বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

তদন্তে ৩৫ জনের সম্পৃক্ততা পেয়েছে সিটিটিসি

গুলশান হামলার ৬ মাস

| প্রকাশের সময় : ২ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার ছয় মাস গতকাল রোববার পূর্ণ হলো। ওই হামলায় দায়ের করা মামলার তদন্তে এখন পর্যন্ত ৩৫ জনের সম্পৃক্ততা পেয়েছে তদন্তকারী সংস্থা ঢাকার কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। হামলার মূল সমন্বয়ক, সমন্বয়ে সহযোগিতা ও রেকি, আক্রমণকারী জঙ্গিদের প্রশিক্ষক, পরিকল্পনাকারী, বোমা তৈরি, অস্ত্র সংগ্রহ, আশ্রয়দাতা, সন্দেহভাজনসহ বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত এমন ৩৫ জনকে সনাক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে পলাতক ১৩ জনকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। সনাক্ত হওয়া আসামিদের মধ্যে ১১ জন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয়েছে। এই ১১ জনের মধ্যে গুলশান হামলায় সরাসরি অংশ নেয়া পাঁচ জঙ্গিও রয়েছে। দুইজন ভারতে পলাতক রয়েছে বলে জানা গেছে। দুইজনকে গুলশান মামলায় সরাসরি গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। ৯ জনকে অন্যান্য মামলায় গ্রেফতার দেখানো হলেও গুলশান হামলায় তাদের সহযোগিতার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য জানা গেছে।
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে রাজধানীর কূটনৈতিকপাড়ার ভেতরে অবস্থিত এই রেস্তোরাঁটিতে অতর্কিতে হামলা চালায় জঙ্গিরা। পরদিন সকাল পর্যন্ত চলা ওই হামলা ও পরবর্তীতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২২ জন দেশি-বিদেশি নাগরিক ও পাঁচ জঙ্গি নিহত হয়।  এ ছাড়াও ওই ঘটনায় একজন শেফ ঘটনাস্থলে ও আরেকজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান, তাদের প্রথমে সন্দেহভাজন হিসেবে দেখা হলেও এখনো তাদের বিরুদ্ধে জঙ্গি সম্পৃক্ততার কোনো তথ্য পায়নি পুলিশ।
একাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জঙ্গি হামলা হচ্ছে। বিভিন্ন সময় এসব হামলায় ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছে। অনেক ঘটনার কুলকিনারও হয়নি র্দীঘ দিন পরও। কিন্তু আমরা কম সময়ের মধ্যেই হামলার সাথে জড়িতদের সনাক্ত করতে পেরেছি। হামলার পর আমরা জঙ্গিদের কঠোর হস্তে মোকাবেলা করেছি। জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক এখন দুর্বল হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, এ হামলার সাথে জড়িতদের সনাক্ত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড বা মূল সমন্বয়কসহ অনেককেই সনাক্ত করা হয়েছে। এদের কেউ কেউ বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয়েছে। কেউ কেউ এখনো পলাতক রয়েছে। তাদের আমরা গ্রেফতারের চেষ্টা করছি।
সংষ্টি সূত্র জানায়, গুলশান হামলা মামলায় সরাসরি গ্রেফতার দেখানো হয়েছে দু’জনকে। তারা হলোÑ জিম্মি অবস্থায় উদ্ধার হওয়া হাসনাত রেজা করিম ও কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানা থেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেফতার হওয়া রাকিবুল হাসান রিগ্যান। রিগ্যান ইতোমধ্যে এই ঘটনায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। রিগ্যান গুলশান হামলায় অংশ নেয়া পাঁচ জঙ্গিকে ধর্মীয় শিক্ষার ক্লাস নিয়ে জিহাদে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
সিটিটিসির কর্মকর্তারা জানান, গুলশান হামলার মূল সমন্বয়ক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম আহম্মেদ চৌধুরী। গত ২৭ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এক অভিযানে দুই সহযোগীসহ তামিম নিহত হয়। গুলশান হামলার মূল সমন্বয়ক ও পরিকল্পনা করেছিল তামিম নিজেই। এ হামলা সমন্বয়ে তাকে সহযোগিতা করে নূরুল ইসলাম মারজান, রাজীব গান্ধী, মামুনুর রশীদ রিপন, সারোয়ার জাহান ওরফে আব্দুর রহমান ওরফে মানিক, মাইনুল ইসলাম ওরফে মুসা, শরীফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও রাশেদ ওরফে র‌্যাশ। এদের মধ্যে মারজান, রাজীব, রিপন, মুসা, খালেদ ও রাশেদ পলাতক রয়েছে। রিপন ও খালেদ ভারতে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার গুজব রয়েছে। তবে এ বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য জানা যায়নি। অপর দিকে, সারোয়ার জাহান ওরফে আব্দুর রহমান ওরফে মানিক ৮ অক্টোবর আশুলিয়ায় র‌্যাবের এক অভিযানে নিহত হয়।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, নব্য জেএমবির গুরুত্বপূর্ণ নেতা সারোয়ার জাহান গুলশান হামলার অর্থদাতাদের একজন। র‌্যাবের দাবি, সে নব্য জেএমবির কথিত আমীর আবু ইব্রাহীম আল হানিফ।
তদন্ত সূত্র জানায়, গুলশান হামলায় ব্যবহৃত অর্থের যোগানদাতাদের সনাক্ত করা হয়েছে। দুবাইয়ে পলাতক মুফতি শফিকুর রহমান নব্য জেএমবিকে নিয়মিত অর্থ সহায়তা করত। পলাতক জঙ্গি বাশারুজ্জামান ওরফে চকোলেট ওই অর্থ সংগ্রহ করে মূল সমন্বয়ক তামিমের কাছে দেয়। এছাড়া ডা. রোকন নামে এক ব্যক্তি সপরিবারে সিরিয়া চলে যাওয়ার আগে মোটা অঙ্কের অর্থ এ উদ্দেশ্যে তামিমের কাছে দিয়ে যায়। তারা তিনজনই বর্তমানে পলাতক রয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, গুলশান হামলার অস্ত্র ও গ্রেনেডের যোগানদাতা হিসেবে তারা এখন পর্যন্ত আটজনকে সনাক্ত করেছেন। অস্ত্র ও গ্রেনেড সরবরাহের মূল হোতা হলো জেএমবির শীর্ষ নেতা সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজ। তার নির্দেশনায় বড় মিজান, ছোট মিজান, জয়পুরহাটের সাগর, আবু তাহের, মিজানুর রহমান, সেলিম মিয়া ও তৌফিকুর রহমান ওরফে ডা. তৌফিক অস্ত্র-গ্রেনেড সরবরাহ করে। এই চক্রটি গুলশান হামলার আগে থেকেই নব্য জেএমবিকে অস্ত্র-গ্রেনেড সরবরাহ করত। এদের মধ্যে তাহের, মিজানুর, সেলিম ও তৌফিককে ২ নভেম্বর ঢাকার গাবতলী এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তবে তাদের পৃথক একটি বিস্ফোরক মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
সিটির দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, গুলশান হামলার তদন্তে প্রাথমিক পর্যায়ে যাদের নাম আসছেÑ তাদের বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। হামলার সঙ্গে সম্পৃক্ততার শতভাগ প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের মূল মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করা হবে।
সিটি সূত্র জানায়, গুলশান হামলায় অংশ নেয়া জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জাহিদুল ইসলাম ও রায়হান তারেক। এই দুজনই পুলিশের পৃথক অভিযানে নিহত হয়েছে। গত ২ সেপ্টেম্বর রূপনগরে সিটির এক অভিযানে জাহিদ নিহত হয়। এর আগেই ২৭ আগস্ট কল্যাণপুরে এক অভিযানে নিহত হয় রায়হান তারেক। এছাড়া এই ঘটনায় জুনায়েদ খান ও ইকবালের সম্পৃক্ততা পেলেও তাদের এখনো গ্রেফতার সম্ভব হয়নি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যে কর্মকর্তারা জানতে পারেন, গুলশান হামলায় অংশগ্রহণকারীদের আশ্রয়দাতা হলো তানভীর কাদেরী ও তার স্ত্রী আবেদাতুন ফাতেমা ওরফে খাদিজা। তানভীর কাদেরী আশ্রয় দেয়ার পাশাপাশি সমন্বয়ে সহযোগিতাও করে। এছাড়া গুলশান হামলার বিষয়টি আগে থেকে জেনে বিভিন্ন পর্যায়ে হামলাকারীদের সহযোগিতা করেছে মারজানের স্ত্রী আফরিন ওরফে প্রিয়তি, জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহার শীলা, মুসার স্ত্রী তৃষামনি, সুমনের স্ত্রী সারিকা ওরফে তাহিরা ও বাশারুজ্জামানের স্ত্রী শায়লা আফরিন। গত ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুরে এক অভিযানে তানভীর কাদেরী নিহত হয়। এছাড়া ওই আস্তানা থেকে তিন নারী জঙ্গি প্রিয়তি, শায়লা আফরিন ও আবেদাতুন ফাতেমাকে গ্রেফতার করা হয়। অন্য মামলায় গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও গুলশান হামলায় তাদের বিভিন্ন পর্যায়ে ভূমিকা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত ১ জুলাই হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় দেশি-বিদেশি ২০ নাগরিক নিহত হন। এর মধ্যে ৯ জন ইতালিয়ান, সাতজন জাপানি, একজন ভারতীয়, একজন বাংলাদেশ এবং আমেরিকার দ্বৈত নাগরিক ও দুইজন বাংলাদেশি। এ ছাড়াও হামলার মুহূর্তে পুলিশি অভিযান শুরুর মুখে জঙ্গিদের হামলায় নিহত হন রবিউল ইসলাম ও সালাউদ্দিন খান নামে দুই পুলিশ কর্মকর্তা। আহত হন আরো অন্তত ২৫ পুলিশ সদস্য। পরদিন সকালে সেনা কমান্ডোর নেতৃত্বে যৌথ অভিযানে রোহান ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, মীর সামিহ মোবাশ্বের, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল নামে পাঁচ জঙ্গি নিহত হয়। এছাড়া অভিযানে নিহত হয় সাইপুল ইসলাম চৌকিদার নামে এক শেফ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন