স্মরণকালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে তুরস্ক ও সিরিয়া। বিশেষ করে গৃহযুদ্ধকবলিত সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এখন যেন থমকে যাওয়া এক জনপদ। একে তো এক দশকের গৃহযুদ্ধ সিরিয়ার এ অঞ্চলকে অনেকটা তছনছ করে দিয়েছে। সেইসঙ্গে সোমবারের ভূমিকম্পের ভয়াবহতা এ অঞ্চলের মানুষের মুখ থেকে কেড়ে নিয়েছে হাসি। ভয়াবহ এ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর তুরস্কের সরকারি-বেসরকারি ও বাইরের দেশের পক্ষ থেকে উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা শুরু হলেও সিরিয়ার অবস্থা এর বিপরীত। দেশটির ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা থাকায় বাইরের কোনো দেশ থেকে সেখানে ঢোকা যাচ্ছে না। ভারী ও আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে সিরিয়ার আলেপ্পো অঞ্চলে উদ্ধারকাজ থমকে আছে। নেই সেরকম কোনো ত্রাণ তৎপরতাও। সিরিয়ায় এ পর্যন্ত শুধু ৬ ট্রাকভর্তি ত্রাণসামগ্রী পাঠিয়েছে জাতিসংঘ। তবে সেটা খুবই অপ্রতুল। খোলা আকাশের নিচে হাজারো মানুষ যেন এখন শুধু নিয়তির অপেক্ষায়।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সর্বশেষ খবর অনুযায়ী ভূমিকম্পে দুই দেশেই ২৪ হাজারের কাছাকাছি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে ২০ হাজার ২২৩ জনই তুরস্কের। বাকিরা সিরিয়ার। তবে সিরিয়ায় ঠিকভাবে উদ্ধার তৎপরতা না থাকায় সেখানে প্রাণহানির সঠিক চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না। আলেপ্পোতে এখনো অনেক মানুষ বিধ্বস্ত ভবনের নিচে চাপা পড়ে আছেন বলে জানা গেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সহায়তার জন্য জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস আগামী সপ্তাহে দাতা দেশগুলোর এক সম্মেলন আহ্বান করেছেন।
তুরস্কে গতকাল শুক্রবারও ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে বেশ কয়েকজন জীবিত মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে বিভিন্ন বয়সী শিশুও রয়েছে। ভূমিকম্পের চার দিন পরও এভাবে জীবিত মানুষের উদ্ধারের বিষয়টিকে অনেকে অলৌকিক বলে মনে করছেন। মারাত্মক ঠান্ডা আবহাওয়ার মধ্যে এভাবে এতক্ষণ বেঁচে থাকা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছিলেন উদ্ধারকর্মীরা। তাই হঠাৎ করে ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে যখন কোনো জীবিত মানুষকে বের করে আনা হচ্ছিল, অনেক উদ্ধারকর্মীকে আবেগে কাঁদতে দেখা যায়। তবে এরকম অলৌকিক ঘটনারও সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে বলে মনে করছেন তারা।
এদিকে সিরিয়ার সরকারি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দপ্তরের উদ্ধারকারী বাহিনী হোয়াইট হেলমেট দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ আলেপ্পোতে উদ্ধার তৎপরতা ও ত্রাণ বিতরণ কর্মসূচি পরিচালনার দায়িত্বে আছে। তবে তাদের সেই কর্মকাণ্ড খুবই অপ্রতুল। ভূমিকম্পে সিরিয়ার এই প্রদেশটিতে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি।
হোয়াইট হেলমেটের কর্মকর্তা ওবাদাহ আলওয়ান বিবিসিকে জানিয়েছেন, একদিকে ভারী ও আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে উদ্ধার তৎপরতা ঠিকমতো চালাতে পারছেন না তারা, অন্যদিকে ত্রাণসামগ্রীর সরবরাহ না থাকায় আহতদের চিকিৎসা ও খাদ্য সহায়তা প্রদানও গুরুতরভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
বিবিসিকে আলওয়ান বলেন, চতুর্দিকে চূড়ান্ত এলোমেলো পরিস্থিতি। পুরোনো সব যন্ত্রপাতি নিয়ে আমাদের কাজ করতে হচ্ছে। আধুনিক ও ভারী উপকরণ না থাকায় ধ্বংসাবশেষের নিচে চাপা পড়াদের উদ্ধারকাজ বারবার ব্যাহত হচ্ছে, আবার যাদের আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হচ্ছে তাদের আমরা খাদ্য-চিকিৎসা সহায়তা ঠিকমতো দিতে পারছি না।
তিনি বলেন, বুধবার পর্যন্ত বিভিন্ন ভবনের ধ্বংসাবশেষ থেকে জীবিতদের আর্তি শোনা গেছে। বৃহস্পতিবার থেকে ক্ষীণ হয়ে এসেছে সেই আর্তি; অর্থাৎ এখনো যারা চাপা পড়ে আছেন, তাদের অনেকে ইতোমধ্যে মারা গেছেন। এরকম এক পরিস্থিতিতে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ গতকাল শুক্রবার এই প্রথমবারের মতো আলেপ্পোর এক হাসপাতালে ভূমিকম্পে আহতদের দেখতে যান। এ সময় তার স্ত্রী সঙ্গে ছিলেন।
উল্লেখ্য, সোমবার (৭ ফেব্রুয়ারি) স্থানীয় সময় ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে তুরস্ক ও এর প্রতিবেশী দেশ সিরিয়া। ওই ভূমিকম্পের ১৫ মিনিট পর ৬ দশমিক ৭ মাত্রার আরও একটি বড় ভূমিকম্প এবং পরে আরও অনেক আফটারশক হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তাৎক্ষণিক এক বিবৃতিতে বলা হয়, তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় কাহরামানমারাস প্রদেশের গাজিয়ানতেপ শহরের কাছে ভূপৃষ্ঠের ১৭ দশমিক ৯ কিলোমিটার গভীরে ছিল ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল। গত প্রায় ৫ দিনে ভয়াবহ এই দুর্যোগে নিহতের সংখ্যা ২৩ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এদের মধ্যে সিরিয়ায় মৃতের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি। তবে এখানে এই সংখ্যাটি আরও কয়েকগুণ বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ ভারী যন্ত্রপাতির অভাবে অনেক জায়গায় উদ্ধার তৎপরতা শুরু করা যায়নি। গত এক দশকের গৃহযুদ্ধে সিরিয়ার যেসব প্রদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেসবের মধ্যে আলেপ্পো অন্যতম। প্রদেশটির বিভিন্ন শহর এখনো ক্ষমতাসীন বাশার সরকারের বিরোধীরা নিয়ন্ত্রণ করে। সোমবারের ভূমিকম্পে সিরিয়ার অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় ৪০ লাখ মানুষ অধ্যুষিত আলেপ্পোতে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে অনেক বেশি। গৃহযুদ্ধের জেরে সিরিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বেশকিছু নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল সিরিয়ার ওপর, যেগুলো এখনো কার্যকর আছে। এর মধ্যে একটি হলো সিরিয়ার বিমান ও সমুদ্রবন্দরে বিদেশি উড়োজাহাজ ও জাহাজ প্রবেশ বা নোঙরবিষয়ক নিষেধাজ্ঞা। এই নিষেধাজ্ঞার কারণে সিরিয়ায় ত্রাণ পাঠাতে অনেক দেশের ইচ্ছে থাকলেও উপায় ছিল না। বুধবার অবশ্য সিরিয়াতে ৬ ট্রাকভর্তি ত্রাণসামগ্রী পাঠিয়েছে জাতিসংঘ। ভূমিকম্পের পর এটি ছিল সিরিয়াতে প্রথম কোনো বিদেশি ত্রাণের সরবরাহ। তবে বিবিসিকে ওবাদাহ আলওয়ান জানিয়েছেন, চাহিদার তুলনায় এই সরবরাহ খুবই অল্প।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন