নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়া। প্রায়ে সাড়ে ৭লাখ লোকের বসবাস ১১টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার এ দ্বীপে। প্রায় ৪শত বছর আগে মেঘনা বুকে গড়ে উঠা দ্বীপের কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ব্যবস্তা নিশ্চিত করতে পর্যায়ক্রমে এ দ্বীপে প্রতিষ্ঠা করা হয় ২২৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
কিন্তু বর্তমানে হাতিয়ার বেশির ভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা ভঙ্গুর অবস্থায়।বিদ্যালয় গুলোতে শিক্ষার্থী, শিক্ষক সংকট চরমে, বিদ্যালয়ে সময়মতো আসা ও বরাদ্দকৃত অর্থ সঠিক কাজে ব্যবহার না করা সহ বিভিন্ন ধরনের দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগ রয়েছে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে।
সরজমিনে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি দ্বীপের বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে দেখা গেছে, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে সকাল ৯টার মধ্যে বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও ১০টা সাড়ে ১০টা বার তার অনেক সময় পরও বিদ্যালয়ে আসেন শিক্ষকরা। ছুঁটির আবেদন না করেও ছুঁটি কাটান অনেকে। অনেক বিদ্যালয়ে হয়না নিয়মিত পাঠদান অবহেলা রয়েছে শিক্ষার্থীদের হাজিরা তদারকিতেও।
কয়েকটি বিদ্যালয়ে রয়েছে প্রধান ও সহকারি শিক্ষক সংকট, বছরের পর বছর ধরে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন সহকারি শিক্ষক। বুড়িরচর ইউনিয়নের রেহানিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, ওই বিদ্যালয়ে ভারপ্রাপ্ত একজন প্রধান শিক্ষক সহ পদায়ন রয়েছে ৫ শিক্ষকের।
যার মধ্যে একজন মাতৃত্বকালিন ছুঁটিতে। বাকি চার জনের মধ্যে সকাল ৯টা ৪০মিনিট পর্যন্ত বিদ্যালয়ে উপস্থিত আছেন মাত্র দুই জন। পরবর্তীতে সকাল ১০টায় জয় হরি ভূষণ পাল নামের একজন সহকারি শিক্ষক ও রাহেনা আক্তার নামের আরও একজন সহকারি শিক্ষক বিদ্যালয়ে আসেন, যদি সকাল ৯টার মধ্যে বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকার কথা ছিলো শিক্ষকদের। কাগজে কলমে বিদ্যালয়টিতে ভর্তি আছেন প্রায় তিনশত শিক্ষার্থী কিন্তু বাস্তবে প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী রয়েছেন অর্ধশতাধিক। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি খাতায় ২৬ ও ২৭ ফেব্রুয়ারির হাজিরার কোন রেকর্ডও নেই। বিদ্যালয়ের বার্ষরিক বরাদ্দের টাকা পেতে কর্তব্যরতদের এমন পরিকল্পনা বলে অভিযোগ রয়েছে।
নির্দিষ্ট সময়ে বিদ্যালয়ে না আসার বিষয়ে জানতে চাইলে সহকারি শিক্ষক জয় হরি ভূষণ পাল বলেন, হার্টে সমস্যা থাকার কারনে তিনি প্রায়সময় অসুস্থতা বোধ করেন। যার কারণে বিদ্যালয়ে আসতে উনার কিছু সময় বিলম্ব হয়।
রাহেনা আক্তার বলেন, তিনি হাতিয়া পৌর এলাকা ওছখালি বাসায় থাকেন। গাড়িতে সমস্যা হওয়ার কারণে আজ আসতে কিছুটা দেরি হয়েছে তার।
এ বিষয়ে রেহানিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) মো. ইউনুস বলেন, গত ২০২০ সাল থেকে এ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদটি শূন্য। তিনি ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব নেওয়ায় বিদ্যালয়ের অপর সহকারি শিক্ষকরা তার কথার বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করেন না। নিজেদের সময় মতো বিদ্যালয়ে আসেন তারা।
সহকারি শিক্ষকদের এমন আচারনের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছিলো কিনা সে বিষয়ে জানতে চাইলে মো. ইউনুস কোন সদুত্তর দিতে পারেন নি। তবে অজ্ঞাত কারনে তিনি বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানান নি বলে অকপটে স্বীকার করেছেন।
এদিকে, গত ২২ ফেব্রুয়ারি হরনী আহম্মদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পাঠদান চলাকালে শ্রেণি কক্ষের চেয়ারে বসে ঘুমানো অবস্থায় সহকারি শিক্ষক শিবরা রানী দাসের বেশ কয়েকটি ছবি ও ভিডিও ধারন করে স্থানীয় লোকজন, যা এ প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষণ আছে। এ বিষয়ে জানতে বিদ্যালয়ে গেলে প্রধান শিক্ষককে পাওয়া যায়নি। বিদ্যালয়টিতে রয়েছে শিক্ষার্থী সংকট, দ্বিতীয়
শ্রেণিতে মাত্র ৫জন শিক্ষার্থীর পাঠদান নিচ্ছেন একজন শিক্ষক।
পূর্ব ছোট দেইল এ হালিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে না অনিয়মের চিত্র, ওই বিদ্যালয়ে ছয় জন শিক্ষক কর্মরত থাকলেও দুপুর ১২টার দিকে পাওয়া যায় চার জনকে। কিছুক্ষণ পর বিদ্যালয়ে আসেন সহকারি শিক্ষক তানজিনা আক্তার। অনুপস্থিত সুনিল চন্দ্র দাসের বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রথমে কোন সদোত্তর দিতে পারেন নি।
এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক স্বপন কুমার দাস বলেন, সুনিল চন্দ্র দাস ২৭ ফেব্রুয়ারি পারিবারি কাজ আছে বলে মুখিক ছুঁটি নিয়ে যান। পরে তিনি জানান ২৮ ফেব্রুয়ারি বিদ্যালয়ে আসবেন না, তবে লিখিত বা ছুঁটির কোন আবেদন করেন নি তিনি।
একাধিক সূত্র বলছে, প্রতি বছর বিদ্যালয়ের জন্য সরকারি ভাবে ক্ষুদ্র মেরামত বাবদ ২লাখ, স্লিপফান্ড থেকে ৫০ থেকে ৭০হাজার, সিএসআর থেকে ২০হাজার, প্রাক-প্রাথমিকের খেলাধুলা উপকরণ বাবদ ১০হাজার এবং রুটিন ম্যান্টেইন হিসেবে
৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ি এসব কাজ করার কথা থাকলেও বেশির ভাগ বিদ্যালয়ে তা দৃশ্যমান না। কয়েকটি বিদ্যালয়ে অল্পকিছু কাজ হলেও পরিপূর্ণ কাজ হয়নি কোথাও। বিদ্যালয়ে পাঠদান ভালো না হওয়ায়, শিক্ষকদের সময় মতো বিদ্যালয়ে উপস্থিত না হওয়া ও শিক্ষকদের আন্তরিকতার অভাবে প্রতিনিয়িত দ্বীপের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী দিন দিন কমে যাচ্ছে। এমন চিত্র দ্বীপের ২২৭টি বিদ্যালয়ের বেশির ভাগই। এসব বিষয়ে কর্তৃপক্ষ দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থী শূন্য হয়ে পড়বে এমন শংকা স্থানীয়দের।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ের তথ্যমতে, হাতিয়ায় ২২৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। যার মধ্যে প্রধান শিক্ষক পদে ২২৭টি অনুমোদিত ও সহকারি শিক্ষক পদে ১২১৮টি অনুমোদিত পদ রয়েছে। এরমধ্যে প্রধান শিক্ষক রয়েছেন ১৭৫জন আর সহকারি শিক্ষক পদে কর্মরত ১১৫৬শিক্ষক, বাকি পদগুলো দীর্ঘদিন ধরে শূন্য পড়ে আছে। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার একটি ও সহকারি শিক্ষা কর্মকর্তার ৬টি পদই শূন্য, যার ফলে বিদ্যালয়গুলো সঠিক ভাবে তদারকি করা সম্ভব হয়না।
এ বিষয়ে হাতিয়ার ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা কামরুল হাসান বলেন, কিছু বিদ্যালয়ে অনিয়ম রয়েছে। ইতোমধ্যে দায়িত্ব অবহেলা ও অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ায় চরকিং ইউনিয়নের সুলতানা রাজিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষককের বেতন গত ডিসেম্বর থেকে স্থগিত রাখা হয়েছে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফেরদৌসী বেগম বলেন, হাতিয়ার অনেকগুলো বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অনিয়মের নানা অভিযোগ রয়েছে বলে আমি জেনেছি। বিষয়গুলো নিয়ে আমরা সরজমিন পরিদর্শন করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। সরকারি নিয়ম মেনে সবাইকে নিজের দায়িত্ব পালন করতে, অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে দাপ্তরিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন