রহিমা আক্তার মৌ
-- মা ডিসেম্বর মাস তো কবেই এলো, তুমি তো এবার এখনো পতাকা কিনে দাওনি।
-- গত বছরেরটা কোথায় আছে দেখি, না পেলে কিনে দিব।
সত্যি ডিসেম্বর এলেই আমরা অতি বেশি দেশপ্রেমী হয়ে যাই। পতাকা কিনি উড়াই, অনেক সময় নিয়ম না মেনেই পতাকা উড়াতে থাকি। এসব ভালো না লাগলেও অনেক কথা ভেবে করতে হয়।
সকাল থেকে নিজের কাজগুলো শেষ করে বিছানায় শুয়ে শুয়ে পত্রিকা পড়ছে নীলাঞ্জনা। প্রতি সাপ্তাহের প্রায় সব পত্রিকার সাহিত্য পাতা ছোটদের পাতা সে নিয়ে আসে ঘরে, সময় করে সেগুলো পড়ে। আজ বাইরে কোনো কাজ নেই, তাই পত্রিকার সাহিত্য পাতা ম্যাগাজিনগুলো দেখবে।
শহরে হালকা হালকা শীত পড়লেও গ্রামে বেশ শীত পড়েছে। তাই হালকা কাঁথাটা শরীরের উপর দিয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। কলিংবেল বেজে উঠে নিশ্চয়ই হালিমা এসেছে। উঠে দরজা খুলে দিয়ে হালিমাকে কিছু কাজ বুঝিয়ে দিয়ে আবার বিছানায় আসে। গত সপ্তায় গেস্ট থাকায় সব পত্রিকা জমা হয়েছে।
চলছে বিজয়ের মাস, চারপাশে একটা বিজয়ের আনন্দ। তার পত্রিকার পাতায় পাতায় বিজয়ের লেখা, মনে হয় বিজয়ের উল্লাস বাঙালির চোখে মুখে অন্তরে অন্তরে।
হুট করে অল্প আওয়াজে কলিংবেলটা বেজে উঠলো। নিশ্চই তুলতুলি এসেছে, এমন করে ও ছাড়া আর কেউ বাজায় না।
-- হালিমা দরজাটা খোল, দেখোতো কে এসেছে।
রান্নাঘরে হালিমার গুত গুত কথা শোনা যায়। নিশ্চয়ই দরজা খুলতে বিরক্তি দেখাচ্ছে। হালিমা নিজেও জানে নীলাঞ্জনা এখন উঠবে না, তাই ওকেই দরজা খুলতে হবে। তখনি আবার বেল বেজে উঠলো।
-- হালিমা, ও হালিমা, গুত গুত করা বাদ দিয়ে দরজাটা খোল। দেখতো কে এসেছে।
-- এই বেলায় কে আইবো আফনে জানেন না। নিশ্চয়ই তুলতুলি আইছে।
-- আচ্ছা খুলে তো দেখো।
হালিমার মুখের গুতু গুতু কথা আর কমে না, বরং বেড়েই চলছে। তাও গিয়ে দরজা খোলে। খুলেই আরো জোরে বকবক করছে। নীলাঞ্জনা ঠিক জানে এটা তুলতুলির কাজ। কাজে আসার পর তুলতুলি এলে হালিমা ঠিক এমন করে।
দরজা খুলে দিয়েই হালিমা রান্নাঘরে যায়, যেটুকু আওয়াজ করে বকবক করছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ আওয়াজে কথা বলছে তুলতুলি। এটাকে কথা বললে ভুল হবে, কোনো কিছুর জন্যে বায়না করছে মনে হয়। বেডরুম থেকে শুধু শোনা যাচ্ছে....
-- নানী নানী চলো, চলো, তুমি নিচে আইও।
-- আচ্ছা তরে আইতে কইলো কেডা, য়্যার তো কাম আছে। হয় চুপ কইরা বইয়া থাক, নয় চইলা যা।
তাও তুলতুলি পেছনে পেছনে ঘুরছে। খুব জোরে একটা ধমকের শব্দ শোনা যায়। নীলাঞ্জনা শুনেও চুপ থাকে। হালিমা ঘর ঝাড়ু দিতে যায় বেডরুমে।
-- হালিমা তুলতুলি ঘ্যান ঘ্যান করে কেনো।
-- কেন আর, হয় ওর মায় দিছে বকা, না হয় কিছু কিনে দিতে। এছাড়া আর কি হইবো।
-- তাও জানতে চাইতে পারতে, বাচ্চাদের কথা শুনতে হয়, কখন যে প্রয়োজনীয় কি বলে।
-- আফা আফনে তো জানেন ও কেমন।
-- জানি বলেই বললাম।
তুলতুলি ও তুলতুলি এদিকে আয় তো, কি হইছে শুনি। কিরে কথা শুনিস না, আয় আমি শুনি কি হইছে।
তুলতুলি আসে, পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।
-- কিরে কি হইছে?
-- নানীরে একটা দেখতে ডাকছি।
-- একটা লোক কেমন কাপড় নিয়ে আইছে।
-- কাপড় মানে?
-- আরে আফা, আফনেরে কেমন কই, লম্বা একটা লাঠির মাঝে বান্ধা কাপড়। সব গুলান কাপড় এক রকম।
বুঝতে পারছে না কিছুই নীলাঞ্জনা। হালিমাকে ডেকে বলে....
-- হালিমা একটু নিচে যাও তো। তুলতুলি কি দেখার কথা বলছে দেখে আসো।
হাতের ঝাড়ু রেখে হালিমা বের হয়ে যায়, তুলতুলিও পেছন পেছন যায়। একটু পর উঠে আসে দুজনেই।
-- আফা কই নিচে কেউ নাই, দোকানদার কইলো কোন বেডা নাকি হতাকা বিক্রি করতে আইছে, তয় এহন নাই।
এই বলে হালিমা কাজে যায়। নীলাঞ্জনার মনে পড়ে ডিসেম্বর মাস চলছে, নিশ্চয়ই পতাকা বিক্রি করতে কেউ এসেছিলো।
তুলতুলি তো ঠিকই বলেছে। লম্বা বাঁশের মাঝে বিভিন্ন সাইজের পতাকা বেঁধে নিয়ে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে। তুলতুলি নিশ্চয়ই পতাকা বিক্রি করার লোক দেখেছে। তুলতুলিকে ডাক দেয়, ও দৌড়ে আসে।
-- তুলতুলি শুন এরপর লোকটা আবার আসলে দাঁড়াতে বলিস, আমি কিনে দিব।
-- আফা এগুলো কি? অমন করে ঘুরে কেন লোকটা। আগে তো দেহি নাই।
-- তাহলে শুন....
এটা আমাদের দেশের পতাকা। সব দেশের এমন আলাদা আলাদা পতাকা থাকে। এই পতাকা আমাদের অর্জন, মানে এটা আমরা জয় করেছি। বড় বড় দেশের লোকজন ও আমাদের পতাকা চিনে। কোন দেশের পতাকার সাথে কোন দেশের পতাকা মিলে না। রঙ আর ডিজাইন কিন্তু আলাদা। আমাদের জাতীয় পতাকার রঙ সবুজ আর লাল, সবুজটা চার কোণা, তার ভিতরে লালটা গোল। অমনি তুলতুলি বলে....
-- হ আফা, লাল দেখছি আর গাছের পাতার মতো ছিলো।
-- হ্যাঁ শুন, সবুজ রং হইলো আমাদের দেশের সবুজ প্রকৃতির রং আর বৃত্তের লাল রং সূর্যের। অনেক আগে দেশে যুদ্ধ হইছিলো, যুদ্ধের পর বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার এই রূপ।
-- আফা আফনে এগুলা কিয়া কইতাছেন, যুদ্ধ আবার কি?
-- তুই এখনো অনেক ছোট, আরেকটু বড় হ, আমি তোকে বুঝিয়ে বলব। তবে এই পতাকা সব সময় উড়ানো যায়না। সব জায়গায় সব সময় উড়ানো যায়না। অনেক নিয়ম আছে, দেখবি এখন প্রতিদিন এগুলো নিয়ে আসবে। আবার আসলে আমি নিজেই তোকে কিনে দিব।
-- আফা আমি ঐটা দিয়ে কি করুম।
-- তাইতো, আচ্ছা থাক, বেটা আসলে আমায় ডাকিস কিনবো একটা।
কথা শেষ করে তুলতুলি বারান্দায় যায়, গ্রিল ধরে উপরে উঠে, খেলা করে। হঠাৎ ডাক দেয়....
-- আফা আফা, এইদিকে আইয়েন, দেহেন দেহেন ওই বেডা যাইতাছে।
নীলাঞ্জনা উঠে বারান্দায় যায়, দেখে বড় রাস্তা ধরে লোকটা হেঁটে যাচ্ছে।
-- তুলতুলি আর মাত্র ৩ দিন পড়েই ১৬ ডিসেম্বর, অনেক অনুষ্ঠান হবে বিভিন্ন জায়গায়, তুই যাবি আমার সাথে। আমাদের দেশে যে যুদ্ধ হইছিলো, সেই যুদ্ধ শেষ হইছে ১৬ ডিসেম্বরে। তাই প্রত্যেক বছর এই দিনে অনেক অনুষ্ঠান হয়। দেখবি মাইকে কত সুন্দর সুন্দর গান গাইবো।
-- আফা আফনেও গাইবেন নি।
-- আরে না, শুনতে যাব, দেখতে যাব।
হালিমার কাজ শেষ, তুলতুলিকে নিয়ে চলে যায় হালিমা। সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে, পেছন থেকে নীলাঞ্জনা বলে....
-- তুলতুলি মনে আছে তো, লোকটা আসলে দাঁড়াতে বলবি, আর আমায় ডাকবি।
-- হ আফা, মনে থাকবো।
বিকেলেই পরপর ২/৩ তা বেল বাজে কলিংবেলের, নীলাঞ্জনা দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলে।
দম ফেলার সময় নেই, জোরে জোরে দম নিচ্ছে আর বলছে.....
-- আফা আফা, বেডা আইছে।
-- কোন বেডা।
-- উম্মা বুলি গেছেন। ঐ যে হতাকা লই আইছে বেডা।
-- তুই দাঁড়া আমি টাকা নিয়ে আসি।
দুজন একসাথে নিচে যায়। দুটো পতাকা কিনে নীলাঞ্জনা। বড়টা নিজে নিয়ে আসে, আর ছোটটা তুলতুলিকে দিয়ে বলে....
-- আজ ঘরে নিয়ে রাখ, পরশু দেখবি সবাই পতাকা লাগাবে, তুইও গেইটের সামনে লাগাস।
ডিসেম্বর মাস চলছে, পতাকা দেখলেই তুলতুলির কথা মনে হয়, এবার আর ও শহরে নেই। নীলাঞ্জনা বলেছিলো ওকে যুদ্ধের কথা বলবে, তুলতুলি কি আর কখনো আসবে শহরে, দেখা কি হবে নীলাঞ্জনার সাথে। ডিসেম্বর ঠিক আসবে বছর ঘুরে ঘুরে, তুলতুলিরা আসে আবার হারিয়ে যায়, আবার অন্য এলাকায় আসবে, কাউকে আপন করে আবার চলে যাবে গ্রামে। ওদের স্থায়ী ঠিকানা শহরে হয়না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন