নাচোল-গোমস্তাপুর-ভোলাহাট) ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ (সদর) আসনের উপনির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের সমর্থকেরা সবাই ভোট দিতে গেলে নৌকার প্রার্থীর পরাজয়ের আশঙ্কা করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। এই নির্বাচনে বিএনপির দলীয় অংশগ্রহণ নেই। তাই বিএনপি-জামায়াতের লোকজনকে ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য বলছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ও রাজশাহী জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী সরকার গতকাল মঙ্গলবার সকালে রহনপুরে নিজ বাসভবনে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, শুধু বিএনপির সমর্থক নন, যাঁরা সাধারণ ভোটার আছেন, তাঁদেরও ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের লোকজন নানাভাবে হুমকি দিচ্ছেন। এ ছাড়া তার নির্বাচনী প্রচারণায়ও বাধা দেওয়া হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন