ভারতে বিজেপিশাসিত হরিয়ানায় জুনায়েদ ও নাসির নামে দু’জন মুসলিম যুবককে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছে। নিহতদের পরিবারের অভিযোগ, পুলিশ জুনায়েদ ও নাসিরের বোলেরো গাড়িতে ধাক্কা দিয়ে ধরেছিল। এর পরে, তাদেরকে অর্ধমৃত অবস্থায় বজরং দলের মনু মানেসার এবং তার সঙ্গীদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। গরু পাচারের সন্দেহে বোলেরো গাড়িসহ দু’জনকে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছে তারা। -পার্সটুডে
বৃহস্পতিবার ভিওয়ানির লোহারু গ্রামের কাছে তাদের লাশ পাওয়া যায়। অভিযুক্ত মনুর বিরুদ্ধে ২০ দিনে ২টি খুন ও ১টি খুনের চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে। পরিবারের অভিযোগ, ঘটনার সময় ফিরোজপুর-ঝিরকার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির (সিআইএ) টিম সেখানে উপস্থিত ছিল। দু’জনকেই প্রথমে বেধড়ক মারধর করা হয়। এরপর এরা জুনায়েদ ও নাসিরকে থানায় নিয়ে গেলেও অবস্থা বেগতিক দেখে পুলিশ তাদের হেফাজতে নিতে অস্বীকার করে। এর পরেই বোলেরোসহ জীবন্ত পুড়িয়ে মারার খবর আসে। অন্যদিকে, পরিবারের অভিযোগ মিথ্যা বলে খারিজ করে দিয়েছে পুলিশ। ফিরোজপুর ঝিরকার ‘সিআইএ’ ইনচার্জ বীরেন্দর সিং বলেছেন, এই বিষয়ে তাদের কোনও সম্পর্ক নেই। তারা কোনো আসামিকে ধরেনি বা বজরং দলের লোকজনের হাতে তুলে দেয়নি। সেদিন তার গাড়ি, স্টাফ এবং তিনি নিজেও থানায় ছিলেন। পরিবার কেন এমন অভিযোগ করছে তা তারা জানে না।
নিহত জুনায়েদ (৩৫) ও নাসির (২৮) দু’জনেই রাজস্থানের ভরপুর জেলার ঘাটমিকা গ্রামের বাসিন্দা। এই গ্রামটি হরিয়ানা সীমান্তের কাছে। জুনায়েদের চাচাতো ভাই ইসমাইল বুধবার গোপালগড় থানায় (ভরতপুর) উভয়কে অপহরণ ও মারধরের মামলা দায়ের করেছিলেন। ভিওয়ানি এবং রাজস্থানের ভরতপুর জেলা পুলিশ তদন্তে নিযুক্ত রয়েছে। দু’জনের কঙ্কালের নমুনা নেওয়া হয়েছে। এবং ‘ডিএনএ’ টেস্ট করা হচ্ছে।নিহত জুনায়েদের চাচাতো ভাই ইসমাইল বলেন, জুনায়েদ ও নাসির গত মঙ্গলবার ভোরুবাস সিক্রি গ্রামে গিয়েছিল। এখানে তার ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি। তারা সেখানে রাত কাটান। বুধবার সকালে বাড়ি ফিরছিলেন। পথিমধ্যে ‘সিআইএ’ টিম ও বজরং দলের লোকজন উভয়কেই আটকে দেয় এবং তাদের নাম জিজ্ঞেস করে। এরপর দু’জনকে গাড়ি থেকে টেনে বের করার চেষ্টা করা হয়।
ইসমাইল বলেন, বজরং দলের লোকজনের কারণে এলাকায় ইতোমধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এর আগে বজরং দলের সদস্যদের কথিত মারধরের কারণে নুহতে মারা গিয়েছিলেন ওয়ারিস। নাসির-জুনায়েদ তাদের টানাটানি হচ্ছে দেখে প্রাণ বাঁচাতে বোলেরো গাড়িটি সরিয়ে নিয়ে যায়। স্বজনরা বলছেন, জুনায়েদ-নাসির প্রাণ বাঁচিয়ে বোলেরো গাড়িতে পালাতে দেখে ফিরোজপুর-ঝিরকা ‘সিআইএ’ সামনে থেকে গাড়িটিকে ধাক্কা দেয় এবং বজরং দলের লোকজন পেছন থেকে ধাক্কা মারে। তাদের অভিযোগ, এই হত্যাকাণ্ডে পুলিশও সমানভাবে জড়িত। তার প্রমাণ দিচ্ছেন গ্রামবাসীরা। আমাদের সাক্ষী আছে। বিরুকা চৌত্রী যাওয়ার পথে দু’জনকে একটি গাড়িতে তুলে ফিরোজপুর-ঝিরকা থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে বজরং দলের লোকজন দু’জনকেই পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করলেও দু’জনের অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে পুলিশ তাদের রাখতে রাজি হয়নি।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বজরং দলের নেতা মনু মানেসার, রিংকু সাইনি ছাড়াও আরও ৭/৮ জন লোক আমাদের দুই ভাইকে ভিওয়ানিতে নিয়ে গিয়েছিল যখন পুলিশ তাদের হেফাজতে নিতে অস্বীকার করেছিল। তাদেরকে পেছনের সিটে বসিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় বলে অভিযোগ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়ার পর আমরা দু’জনের মৃত্যুর খবর জানতে পারি। গাড়ির ইঞ্জিন ও চেসিস নম্বর দেখে জানা গেছে এটি আমাদের গাড়ি। যারা মারা গেছে তারা দু’জনেই আমাদের ভাই।
এদিকে, হরিয়ানার ভিওয়ানিতে দুই মুসলিম যুবককে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার ঘটনায় হিন্দুত্ববাদী বিজেপিশাসিত হরিয়ানা সরকারের সমালোচনা করেছে কংগ্রেস দল। কংগ্রেসের সিনিয়র নেতা রণদীপ সূর্যেওয়ালা এবং ইমরান প্রতাপগড়ি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওই বিষয়ে রাজ্য সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন।
রণদীপ সূর্যেওয়ালা বলেছেন, হরিয়ানাকে এখন 'ঘৃণার কারখানা' বানানো হচ্ছে। বজরং দলের লোকেরা দুই ভাইকে অপহরণ করে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার হৃদয়বিদারক ট্র্যাজেডি ভারতের আত্মাকে নাড়া দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, মনু মানেসারের বিরুদ্ধে এর আগেও সহিংসতার মামলা রয়েছে। এটা যে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ঘটছে তা স্পষ্ট। অন্যদিকে, কংগ্রেসের রাজ্যসভার এমপি ইমরান প্রতাপগড়ি বলেছেন, হরিয়ানার ভিওয়ানিতে গো-সন্ত্রাসীদের দ্বারা দুই যুবক জুনায়েদ এবং নাসিরকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার ঘটনায় হরিয়ানা পুলিশের নীরবতা লজ্জাজনক। আমি রাজস্থানের বাসিন্দা এই দুই যুবকের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ন্যায়বিচারের লড়াইয়ে সাহায্য করব।
ভারতের মজলিশ-ই-ইত্তেহাদুল মুসলেমিন (মিম) প্রধান ব্যারিস্টার আসাদউদ্দিন ওয়াইসি এমপি এক বার্তায় বলেছেন, ‘হরিয়ানায় গোরক্ষকদের নামে একটি সংগঠিত চক্র জুনায়েদ ও নাসিরকে হত্যা করেছে। এই অমানবিক হত্যাকাণ্ডের যতই নিন্দা করা হোক তা যথেষ্ট নয়। এই ঘটনায় জড়িত মনু মানেসার ও তার সহযোগীদের বিজেপি ও আরএসএসের সমর্থন রয়েছে। বিজেপি যে মৌলবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে তারা আগামী সময়ে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। তাই কেন্দ্রীয় সরকার ও হরিয়ানার বিজেপি সরকারের উচিত নয় এই ধরনের লোকদের রক্ষা করা বা সুরক্ষা দেওয়া। ওয়াইসি বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কী এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে নীরবতা ভাঙবেন?’ হরিয়ানায় মনোহর লালের নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার মনু মানেসারকে সুরক্ষা দেয় এবং হরিয়ানা সরকার এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী বলেও মন্তব্য করেছেন ওয়াইসি।
আজ (শুক্রবার) দৈনিক ভাস্কর হিন্দি গণমাধ্যম সূত্রে প্রকাশ, গত বৃহস্পতিবার, হরিয়ানার ভিওয়ানির লোহারুতে একটি বোলেরো গাড়িতে নাসির এবং জুনায়েদ উভয়ের লাশ কঙ্কাল হিসেবে পাওয়া যায়। তাদের দেহ ও গাড়ি উভয়ই সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। পরিবারের পক্ষ থেকে উগ্র হিন্দুত্ববাদী বজরং দল এবং হরিয়ানা পুলিশের ফিরোজপুর-ঝিরকা সিআইএ’র বিরুদ্ধে তাদের দু’জনকে হত্যার অভিযোগ আনলেও বজরং দল এবং পুলিশ উভয়েই পরিবারের অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন