শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

দাবি সেতুর, এলো ফেরি

কালুরঘাটে নতুন একটি ব্রিজের স্বপ্ন এখনো অধরা : কর্ণফুলীর দু’পাড়ে লাখো মানুষের ক্ষোভ হতাশা

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০২ এএম

চট্টগ্রামের কালুরঘাট সেতুর পাশে ফেরি সার্ভিস চালু হচ্ছে। এসেছে তিনটি ফেরি। ফেরিঘাট আর সংযোগ সড়কের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। জরাজীর্ণ সেতুর বদলে ফেরিপথে চলবে যানবাহন। কালুরঘাটে নতুন একটি সেতুর দাবি তিন দশকেরও বেশি সময়ের। কর্ণফুলীর দুই পাড়ের লাখো মানুষের স্বপ্ন ছিল সেতু হবে। চেরাগের নিচে অন্ধকার’ ঘুছবে। বোয়ালখালীসহ ওই অঞ্চলের সাথে চট্টগ্রাম নগরীর যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর হবে।
কিন্তু সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে গেছে। সেতুর বদলে ফেরি দেখে হতাশ দুই পাড়ের বাসিন্দারা। চরম ক্ষোভ-অসন্তোষ প্রকাশ করে অনেকে বলছেন-চেয়েছি সেতু, পেলাম ফেরি। একটি সেতুর জন্য চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে ওই অঞ্চলের বাসিন্দাদের। ভাঙাচোড়া রেল সেতুতে নিত্য দুর্ভোগ ঠেলে যাতায়াত করতে হচ্ছে। সেতুর দাবিতে রাজপথে নামছেন মানুষ। সেতু হবে-এমন আশ্বাসে আশা জাগে, তবে সে আশার আলো ফের নিভে যায়।
বর্তমান সরকারের তরফে প্রতিশ্রুতি ছিল সেতুর। কক্সবাজারমুখি রেল লাইনের কাজ শুরু হলে মানুষ আশায় বুক বাঁধে-রেলের জন্য হলেও কালুরঘাটে সেতু হবে। কিন্তু সে আশায় গুড়োবালি। বলা হচ্ছে- শতবর্ষের পুরনো সেতু হয়েই কক্সবাজার যাবে রেল। আর এজন্য সেতুতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। আবার একটি নতুন সেতুর যে প্রকল্প নেয়া হয়েছে তাও চলছে সম্ভুক গতিতে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী ২০২৫ সালের আগে নতুর সেতুর কাজ শুরু করার কোন সম্ভাবনা নেই। অতএব ফেরিতেই ভরসা।
কালুরঘাট সেতুর ওপর চাপ কমাতে ফেরি চালু করতে যাচ্ছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ। ফেরি চলাচলের জন্য এখন প্রায় চার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায়ে। নতুন সেতু নির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত কালুরঘাটে ফেরিগুলো চলাচল করবে। সড়ক ও জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, ফেরিঘাট ও সংযোগ সড়ক নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এই মাসের শেষে না হলেও আগামী মার্চের শুরুতে ফেরি চলাচল শুরু হবে। তিনটি ফেরি এসেছে, যানবাহনের চাপ বাড়লে আরো ফেরি আনা হবে।
প্রায় ১০০ বছরের পুরনো বিদ্যমান কালুরঘাট রেলসেতু দিয়ে ট্রেনের পাশাপাশি যানবাহনও চলাচল করে। সেতুটি নড়বড়ে হয়ে পড়ায় প্রায় দুর্ঘটনা ঘটছে। সেতুতে কোন যানবাহন আটকা পড়লে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দুই পাড়ে তীব্র যানজট হচ্ছে। তাতে প্রতিনিয়তই চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন ওই সেতু হয়ে চলাচলকারীরা। বোয়ালখালী-পটিয়াসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের একাংশের বন্দরনগরীর সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম এই সেতু। একমুখী সেতুর একপাশে গাড়ি উঠলে আরেকপাশ বন্ধ থাকে। ফলে দীর্ঘ যানজটের ভোগান্তি চলছে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে।
যেখানে স্বাভাবিক যানবাহন চলাচল করতে সেতুর অবস্থা বেহাল সেখানে এই সেতু হয়ে কক্সবাজারমুখী রেল চলাচলের আয়োজন চলছে। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষ সেতুটি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারের অন্যতম মেগা প্রকল্প চট্টগ্রামের দোহাজারি থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল লাইন প্রকল্প এগিয়ে চলছে। এই কাজ শেষ করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন নিয়ে যাবার পরিকল্পনা আছে সরকারের।
সেতুটি সংস্কার করে ট্রেন চালানোর আপাতত উপযোগী করার জন্য সমীক্ষা পরিচালনা করতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে (বুয়েট) দায়িত্ব দিয়েছে রেলওয়ে। জানা গেছে, মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে সমীক্ষা প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে। এরপর ১০ থেকে ১২ কোটি টাকায় এই বছরের মধ্যেই সংস্কার কাজ শেষ করা হবে।
কালুরঘাট সেতু হয়ে এখন প্রায় ১২ মেট্রিক টন এক্সেল লোডের অর্থাৎ ছোট লোকোমোটিভ বা হালকা ওজনের কোচ চলাচল করে। কিন্তু ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজারে যেসব ট্রেন নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে, সেগুলোর ইঞ্জিন ১৫ মেট্রিক টনের এক্সেল লোডের বেশি। রেলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বুয়েটের কাছে ২৫ এক্সেল লোডের ট্রেন চালানোর উপযোগী করে সংস্কার পরিকল্পনা চাওয়া হয়েছে। সেভাবেই তারা কাজ করছে। সংস্কার কাজ চলাকালে এবং কালুরঘাটে নতুন সেতু নির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত সেখানে ফেরি চলাচল করবে। ফেরিতে প্রতি ট্রিপে ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ২১টি যানবাহন পার হবে। তবে সংস্কার কাজ শুরু আগ পর্যন্ত ছোট গাড়ি সেতুর ওপর দিয়ে চলবে। সংস্কার কাজ শুরু হলে সব গাড়িই বহন করতে হবে ফেরিকে।
কালুরঘাটে নতুন একটি সেতু নির্মাণের দাবি দীর্ঘদিনের। বিএনপির আমলে কর্ণফুলী সেতু হলেও কালুরঘাটে কোন সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বিগত ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর কালুরঘাটে নতুন সেতুর দাবি আরও জোরালো হয়। কয়েক বছর আগে এই লক্ষ্যে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। বোয়ালখালী-চান্দগাঁও আসনের সংসদ সদস্য মরহুম মঈনুদ্দিন খান বাদল ও মোছলেম উদ্দিন আহমেদ সেতু নির্মাণের অঙ্গিকার করেন। তবে সেতুর কাজ শুরু দেখে যেতে পারেননি তারা। কারণ প্রকল্প নেওয়া হলেও তার কাজ চলছে ধীরগতিতে। নকশা প্রনয়নেই কয়েক দফা হোচট খেতে হয়। সর্বশেষ গত আগস্টে কোরিয়ার একটি প্রতিষ্ঠান সেতুর একটি নকশা তৈরি করে। তাতে সম্মতি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নতুন এই নকশা চূড়ান্ত হলেও ২০২৫ সালের আগে নির্মাণকাজ শুরুর সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। কারণ এই প্রকল্পে এখনও দীর্ঘ প্রক্রিয়া বাকি আছে।
এদিকে সেতু নিয়ে এমন টালাবাহানায় ওই এলাকার বাসিন্দারা হতাশা প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, বর্তমান সরকারের বিগত ১৪ বছরে চট্টগ্রামসহ সারা দেশে ব্যাপক উন্নয়ন হলেও অবহেলিত থেকে গেছে কালুরঘাটের দুই পাড়ের লাখো মানুষ। একটি সেতুর অভাবে লাখো মানুষকে নিত্য দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। সেতু না থাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর হয়নি, এতে উন্নয়ন-বিনিয়োগের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বিশেষ করে বোয়ালখালীসহ আশপাশের এলাকায় এখনও নগরায়ন ও উন্নয়নের কোন ছোঁয়া লাগেনি।
অথচ কর্ণফুলী সেতু চালুর পর বিগত কয়েক বছরে পটিয়া এবং আনোয়ারা উপশহরে পরিনত হয়েছে। সেখানে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে নতুন নতুন কলকারখানা হচ্ছে। তাতে কর্মসংস্থান বাড়ছে, আর্থ-সামাজিক অবস্থার দ্রুত উন্নতি হচ্ছে। কর্ণফুলী টানেল চালু হলে নদীর ওপারে নতুন মহানগর গড়ে উঠবে। অথচ তার উল্টো চিত্র বোয়ালখালী এলাকায়। নগরীর কাছে হয়েও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না হওয়ায় পিছিয়ে পড়েছে এই জনপদ। এ যেন চেরাগের নিচে অন্ধকার।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন