শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

খেলা ফিচার

বাংলার ‘মেসি কন্যা’সাবিনা

প্রকাশের সময় : ১৪ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম | আপডেট : ৯:১৮ পিএম, ১৪ জানুয়ারি, ২০১৭

হাসান সোহেল : ছোটবেলায় পাড়ার মোড়ে অথবা গ্রামের মাঠে ক্রিকেট খেলার সময় আঙুলের কড়ে গুনে রানের হিসেব রাখতে হিমশিম খেতে হয়েছে কম-বেশি সবাইকে। ক্রিকেট মাঠে স্কোরারকে তাই পুরোটা সময় ব্যস্ত থাকতে হয়। তবে ফুটবলে এতশত হিসেব রাখার বালাই প্রায় নেই বললেই চলে। এক্ষেত্রে ‘প্রায়’ শব্দটা ব্যবহার করতে হলো কারণ মাঠে যদি থাকেন সাবিনা খাতুনের মতো একজন, তবে গোলের হিসেব রাখতে গিয়ে স্কোরার কিংবা সাধারণ দর্শক হাঁপিয়ে উঠবেন বলা চলে। প্রত্যেক ম্যাচে চার-পাঁচ গোল করাকে নিতান্তই সাধারণ (!) বানিয়ে ফেলেছেন বাংলাদেশের গোলমেশিন সাবিনা খাতুন।
সাবিনা খাতুন সম্পর্কে প্রথমেই বলতে হয় তার অবিশ্বাস্য গোল করার ক্ষমতা। এক ম্যাচে হ্যাটট্রিক, কিংবা বড়জোর পাঁচ গোল যেখানে অসাধারণ বলা যায় হয় সেখানে ১৬ গোল করার কৃতিত্ব আছে এই ফরোয়ার্ডের। এইতো সেদিন আফগানিস্তানের বিপক্ষে সাফ উইমেন’স চ্যাম্পিয়নশিপের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে একাই করেছেন পাঁচ গোল। ঘরোয়া এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইতোমধ্যে দু’শতাধিকেরও বেশি গোল করা এই ফুটবলার প্রতি ম্যাচে গড়ে দুই থেকে তিনটি করে গোল করেন।
সাতক্ষীরার মেয়ে সাবিনার শুরুটা ২০০৯ সালে। সিটিসেল জাতীয় মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার পর ধারবাহিকভাবে খেলেছেন ঢাকা মহানগর মহিলা ফুটবল লিগে; কেএফসি জাতীয় মহিলা ফুটবলে হয়েছেন সেরা খেলোয়াড়। ২০১৪ সালের শেষ নাগাদ ঘরোয়া ফুটবলের শতাধিক গোল করেন সাবিনা, হয়ে যান জাতীয় দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
২০১৪ সালে পাকিস্তানে মহিলা সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে মালদ্বীপের বিপক্ষে জয়ে গুরুত্বপূর্ণ দু’গোল করেন সাবিনা। এর মাধ্যমেই মালদ্বীপ ফুটবল কর্তাদের নজরে আসেন তিনি। এরপর দেশের প্রথম প্রমীলা ফুটবলার হিসেবে দেশের বাইরের লিগে খেলার সুযোগ পান সাবিনা। এর আগে কাজী সালাউদ্দিন, কায়সার হামিদ, প্রয়াত মোনেম মুন্না এবং মামুনুল দেশের বাইরে খেলার ডাক পেলেও নারী হিসেবে সাবিনাই প্রথম।
তবে প্রথমবারেই বিদেশি লিগে খেলতে গিয়ে সাবিনা যে কৃতিত্ব করেছেন তা বোধহয় রূপকথাকেও হার মানায়। মালদ্বীপে পুলিশ ক্লাবের পক্ষে অভিষেকেই করেছেন চার গোল, পরের ম্যাচে একাই করেছেন ১৬ গোল (৫টি হ্যাটট্রিক!)। এর আগে ঢাকার মাঠে একবার এক ম্যাচে ১৪ গোলের রেকর্ড ছিল এই স্ট্রাইকারের। মালদ্বীপে মোট ছয় ম্যাচে সাবিনা গোল করেছিলেন ৩৭ টি এবং এর পাঁচটিতেই ছিলেন ম্যাচসেরা।
ঢাকা মোহামেডানসহ ক্লাব পর্যায়ে একের পর এক বিস্ময় উপহার দেয়া এই ফরোয়ার্ড জাতীয় পর্যায়েও সমান উজ্জ্বল। চলতি সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম ম্যাচে পাঁচ গোল করেছেন, দ্বিতীয় ম্যাচে ভারতের বিপক্ষেও দলের মূল ভরসার নাম সাবিনা খাতুন। এস এ গেমস, অলিম্পিক প্রি কোয়ালিফাইং কিংবা এএফসি ওমেন্স এশিয়ান কাপ ২০১৪ বাছাইপর্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ম্যাচে বরাবরই গোল করেছেন তিনি, অসাধারন পারফরম্যান্স এবং নেতৃত্বগুণের কারণে বর্তমান বাংলাদেশ প্রমীলা ফুটবল দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পেয়েছেন। তাকে নিয়ে এখন চলছে টানা-টানি। মালদ্বীপে দূর্দান্ত ফুটবল উপহার দেবার পর এবার এই গোলকণ্যার দিকে চোখ পড়েছে দুবাইয়ের ক্লাব রোজানিও। ক্লাবটি তাদের আগ্রহের কথা জানিয়ে সাবিনার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে এবং সাবিনা বিষয়টি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে সাবিনা জানান, ‘আমার সঙ্গে দুবাইয়ের একটি ক্লাব যোগাযোগ করেছে। তবে এখানে কিছু শর্ত আছে। আমি পুরো বিষয়টি বাফুফে মহিলা কমিটির প্রধান মাহফুজা আক্তার কিরণের ওপর ছেড়ে দিয়েছি। এর আগে কিরণ আপাই আমাকে মালদ্বীপে খেলার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন’। ফেব্রুয়ারিতে শুরু হবে দুবাইয়ের ফুটবল টুর্নামেন্টটি। রোজানিও ক্লাবে ইতোমধ্যে পাকিস্তানের অধিনায়ক ও গোলরক্ষক মাফারাসহ পাঁচ পাকিস্তানি ফুটবলার যোগ দিয়েছেন। ২০১৫ সালে এক এসি মিলান সমর্থক ক্লাবটি প্রতিষ্ঠা করেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায় রোজানিও ক্লাবের সঙ্গে ইতালিয়ান জায়ান্ট এসি মিলানের একটি চুক্তি আছে। এখন সময়ই বলে দেবে, সাবিনা আর কতদূর যাবেন। তবে তার আগে সাবিনার কীর্তিকে নিজের সঙ্গে তুলনা দিলেন বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। সম্প্রতী সাফজয়ীদের ওয়ালটনের সংবর্ধনা নিতে যখন মঞ্চে উঠে এলেন সাবিনা, পাশে দাঁড়িয়ে সাবিনাকে স্তুতিতে ভাসালেন বাংলাদেশ ফুটবলের জীবন্ত কিংবদন্তি সালাউদ্দিন। বললেন, ‘আমি আর সাবিনা একটা জয়গায় সবচেয়ে উপরে। বাংলাদেশী ফুটবলার হিসেবে কেবল আমরা দু’জনেই বিদেশী লিগে খেলে এসেছি।’
ব্রাজিলের তারকা মার্তাকে আদর্শ মানেন সাবিনা। ‘স্কার্ট পরা পেলে’ হিসেবে পরিচিত মার্তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে একটি দেশের নারী ফুটবলের সমার্থক হয়ে গেছেন সাবিনা। ফুটবল ভক্তদের কাছে ‘বাংলার মেসি কন্যা’ নামে পরিচিত এই ফুটবলার নৈপুন্য দিয়েই তার এই নামটি স্বার্থক করে তুলছেন। তার পরও মাটিতেই পা রাখছেন সাবিনা। দৈনিক ইনকিলাবকে জানালেন নিজের অনুভুতির কথা-
প্রশ্ন : গত তিন আসরে হয়নি। এবার রানার্সআপ। নিঃসন্দেহে সেরা সফলতা?
সাবিনা খাতুন : অবশ্যই। এটা বলতে দ্বিধা নেই যে, এটা আমার এবং অন্য সকলেরও সেরা সাফল্য। আসলে পুরো দলেই কম্বিনেশন ভালো ছিল। আমরা সবাই একতাবদ্ধ ছিলাম। তাছাড়া কোচ ছোটন স্যারও আমাদেরকে সব সময় সাহস যোগাতেন। তাই তো এমন সেরা সাফল্য ধরা দিল।
প্রশ্ন : এবারের সাফল্যের পেছনে কোন বিষয়টি কাজ করেছে?
সাবিনা : এই টুর্নামেন্ট উপলক্ষ্যে আমরা (সিনিয়র) দু’মাস অনুশীলন করেছি। আর জুনিয়ররা (অনূর্ধ্ব-১৬) তো অনেক আগে থেকেই অনুশীলনে ছিল। পরবর্তীতে সিনিয়র ও জুনিয়ররা মিলে আমরা এক সঙ্গে অনুশীলন করেছি। ফলে কিছু ভুল ক্রুটি থাকলে তা শুধরে নিতে পেরেছে সবাই। তাছাড়া মাঠে যখন খেলেছি, সবাই খেলাটাকে উপভোগ করেই খেলেছি।
প্রশ্ন : জুনিয়রদের অধিকাংশইতো ময়মনসিংহের কলসিন্দুঁরের মেয়ে। সিনিয়র দলে কেমন দেখলেন তাদের?
সাবিনা : কলসিন্দুঁরের মেয়েরা খুব ভালো খেলে। আসলে ওরা সব সময় অনুশীলনেই থাকে। শুনেছি সেখানে ভালো অনুশীলন করানো হয়। আসলে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) যদি দীর্ঘমেয়াদী অনুশীলন করায় তাহলে ওরা অনেক দূর যাবে।
প্রশ্ন : অধিনায়ক হিসেবে ওরা আপনাকে কতটা শ্রদ্ধা করে?
সাবিনা : অধিনায়ক হিসেবে মাঠে এবং মাঠের বাইওে আমি ওদেরকে সাহস যোগাই। তারা আমাকে বেশ শ্রদ্ধা করে। আমার সব নির্দেশনাই তারা মাঠে প্রয়োগ করে। আসলে মেয়েগুলো খুবই ভালো।
প্রশ্ন : প্রতিপক্ষের জালে গন্ডায় গন্ডায় বল জড়াচ্ছেন। হ্যাটট্রিকের পর হ্যাটট্রিক করছেন। এটা কিভাবে সম্ভব হচ্ছে?
সাবিনা : এটা আসলে কিছু গড গিফটেড। সেই সঙ্গে নিজের প্রচেষ্টা তো থাকেই। তাছাড়া আমার পজিশনটাই তো ফরোয়ার্ডে। সব মিলিয়ে গোল পাচ্ছি নিজের ইচ্ছে মতোই। এতে অবশ্যই সতীর্থদের সহযোগিতা রয়েছে। তাছাড়া গোল করাটা আমার শখ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন গোল করতে না পারলে আর ভালো লাগে না।
প্রশ্ন : সাফ শেষ। এখন কি করছেন?
সাবিনা : সাফ টুর্নামেন্ট শেষ করলাম। এখন অখন্ড অবসর। তাই গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরাতেই থাকি। সেখানেই সময় কাঠে। তবে ফুটবলের অনুশীলনটা সব সময় চালিয়ে যাচ্ছি।
প্রশ্ন : গতবার তো মালদ্বীপে খেলেছিলেন। এবার কি আমন্ত্রণ পেয়েছেন?
সাবিনা : গতবাল মালদ্বীপ পুলিশ দলের হয়ে খেলেছিলাম। আমি সাবিনা আক্তার ও মিরোনা মিরো বেশ মজা করেছিলাম। অনেক গোলও করেছিলাম। তবে এবার এখনো আমন্ত্রণ পাইনি।
প্রশ্ন : শুনলাম দুবাইয়ের একটি ক্লাবও নাকি আপনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে?
সাবিনা : হ্যাঁ, দুবাইয়ের রোজানিও ক্লাব কর্তৃপক্ষ আমাকে ফোন করেছিলেন। তারা সেখানকার লিগে ওই ক্লাবের হয়ে খেলাতে চান। তবে আমি এখনি কিছু বলিনি। সুযোগ পেলে অবশ্যই খেলতে যাবো। তবে এ জন্য বাফুফের ছাড়পত্র পেতে হবে আমাকে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন