শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মহিলা

ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্যশ্রমিক রিনার স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও বাস্তবতা

| প্রকাশের সময় : ৩ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

শাহনাজ পলি : প্রতিদিন ভোর ৫টায় কাজে বের হন রিনা। ঘরে ফিরে আসেন রাত ১২টায়। কাজের ধরণটাও আর ১০টা কাজের মতো স্বাভাবিক না। রিনার কাজের ঝুঁকি আছে। কাজ করতে গিয়ে প্রায় প্রতিদিনই ভাঙা কাঁচে হাত কাটে, পা কাটে, পায়ে সূঁচ বিধে, গা ঘিনঘিন করে, বমি আসে, জ্বরেও ভোগে। পুরো মাস কাজ করতে পারে না। ১৫দিন বিশ্রাম নেয়। দিনে আয় করে দু-একশ’ টাকা। রিনার বয়স আনুমানিক ৩০-৩২। দুই সন্তানের জননী রিনা বর্জ্যজীবী পেশায় জড়িত। ‘বর্জ্যজীবী’ বা (ধিংঃব ঢ়রপশবৎ) হলো শহরের একটি অতি দরিদ্র জনগোষ্ঠী যারা রাস্তা, ডাস্টবিন বা বর্জ্য ডাম্পসাইট থেকে বর্জ্য সংগ্রহ ও তা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। অনেকে এদের ‘টোকাই’ বলেও অভিহিত করে। প্রথম প্রথম শরম লাগলেও পেটের দায়ে কাজে নেমে পড়ে। নাম পাল্টে হয়ে জান ময়লা কুড়ানী। ১২ বছর আগে বরিশাল থেকে ঢাকা আসে । এখানে সেখানে কাজের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। পরিচিত এক মহিলার সহায়তায় নেমে পড়ে বর্জ্য সংগ্রহ ও বিক্রির পেশায়। পেশাটি শহরের দরিদ্রতম জনগোষ্ঠীর শিশু, কিশোর-কিশোরী ও নারীদের আয় করার একটি স্বাধীন ও আত্মকর্মসংস্থানমূলক পেশা। শহরে ডাম্পিং সাইটে ট্রাকে করে আবর্জনা ফেলে এবং বুলডোজারগুলো আবর্জনা সমান করতে থাকে আবার একইসাথে শত শত শিশু-কিশোর-কিশোরী-নারী-পুরুষ এক হাতে আরচা ও অন্য হাতে বস্তা হাতে নিয়ে বর্জ্য সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় নামে। বর্জ্যজীবীরা ডাস্টবিন বা ল্যান্ডফিল্ড থেকে বিক্রয়যোগ্য, পুন:চক্রায়নযোগ্য ও পুন:ব্যবহারযোগ্য বর্জ্য সংগ্রহ করে তা বিভিন্ন শ্রেণিতে আলাদা করে ও বিভিন্ন উপায়ে প্রক্রিয়াজাতকরণ করে তা বিক্রয় করে থাকে বা নিজেরা ব্যবহার করে থাকে। সাধারণত তারা আবর্জনা থেকে উচ্ছিষ্ট খাবার, কাগজ ও প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল, ছেড়া জুট কাপড়, ভাঙা কাঁচ, লোহার টুকরা, দুধের পলিব্যাগ, ব্রাশ, বলপেন, পলিথিন, রাবারের সামগ্রী, রক্ত ও স্যালাইনের ব্যাগ, ফেলে দেয়া সিরিঞ্জ, হাড় ইত্যাদি সংগ্রহ করে। বর্জ্য সংগ্রহ করার পর তার গুণগত মান বাড়ানোর জন্য সেগুলো তারা নানাভাবে পরিষ্কার করে বা কখনো কখনো পানি দিয়ে ধোয়ামোছা করে। এরপর সেগুলো নিয়ে বর্জ্য বিক্রির দোকানে (ভাঙারি/কাগজ/জুট)-এর দোকানে বিক্রি করে।
গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটির হিসেবে দেশে আনুমানিক নারী ও শিশুসহ ৪ লাখ লোক ‘বর্জ্যজীবী’ পেশার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে তাদের জীবন ও জীবিকা টিকিয়ে রেখে চলেছে। ২০০৯ সালের পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী শুধু ঢাকা শহরেরই ১ লাখ ২০ হাজার দরিদ্র মানুষ ফেলে দেয়া বর্জ্য সামগ্রী পুনঃচক্রায়ন ও পুনঃব্যবহারের ব্যবসার সাথে জড়িত। তারা ঢাকা শহরের মোট বর্জ্যরে শতকরা ১৫ ভাগ পুনঃচক্রায়ন ও পুনঃব্যহাররের করে থাকে যার মূল্য বছরে প্রায় ১ হাজার ৭১ কোটি টাকার মতো। সম্প্রতি রাজধানীর সেগুনবাগিচাস্থ ঢাকা রিপোর্টারস ইউনিটিতে “গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটি এবং বাংলাদেশ মানবাধিকার সাংবাদিক ফোরাম” যৌথভাবে এক সভার আয়োজন করে। এতে মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশিষ্ট গবেষক ও গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটির প্রধান নির্বাহী একেএম মাকসুদ আহমদ। জাতীয় অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও বর্জ্যজীবীরা সমাজের এক অবহেলিত শ্রেণি হিসাবে বিবেচিত। তাদের কাজের কোনও আইনগত স্বীকৃতি নেই; শিক্ষার সুযোগ থেকে বর্জ্যজীবী শিশুরা বঞ্চিত; দক্ষতা বৃদ্ধির কোনও সুযোগ নেই; স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত। বর্জ্যজীবী শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং জীবন ও জীবিকা সম্পর্কে সাংবাদিকদের অবহিতকরণ সভায় বক্তাগণ নানা প্রসঙ্গ তুলে ধরেন সভায় বক্তাগণ। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য মতে শহরগুলোতে ১৩ হাজার ৩৩২টন বর্জ্য তৈরি হয় যা ২০২৫ সালে বেড়ে হবে ৪৭ হাজার টন।   
সভায় আলোচকগণ, বর্জ্যজীবী নারী ও শিশুদের মানবাধিকার রক্ষায় সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানানো হয়। সেই সাথে বর্জ্যজীবী শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং জীবন ও জীবিকা অবস্থার উন্নয়নে নীতি নির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। জাতীয় অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা থাকা সত্ত্বে¡ও বর্জ্যজীবীরা সমাজের এক অবহেলিত শ্রেণি হিসেবে বিবেচিত। এছাড়াও ডাম্পিং সাইটে গিয়ে বর্জ্যজীবী মানুষগুলো বিভিন্ন ক্ষতিকর দ্রব্য ও ভয়াবহ রোগ-জীবাণুুর শিকার বা সংক্রমিত হয়ে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। এদের মধ্যে ডায়েরিয়ার হার শতকরা ২৫ ভাগ। শতকরা ১০০ ভাগই খাবার আগে হাত ধোয় না। আবার শতকরা ৪২ জনই তিন বেলা খাবার পায় না। বড়দের পাশাপাশি শিশুরাও ডাম্পিং সাইট ও ডাস্টবিনের আশেপাশের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকে এবং দীর্ঘ সময় সেখানে অবস্থান করার কারণে ডায়েরিয়ায় এবং গ্যাস্ট্রিকে ভোগে। এছাড়াও কলেরা, আমাশয়, এইচআইভি সংক্রমণ, নানা ধরণের চর্মরোগ, জন্ডিস, নিউমোনিয়া, ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়। স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে কোন ভাল চিকিৎসা কেন্দ্রে বা চিকিৎসকের কাছে যাবার সুযোগ ও সামর্থ্য নেই তাই তারা স্থানীয় হাতুড়ে ডাক্তার বা ঔষধের দোকান থেকে চিকিৎসা নিয়ে থাকে। অনেক সময় বর্জ্যবাহী ট্রাক ও লেভেলিং মেশিন বা বুলডোজারের সাথে দুর্ঘটনার শিকার হয়। অনেকের অঙ্গহানি হয়ে চিরতরে পঙ্গু হয়ে যায়। বর্জ্য সংগ্রহের সময় তারা মাস্ক ব্যবহার করে না। হাতে গ্লোবস বা পায়ে ভারী বুট জুতা পরে না। এগুলো ব্যবহার করলে তারা অস্বস্তিবোধ করে এবং মনে করে শত শত নারী-পুরুষের মধ্যে বর্জ্য সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। বর্জ্যজীবীদের প্রায় সবাই নিরক্ষর এবং তাদের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই তাই তাদের কোন মাধ্যম থেকে স্বাস্থ্য শিক্ষা পাবার সুযোগও নেই।   

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন