শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

সব কেড়ে নিচ্ছে অজ্ঞান পার্টি

আপন সেজে দংশন নেপথ্যে তিন কারণ-অসচেতনতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঝিমিয়ে পড়া ও এ প্রতারণায় সহজ সাজা-জামিন অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে লাখ টাকা খোয়ালেন প্রকৌশলী

সাখাওয়াত হোসেন | প্রকাশের সময় : ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

সাইফুল ইসলাম। পেশায় ব্যবসায়ী। গত ২১ জানুয়ারী তিনি গাবতলি বাস টার্মিনাল থেকে মালিবাগে আসার জন্য টিকিট কেটে কাউন্টারের সামনে দাঁড়ান। এ সময় অল্প বয়সের এক চা বিক্রেতা কাছে এসে বার বার চা খাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। ছেলেটিকে খুব আপন মনে হওয়ায় তার কাছ থেকে চা কিনে খান। বাসেও উঠেন। তারপর নিজেকে আবিষ্কার করেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেঝেতে। তিনি ইনকিলাবকে বলেন, চা খেতে খুব ভালোবাসতাম। ভুলেও এখন বাইরে চা খাই না। ঘটনার পর কী ঘটেছিল মনে করার চেষ্টা করি, কিছুতেই মনে পড়ে না। এক কথায় আপন সেজে কাছে এসে সব কেড়ে নেয় অজ্ঞান পার্টি বলে তিনি মন্তব্য করেন।
রাজধানীর পল্টনে ভিক্টর ক্লাসিক বাসে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে মো. রেজাউল করিম (৩৫) নামে এক প্রকৌশলী। এ সময় তার সঙ্গে থাকা মালামাল কেনার এক লাখ টাকা নিয়ে যায় প্রতারক চক্র। গতকাল বুধবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। পরে অচেতন অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

এভাবেই প্রতিদিন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে নগদ টাকা-পয়সাসহ মূল্যবান কাগজপত্র হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও অজ্ঞান পার্টির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের খাওয়ানো নেশাজাতীয় দ্রব্যের বিষক্রিয়ায় আবার কেউ কেউ প্রাণও হারাচ্ছে। এর নেপথ্যে রয়েছে তিন কারণ-অসচেতনতা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঝিমিয়ে পড়া ও এ প্রতারণায় সহজ সাজা-জামিন।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল সূত্র জানায়, প্রতি মাসে ৭০ থেকে ৮০ জন মানুষ অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে সেখানে চিকিৎসার জন্য যায়। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে শতাধিক মানুষ অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে। এদের অনেকেই দীর্ঘমেয়াদে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। যাত্রীবাহী বাস, ট্রেন, লঞ্চ, ফেরি-ফেরিঘাট, বাস টার্মিনাল, রেলস্টেশন কোথাও নিরাপদ নয় কেউ। হকার কিংবা সহযাত্রী-বন্ধু সেজে সাধারণ মানুষের সবকিছু কেড়ে নেয় অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, অজ্ঞান পার্টির দৌরাত্ম্য থামাতে পুলিশের বিশেষ দল মাঠে কাজ করছে। অনেককে ধরে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। তবে তাদের কোনোভাবেই নির্মূল করা যাচ্ছে না। এজন্য পথচারী বা যাত্রী সবাইকে সতর্ক হতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার ইনকিলাবকে বলেন, অজ্ঞান পার্টির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত আছে। ঢাকা মহানগরীতে আগের চেয়ে অজ্ঞান পার্টির তৎপরতা কম বা বেশি হয়েছে তা পরিসংখ্যান দেখলে জানা যাবে। তবে অনেক সদস্যকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। তারা কিছুদিন জেল খেটে আবার একই অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে আইন কঠিন হলে এ ধরনের প্রতারণা কমে যেত।

তিনি আরও বলেন, অজ্ঞান ও মলম পার্টির সদস্যরা বেশিরভাগই গণপরিবহন ও ভাসমান অবস্থায় অপরাধ করে। তাই এসব চক্র থেকে রক্ষায় জনসাধারণকেই বেশি সতর্ক হতে হবে। বিশেষ করে চলার পথে কোনো অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক ও খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এ ছাড়া কোনো ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে জানাতে হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ জানান, অজ্ঞান পার্টির বেপরোয়া হওয়ার নেপথ্যে তিনটি কারণ রয়েছে। দেখা যায়, অজ্ঞান পার্টির প্রধান টার্গেট থাকে সাধারণ যাত্রীরা। তারা বিভিন্ন স্থানে ছদ্মবেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। এদের হাত থেকে বাঁচতে সচেতনতার বিকল্প নেই। তবে যারা অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে তারা ঝামেলা এড়াতে অনেকে মামলা করে না। আবার মামলা বা গ্রেফতার হলেও স্বল্প সাজা ও জামিনে বের হয়ে যায়। এসব প্রতারণায় আইন কঠোর হওয়া উচিত। তা হলে এ ধরনের অপরাধ অনেকটা কমে যেত। আবার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ঝিমিয়ে যাওয়ায় অজ্ঞান পার্টির তৎপরতা বেড়ে গেছে। তাই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সজাগ থাকা দরকার।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসার মঈনুল বলেন, সাধারণত অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অজ্ঞান করা হয়। কখনো কখনো মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য যে মাংসপেশিগুলো কাজ করে, সেগুলো অবশ হয়ে যায়। মানুষ আর শ্বাস নিতে পারে না। মারা যায়। যদি ঘুমের ওষুধের পরিমাণ কম হয়, তাহলেও সাত-আট ঘণ্টার আগে আর রোগী স্বাভাবিক হতে পারে না। রোগী আসা মাত্রই প্রথমেই তাদের পাকস্থলী থেকে সব খাবার বের করে নেয়া হয়। তারপরও অনেকের মধ্যে সমস্যা থেকে যায়। কেউ কেউ ঝিমাতে থাকে, কেউ কেউ উত্তেজিত হয়ে যায়। সারা জীবন ভয় তাড়া করে।

ডেমরার কোনাপাড়া এলাকায় একটি ওষুধের দোকানের কর্মচারী মো. হাসান (২০)। গত ২৬ জানুয়ারী বৃহস্পতিবার বিকেল সাতে ৩টার দিকে কোনাপাড়া থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় উঠে যাচ্ছিলেন চৌরাস্তায়। রাস্তায় হকারের কাছ থেকে পানি কিনে খাওয়ার পর আর কিছুই মনে নেই তার। অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা তাকে অচেতন করে মানিব্যাগ ও মোবাইল নিয়ে যায়। স্থানীয় লোকজন হাসানকে চিনতে পেরে তার পরিবারকে খবর দেয় পরে তাকে উদ্ধার করে ঢামেকে ভর্তি করা হয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন